বৌ
কেমন পুতুল বৌ এনে দিলে মা
সারাবেলা বৌ বৌ খেলে ভেসে গেলো সোনার সংসার
বৌ আমার কুয়াতলায় মাটির কলসি ভাঙে রোজ
চালুনি-কুলার কাজে ভুল করে কাঁদে
হাঁড়ির ভেতর পুড়ে চাড়া হয় লাউফুলভাত।
কেমন পুতুল বৌ এনে দিলে মা
বৌ আমার বাউটির সাদা রঙ সিঁদুরের লাল দেখে হাসে
সাঁঝের তুলসী তলায় হাসে না কেবল মাটির পিদিম।
লাঙলের ফলায় এখনো লেপ্টে আছে গাভিন জমির দো-আঁশ শরীর
মাটি থেকে তুলে আনা সোনার মোহর কাঁদে অযত্ন লালনে
যে বোঝে না ফসলের সোনালি কীর্তন
আঁচলের গিঁট খুলে তার হাতে তুলে দিচ্ছ ভাঁড়ারের চাবি…
তোমার শীর্ণ হাতের স্নেহজ পূজার লোভে
শূন্য হতো এ-বাড়ির ও-বাড়ির লক্ষ্মীর আসন
আজ এই ঘর ছেড়ে অনাহারী দেবতার হাত ধরে সুখ চলে যায়।
আমার পুতুল বৌ কোনোদিন বিষ্ণুপ্রিয়া হলে
হাতের রেখায় তার ফুটে উঠবে প্রসন্ন ধানছড়া।
ওড়ো, পাখি ওড়ো
অনুতাপ বেজে ওঠো মগজের কোষে
অনুতাপ বেজে ওঠো নিজ মুদ্রাদোষে
অনুতাপ জ্বলে ওঠো আকাশে আকাশে
অনুতাপ জ্বলে জ্বলে আলো হয়ে যাও
ত্রিভুজ সন্ধ্যায় আকাশে জ্বেলেছো কে অচেনা লণ্ঠন
আমাকে দীতি করো আলোব্রহ্মজ্ঞানে
ভারাক্রান্ত মেঘগুলো পুষে আছি বহুদিন
উষ্ণতা ঢেলে কোনোদিন বৃষ্টি ঝরাবো বলে
বৃষ্টির চুমোয় যদি হেসে ওঠে অন্তত একটি ঘাসফুল
বোবা সময় যদি বলে ওঠে শ্রেষ্ঠ কথকতা
অরণ্যে আগুন লাগিয়ে একদিন স্বপ্নে এঁকেছিলাম ইউরেনাস
সেই থেকে দুই চোখ ধাতবখচিত
সেই থেকে দুই হাত কুঠার কুঠার
ডানা পোড়া পাখিদের পতন দৃশ্যে ভুলে ছিলাম আত্মার স্পন্দন
আজ আমি সেইসব পাখির নামে
প্রাণ খুলে মেলে ধরি নতুন আকাশ
ওড়ো…
পাখি ওড়ো…।
মনীষা তোমাকে…
মনীষা, তোমাকে শ্মশানে দেবো না
পৃথিবী জাগার আগেই শবদেহ কাঁধে নিয়ে নেমে যাবো পথে
নরলোকে প্রায়শ্চিত্ত বলে যদি প্রচারিত হয়, হোক
তবুও মনীষা, তোমাকে শ্মশানে দেবো না
তুমি চলে গেছো তবু নির্লিপ্ত প্রত্যঙ্গে ফুটে আছে উজ্জ্বল প্রেমের উৎপল
তোমার চোখে মুখে ঠোঁটে স্তনে অজস্র কথার মঞ্জরি
যেন এইমাত্র হাসতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছো
আধবোজা চোখের কোণে জমে আছে প্রশান্ত হ্রদ
আবহমান কাল ধরে সাঁতরে সাঁতরে অকস্মাৎ থেমে গেছো
একান্ত রাজহাঁস
পুষ্পিত শবদেহ কাঁধে নিয়ে অনন্ত ভ্রমণে যাবো বিশ্বচরাচর
স্থানে স্থানে খসে পড়বে এক-একটি অঙ্গের শিল্পিত কথা
তোমার প্রত্যঙ্গ দিয়ে পৃথিবীর খাতা ভরে
লিখে দেবো মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা!
বাড়ি যাব
পুরুষ বেশ্যার মতো আমি এই নগরীতে আছি
ইচ্ছে হলেই পালাতে পারি না
আমাকে পালাতে দেয় না কাম
সারাদুপুর ফড়িঙের পিছে পিছে ছুটতে ছুটতে
ছোট্ট ফড়িং হয়ে ধানপাতায় ঘুমিয়ে পড়তো যে কিশোর
তার
মফস্বলের ছাদ
মধ্যরাতের চাঁদ
সুর আর কবিতার
নিবিড় আড্ডা ভেঙে যায়
সেই থেকে আমি এই নগরীতে আছি
আমাকে পালাতে দেয় না কাম
আমাকে পালাতে দেয় না সিঁড়ি
ইটের অরণ্যের সোনার হরিণ হে, আমাকে
কোন পথে নিয়ে যাচ্ছো তুমি
পাটক্ষেতের আ’ল ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি বাড়ি ফিরতে চাই
পুনই বিলের পুঁটি আর রুপালি বাঁশপাতা মাছে খালুই ভর্তি করে
ঘোর সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরতে চাই
শীতরাতের ঢপযাত্রা শেষে রাধার বিরহ আর কুয়াশায়
ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরতে চাই
সময়, একটু পেছনে চলো
মা আমার দুধভাত মেখে অনন্তকাল ধরে বসে আছে পৈঠায়
আমি বাড়ি যাবো!
বাঁচার আর্তনাদ
জ্ঞানের নির্মম ভার আমাকে সইতে বলো না
আত্মায় জ্বেলে রাখা কী দুঃসাধ্য চিরন্তন প্রতীাবোধ
বরং শ্রেয়তর ফড়িং জীবন
নিরুদ্দেশ ওড়াওড়ি প্রথাগত যতিচিহ্ন ছিঁড়ে
আমাকে আস্বাদ নিতে বলো না গন্ধম
আঁধারের আধারেও স্বর্গ আঁকা থাকে
জীবনের অর্থ যদি অর্থহীনতাই
তবে আরো অর্থ খোঁজা স্রেফ অর্থহীন
মুক্তির শিরোনামে আরো এক অনিবার্য কেশ
দ্বিধাহীন উত্তরে বলো
হে আমার অন্তর্গত প্রশ্নবিদ্ধ বিমূর্ত বিষাদ
মানুষ কেবলই জীব—ভেতরে বাঁচার আর্তনাদ।