বেলারুশের লেখক, সাংবাদিক সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ ২০১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এক সময়ের যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত সাহসিকতার সঙ্গে তিনি ব্যতিক্রমধর্মী ঘরানায় উপস্থাপন করেছেন। তাঁর লেখা নন-ফিকশনধর্মী দ্বৈতস্বরের গদ্যকে সুইডিশ অ্যাকাডেমি ‘সমকালীন যাতনা আর সাহসিকতার সৌধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।। ৮ অক্টোবর ২০১৫ বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১২তম লেখক হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করে সুইডিশ অ্যাকাডেমির প্রধান সারা দানিউস বলেন, ‘আলেক্সিয়েভিচ তাঁর অনন্য সাধারণ লেখনি শৈলীর মাধ্যমে সতর্কভাবে বাছাই করা কিছু কণ্ঠের যে কোলাজ রচনা করেছেন, তা পুরো একটি যুগ সম্পর্কে আমাদের বোধের জগৎকে নিয়ে গেছে আরও গভীরে।’ সারা দানিউস আরও বলেন, ‘সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচের ৪০ বছর কেটেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে। তিনি সেখানে অসংখ্য মানুষের জীবন কাহিনী শুনেছেন। তিনি তাঁর গদ্যে কেবল ইতিহাসকেই তুলে ধরেননি, ধারণ করেছেন মানুষের আবেগের ইতিহাসকেও।’
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সংবাদ পেয়ে তিনি সুইডেনের এসটিভিকে বলেন, এই সুখবর তার মনে ‘মিশ্র অনুভূতি’ জাগাচ্ছে। তার মনে আসছে আইভান বুনিন আর বরিস পাস্তারনাকের মতো সাহিত্যিকের নাম। এ অনুভূতি একই সঙ্গে ‘চমৎকার’, আবার একটু যেন ‘বিব্রতকর’। তিনি আরও বলেন, ‘আমার এক একটা বই লিখতে বহুদিন লাগে, পাঁচ থেকে দশ বছর। এখন নতুন দুটো বইয়ের আইডিয়া মাথায় আছে। এখন হয়ত আমি লেখার সুযোগ পাব, আমি খুশি।’
সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ ১৯৪৮ সালের ৩১ মে ইউক্রেনের ইভানো-ফ্রাঙ্কোস্ক শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা প্রথমে সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। অবসর নিয়ে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বেলারুশে চলে যান। বাবা-মা দু’জনেই শিক্ষকতা শুরু করেন। স্কুলের পাঠ সমাপ্ত করে স্নাতক ডিগ্রি লাভের আগেই সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ স্থানীয় কয়েকটি সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি সাংবাদিকতায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি প্রথমে পোল্যান্ডের সীমান্তে একটি সংবাদপত্রে চাকরি নিলেও পরে মিনস্কে ফিরে সাংবাদিকতা শুরু করেন।
সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ এক সময় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তাঁর প্রথম বই ‘ওয়ার’স আনওম্যানলি ফেস’। ১৯৮৫-এ অনুসন্ধানধর্মী সাক্ষাৎকার ভিত্তিক নন-ফিকশন আঙ্গিকের এই বইটি প্রকাশিত হয়। এই বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বিড়ম্বনার শিকার হন। পাবলিসিং হাউস বইটি ছাপতে চায় না। কারণ হিসেবে এই বইটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বীরাঙ্গনাদের অবমাননাকর কথা নাকি লেখা হয়েছে বলে অভিযোগে আলেক্সিয়েভিচকে অভিযুক্ত করা হয়।
সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ ‘ওয়ার’স আনওম্যানলি ফেস’ উপন্যাসটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অংশগ্রহণকারী মহিলাদের স্বগতোক্তি আর লেখকের উপস্থাপনার মধ্যেই দ্বৈতস্বরের অনুরণন আমরা লক্ষ করি। ইতিহাস ভিত্তিক সাক্ষাৎকারধর্মী ‘ওয়ার’স আনওম্যানলি ফেস’ বইটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিষ্ঠুরতার ইতিবৃত্ত। বইটিতে শুধু সীমান্তের গল্প ছিল না, ছিল যুদ্ধে অংশ নেওয়া মহিলাদের হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতার কাহিনিও।
সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ তথ্যভিতিক ইতিহাস নির্ভর নন ফিকশন উপহার দিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যকে । সাহসিকতা ও কষ্ট ক্লেশের ফসলই ২০১৫ এ তাঁর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। সাহিত্যকর্মের জন্য বিশ্ব সাহিত্যঙ্গনে আলেক্সিয়েভিচ চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।
‘ওয়ার’স আনওম্যানলি ফেস’ বইটিতে সত্য কথনের জন্যে সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ সরকারের বিরাগভাজন হন। ফলে তাকে হেনস্তার শিকার হতে হয় । এ কারণে তিনি ২০০০ সালে বেলারুশ ত্যাগ করেন। পরবর্তী দশ বছর ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেনে বাস করতে বাধ্য হন। দ্য ইন্টারন্যাশনাল সিটিস অব রিফ্যুজি নেটওয়ার্কের আমন্ত্রণে তিনি পরবর্তী দশকে প্যারিস, গোথেনবার্গ ও বার্লিনে বসবাস করেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া মহিলাদের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেন। এই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তাঁর বই ‘ভয়েসেস অব ইউটোপিয়া’। একইভাবে ইউক্রেনের চেরনোবিলে পারমাণবিক দুর্ঘটনার পরে লেখেন ‘ভয়েসেস ফরম চেরনোবিল : দ্য ওরাল হিস্টোরি অব নিউক্লিয়ার ডিজাস্টার’। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান অভিযান নিয়ে লিখেন, ‘জিংকি বয়েস: সোভিয়েত ভয়েস ফ্রম দ্য আফগানিস্তান ওয়ার’।
এছাড়া, ‘সোয়েতলানা দ্য লাস্ট উইটনেস: দ্য বুক অব আনচাইল্ড লাইক স্টোরিস’, ‘এনচানটেড উইথ ডেথ’ ইত্যাদি ইতিহাস নির্ভর সাক্ষাৎকার ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেন। ‘ভয়েসেস ফরম চেরনোবিল’ যা ১৯৮৬ এ চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লির দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক জঞ্জাল অপসারণের কাজে নিয়েজিত কর্মীদের ভয়াবহ বর্ণনার সংকলন।
সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচের ইতিহাস ভিত্তিক বই ‘জিংকি বয়েস:সোভিয়েত ভয়েস ফ্রম দ্য আফগানিস্তান ওয়ার’। এই বইয়ের তথ্য সংগ্রহ জন্য আলেক্সিয়েভিচ ৪ বছর ধরে সারাদেশ ভ্রমণ করেন আফগান যুদ্ধের ভিকটিমদের মা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিলিত হন। তিনি আফগানিস্তানের ওয়ার জোনে সফর করেন। এই বই প্রকাশিত হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তাঁর বইটি প্রশংসিত হলেও অন্যদিকে, সামরিক ও কম্যুনিস্ট পেপারগুলো আলেক্সিয়েভিচকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করেনি।
‘দ্য লাস্ট উইটনেস: দ্য বুক অব আনচাইল্ড লাইক স্টোরিস’ যুদ্ধের সময়ে শিশুদের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা বিধৃত হয়েছে। নারী ও শিশুদের দৃষ্টিতে যুদ্ধের ভয়াবহতা এই দুটো বইয়ে সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ তুলে ধরেছেন। ১৯৯৩ সালে তাঁর লেখা ‘এনচানটেড উইথ ডেথ’ প্রকাশিত হয়, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে আত্মহত্যার চেষ্টা করা সম্পর্কে উপস্থাপিত হয়েছে। কম্যুনিস্ট ভাবাদর্শে চালিত বহুমানুষ নতুন বিধানকে মেনে নিতে অসমর্থ হওয়ার ইতিবৃত্ত এই বইয়ে সোয়েতলানা তুলে ধরেন। নিজের ওয়েবসাইটে আলেক্সিয়েভিচ সাংবাদিকতায় তার অভিযাত্রার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, ‘আমি এমন একটি ধরন খুঁজেছি, যেখানে মানুষ নিজেই নিজের কথা বলবে।’
আগামী বছর প্রকাশিতব্য একটি বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি মানুষের কাছে সমাজবাদের কথা জানতে চাই না। জানতে চাই তাদের ভালোবাসার কথা, ঈর্ষার কথা, শৈশব-বার্ধ্যক্যের দিনগুলোর কথা। সঙ্গীত, নৃত্য আর চুল বাঁধার কায়দার কথা। বিচ্ছিন্ন এইসব কথামালা বিলুপ্ত এক জীবন পথের বিবরণ দেয়। ভয়াবহ বিপর্যয়ের একটি ঘটনাকে এক কাঠামোতে নিয়ে আসার, একটি গল্প বলার এটাই একমাত্র পথ।’
যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, চীনসহ ১৯টি দেশে আলেক্সিয়েভিচের বই প্রকাশিত হয়েছে, অনূদিত হয়েছে। আর এ কারণেই সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ ২০১৫ এ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান।
সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ তথ্যভিতিক ইতিহাস নির্ভর নন ফিকশন উপহার দিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যকে । সাহসিকতা ও কষ্ট ক্লেশের ফসলই ২০১৫ এ তাঁর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। সাহিত্যকর্মের জন্য বিশ্ব সাহিত্যঙ্গনে আলেক্সিয়েভিচ চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।
আরও পড়ুন: নির্বাচিত নবীনের কবিতা