কেন এই শূন্য-শূন্য লাগা
রাতের আকাশ জানে আমি কেন একাকী পথিক।
তোমার শূন্যতাগুলো অনুবাদে অচেনা-অচেনা
আমি জানি—সারারাত তারাগুলো কী গান শোনায়
হাওয়াদের মাঠে-মাঠে মেঘেরাও ভেসে আসে কেন,
আমি জানি—বিকেলের হাওয়া তোমাকে জাগাতে চায়
নিবিড় সন্ধ্যায় জ্বলে ওঠে যে কামরাঙা তারা
সেও চায়—তুমি আজ জেগে ওঠো দেহের বন্দরে।
তবু তুমি অস্বীকার করো এই কামনার ভাষা!
আমি জানি—কেন আজও তোমার শূন্য-শূন্য লাগে
কেন তুমি দক্ষিণের জানালায় দাঁড়াও না আর
কেন তুমি মধ্যরাতে বসো—ভাবো বিরহের দিন—
তোমার উঠোনজুড়ে আজও কাঁপে বুকের আঁচল
আমি জানি—পৃথবীতে ছায়া নেমে এলে—
তুমি খুব একা হয়ে যাও
তোমার ঠোঁটের কোণে ডুবে চায় চাঁদের ঝিলিক
চরাচরে জাগে প্রশ্ন—কেন এই শূন্য-শূন্য লাগা!
অবজ্ঞা
একটি তারা ওই যে জ্বলে-ডোবে
একটি তারা একলা ভীষণ পোড়ে
নীল-আকাশের তাতে কী যায় আসে
তবুও দেখো একলা শালিখ ওড়ে;
পুড়ুক তারা, পুড়ুক হৃদয় কবির
তোমার তাতে কীই-বা আসে যায়
ভাঙুক কবির একলা হৃদয়—পুড়ুক
বিরান রাতে তোমার প্রতীক্ষায়!
একলা রাতে জাগে কবি, জাগে
আর জাগে ওই দূর আকাশের চাঁদ
তবুও তুমি গভীর ঘুমে থাকো
সমস্তরাত কবির মরণ ফাঁদ।
কবি পুড়ুক, কবি মরুক তবে
তোমার তাতে কীই-বা আসে যায়
কবি সে তো পাগলপ্রেমিক শুধু
ধুলায় কতই গড়াগড়ি খায়!
তারও বেশি নীল মেঘ
আমি গীতাদত্তে মশগুল—তুমি মান্না দে-হেমন্তে
তোমার খোলা চুলের মতো ধানক্ষেতে হাওয়ারা নাচে
এইসব অলৌকিক চিত্রকল্পে বিভোর ঈশ্বর
অস্থির ফড়িঙগুলো পেখমের অহঙ্কারে কাঁপে!
এই নষ্টনগরীর নির্বান্ধব সকাল-দুপুর
মনে হয় আন্দামানে আছি
বাল্যপ্রেমিকা আমার তুমি সেই আলেয়া খানম
তোমার নিদ্রার তলে ডুবে যাচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ
তুমি তারে আঁজলায় পান করে নাও।
আমাদের বিশ্বে আজ বয়ে যাক বিরহ তুফান!
লাল গোলাপে তোমার চোখ যত হাসে
তারও বেশি নীল মেঘ—আকাশের হৃদয় রাঙায়!
নিয়তি
রাধিকা চাঁদের মতো সঙ্গীহীন উড়ন্ত পাখিরা
হাততালি শুনে শুনে নেমে আসে মেঘের মাস্তুলে
কার হাসি কাশফুলে দোল খেয়ে যায়
. অন্ধকারে চুমো খায়
রাত্রির সঘন ভাঁজে রাতের যমজ
আমাদের স্বপ্নবাড়ি লালনীল মিথের প্রাসাদ।
আমাদের মধ্যরাতে মৌ-মৌ কুসুমের
. —ঘ্রাণ
ভাসে যুবতী বাতাসে।
দখিনের জানালায় পর্দা সরে যায়
পূর্ণচাঁদ উঁকি দেয় ফুল তোলা বালিশের ভাঁজে
বলো, কোন কবি এই চিত্রকল্প আঁকে?
কারে তুমি রূপে-রসে বেদনার দেবী ভেবেছিলে?
কারে তুমি ভেবেছিলে যুবা লখিন্দর
এইখানে মন নয়, মান নয়, দেহের বন্দরে
দেখো হাসে বাঁকা হাসি সিকি মোনালিসা
দেখো, দেখো চূড়োরূপী পার্বতীর খোঁপা—
কদমের ঘ্রাণ নেই—তবু লোকে বরষায় খোঁজে!
তৃষ্ণা
আমার সমস্ত রাস্তা যদি উড়ে যায় মেঘস্রোতে
আর ওই রাত নামে হামাগুড়ি দিয়ে অনন্তের
আন্ধারের মতো;
সম্ভ্রান্ত সন্ধ্যারে কোন্ কবি বশ করে নিয়ে যাবে
ডালিম ডানার মতো লাল-লাল সূর্যাস্তের আগে!
আপেল আর বলের দূরত্ব মাপতে গিয়ে কাল
তুমি নাকি এঁকেছিলে হৃদয়ের ম্যাপ!
তবে দ্বিধা কেন—
চলো পুড়ে যাই, চলো উড়ে যাই তৃষ্ণার দহনে
এই চলন্ত নগরী হা করে থাকুক
পোড়াক মন-হৃদয়!
দুরন্ত দুপুর ঝুলে থাক কামারের হাপরের
. —লালে।
দেখেছ আগুন ফুল—উড়ে-উড়ে চৈত্রের হাওয়া
কামারের মুখে তবু হাসির উপমা!
সেদিন গোপন নদী
ঢেউহীন বেদনার স্রোতে ভেসে গেলে
আমাদের তর্ক তবু থেমে যায় লালমাছি গ্রামে
নগরে নেমেছে লাল একজোড়া রাত!
এমন আন্ধারে তবু চিঠি লেখে যারা, তারা নাকি
বেদনার ভাষা ভুলে যায়!
তারা নাকি পাঠ করে প্রাচীন হৃদয়—
. চুর হয়ে ডুবে থাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে!
কে তুমি হৃদয়হীন ডাক দিলে ডাকনাম ধরে
চৈত্রের অনেক দেরি
মাঠে মাঠে বাতাসেরা তর্কে মেতেছেন—
আমাদের চোখ তবু ফালি-ফালি তরমুজ দেখে।
জুনের জাতক
বাবা বলতেন, জুনের জাতক নাকি জেদি হয়!
ভীষণ গোঁয়ার আর একরোখা হতে হতে তারা
নির্বান্ধব হতে থাকে।
তাদের বন্ধু থাকে না। থাকে না সঙ্গীও। তারা নাকি
একইসঙ্গে খুনিও প্রেমিকের হৃদয় নিয়ে জন্মায়।
বাবার কথা বিশ্বাস করতাম না তখন—
ফলত নতমস্তকে কেটে পড়ার
ধান্দায় থাকতাম আমরা।
ভাইদের মধ্যে আমি বড়, আর আমারই জন্ম
এই অভিশপ্ত জুনে!
ফলত ছোট ভাইয়েরা আমার দিকে তাকাতো
ভয়ার্ত চোখে, ভীষণ কম্পমান তাদের চোখের তারা!
বাবা চলে গেলেন পরপারে—ভাইয়েরা যে যার মতো সংসারী
আমিও।
খুনি তো হতে চাইনি, প্রেমিকও হতে পারিনি কারও
কিন্তু আমি একরোখা কি না
বুঝে ওঠার আগেই দেখি—আমি একা হতে হতে
হয়ে গেছি পৃথিবীর একমাত্র নির্বান্ধব বেকুব জাতক।
মানুষ
মানুষ! কতভাবেই না দূরে সরে যায়
এভাবেও যায়, ওভাবেও যায়।
মানুষ! এভাবেও কাছে আসে, ওভাবেও আসে!
যেমন—‘কার’ ও ‘প্রত্যয়ে’র বিভেদ ভুলে
‘ও’ বসে কার হয়ে বর্ণের পাশে!
এভাবেও মানুষ মানুষের পাশে থাকে।
মানুষ! দূরে চলে যায়, এভাবেও যায়
যেমন—মেঘের হৃদয় চিরে পৃথিবীতে নেমে আসে
লক্ষ্যচ্যুত উল্কাপিণ্ড—প্রেমের বিদ্যুৎ!
আহা! মানুষের মানচিত্রে মানুষই রহস্য কেবল!
মিল-অমিলের সঙ্গে
তোমার সঙ্গে যত অমিল, তোমার সঙ্গেই মিল
মনের ভেতর উধাও নদীর উড়ন্ত গাঙচিল!
হায়রে আমার মাতাল নদী, হায়রে নদীর ঢেউ
অমাবস্যায় আর কি তেমন সাঁতার কাটে কেউ?
নদী তো নয় জলকুমারি। শরীরজোড়া সাপ।
তোমার সঙ্গে লুকোচুরি, জলেই প্রথম পাপ।
আমি পাপি, ভুলোমনা। ভুলেছি নামধাম
তুমি কেন তুললে ফণা, ভয়াল অভিরাম!