আজ ৯ সেপ্টেম্বর। আজ ফিরোজা বেগমের প্রয়াণ দিবস। ফিরোজা বেগম চেলে গেছেন সম্রাজ্ঞীর মতো, পড়ে আছে সিংহাসন এবং ‘শূন্য আজি গুলবাগিচা যায় কেঁদে দখিন হাওয়া।’ ফিরোজা বেগম সেই ক্ষণজন্মা প্রতিভা যার হাতে নজরুল সঙ্গীতের সোনালি পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। প্রত্যাবৃত্ত জোয়ারের মতো আবারও জেগে উঠেছে নজরুলের গান।
শিল্পীজীবনে ফিরোজা বেগম একটি অঘোষিত প্রতিষ্ঠানের নাম। সঙ্গীত হচ্ছে সাধনার বিষয়। সেই সাধনা ও অধ্যাবসায়ের মূর্ত প্রতীক ফিরোজা বেগম। তিনি বছরের পর বছর নজরুলসঙ্গীতের সাধনা করেছেন অক্লান্ত শ্রমে ও নিবিড় ভালোবাসায়। এসেছে বহু বাধা। তিনি জয় করেছেন সেসব। কেবল তারপরই এসেছে সোনালি সাফল্য। সঙ্গীতের জন্য দরকার বিধাতাপ্রদত্ত সুরেলা কণ্ঠ। প্রিন্সেস ডায়নার যেমন রূপের ঝলক, নায়িকা মধুবালার যেমন সৌন্দর্যের মায়ামাধুরী, মাইকেল জ্যাকসনের যেমন নাচের ক্ষমতা, মেঘনার যেমন প্রাণের জোয়ার—তেমনি ফিরোজা বেগমের কণ্ঠের জোর। এসবই বিধাতাপ্রদত্ত। ফিরোজা বেগম বিধাতা প্রদত্ত সুরের সাম্রাজ্য কণ্ঠে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। নিজেই একটি সুর-সাম্রাজ্যের নাম। ফিরোজা বেগমের কণ্ঠ মানেই সুরের এক বিস্তারিত ভুবন।
সঙ্গীত হচ্ছে শুদ্ধ সুরেলা উচ্চারণের আর্ট। একজন সঙ্গীতশিল্পীর অন্যতম অপরিহার্য় যোগ্যতা হচ্ছে বিশদ্ধ উচ্চারণ-ক্ষমতা। উচ্চারণ শুদ্ধ না হলে তার পক্ষে গুণী সঙ্গীতশিল্পী হওয়া সম্ভব নয়। ফিরোজা বেগম শুদ্ধ উচ্চারণের মডেল কণ্ঠ। নজরুলের গান যথাযথভাবে গাইতে দরকার সবধরনের শব্দ শুদ্ধভাবে এবং সঠিক ব্যঞ্জনায় গাওয়ার ক্ষমতা। খুব কম সংখ্যক শিল্পীরই এই ক্ষমতা থাকে। ফিরোজা বেগম এক্ষেত্রেও অতুলনীয় সক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তিনি গান গাইবার সময় গানের প্রতিটি শব্দকে তার নিজস্ব চরিত্র্যে শুদ্ধভাবে এবং তাদের সাংকেতিক ও সাংগীতিক অর্থ-ব্যঞ্জনার অনুকূলে উচ্চারণ করেছেন।
ফিরোজা বেগমের অতুলনীয় কণ্ঠশিল্পী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে, শব্দের ভেতরের শক্তি সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার ধারণা এবং গান গাইবার সময় শব্দের সেই শক্তিকে প্রস্ফটিত করে তোলা। বস্তুর ভেতরে গতি ও মহাকর্ষ থাকার মতো শব্দের ভেতরে গতি আছে, নৃত্য আছে, ছন্দ আছে, ধ্বনি আছে,ভর আছে, বল আছে, বেদনা আছে, উচ্ছ্বলতা আছে, ক্রীড়া আছে, মহাকর্ষ আছে, মাধুর্য আছে, ঘ্রাণ আছে, স্বাদ আছে, মেলোডি আছে, সাংকেতিকতা আছে, ব্যঞ্জনা আছে। শব্দের এই শক্তি ও সম্পদ এবং সে অনুসারে শব্দের সঙ্গে শব্দের পার্থক্য ও মিল বিষয়ে যে-আবৃত্তিশিল্পী এবং যে-কণ্ঠশিল্পী যত বেশি সজাগ ও সক্রিয় থাকেন, তার আবৃত্তি ও গায়কী তত বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফিরোজা বেগম এক্ষেত্রে প্রায় ষোলআনা সফল এক শব্দশিল্পী। তাঁর দরদভারা সুরেলা উচ্চারণ উন্নীত হয় সুরের নেশায়—বাণীর মায়ায়। এই যাদুময়তা—এই মধুমাধরী-এই মাদকতা—সৃষ্টিতে ফিরোজা বেগমের জুড়ি নেই। একারণেই তিনি সুরসম্রাজ্ঞী বা মেলোডি কুঈন।
বিধাতার মজুদ রেজিস্টারে সম্পদের কোনো অভাব না থাকলেও তাঁর এলোটমেন্ট রেজিস্টার কোনোভাবেই সবার ইচ্ছা-পূরণের খাতা নয় । জয় তু ফিরোজা বেগম! জয় তু নজরুলসঙ্গীত !
ফিরোজা বেগমের আরেকটি দান হচ্ছে গানে প্রয়োজনীয় আবেগ ঢেলে প্রাণ সৃষ্টি করা। তিনি গান গাইবার সময় বিধাতা প্রদত্ত কণ্ঠসুধা, প্রশিক্ষণলব্ধ কৌশল প্রয়োগ করতেন যেটি অন্যসব শিল্পীরাও করে থাকেন। কিন্তু সে-সবের সাথে তিনি আরেকটি জিনিস মিশিয়ে দিতেন গানের কথায়, সুরে ও ব্যঞ্জনায়– তা হচ্ছে নিজের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার দরদ ও আবেগ। ফলে তাঁর কণ্ঠের গান সুর ও বাণীর মহামিলন এবং তার সাথে বাড়তি যোগ আবেগ। তাঁর কণ্ঠের গান শোনা মানে হচ্ছে- আবেগ-অনুভূতির ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত কোনোকিছুর অশরীরী স্পর্শ লাভ করা। ফিরোজা বেগম বুকভরা ভালোবাসা, মনভরা সংবেদনশীলতা ও হৃদয়ভরা বেদনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রাণ সৃষ্টি করাটাই একজন কণ্ঠশিল্পীর সর্বোচ্চ দায়িত্ব এবং সাফল্য। এই পয়েন্টেও ফিরোজা বেগম অন্যদের নিকট একটি প্রতিষ্ঠানের মতো।
ফিরোজা বেগমের সবচেয়ে বড়সম্পদ ছিল বিধাতা প্রদত্ত একটি অতুলনীয়ভাবে উন্নত কণ্ঠ। নারীর কণ্ঠ যতখানি ভরাট ও ওজনদার হওয়া সম্ভব ও সঙ্গত, ফিরোজা বেগমের কণ্ঠ ছিল ততেখানি ভরাট ও ওজনদার। তার সাথে তাঁর কণ্ঠ ছিল প্রবল ও গতিশীল। একইসাথে তা ছিল অত্যন্ত মিষ্টি ও মাধুর্যময়। তিনি সুসাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি যতদিন গেয়েছেন, কোনো রোগবালাই তাঁর কণ্ঠকে কাবু করতে পারেনি। তাঁর কোনো শ্বাসকষ্ট ছিল না; উচ্চারণে আড়ষ্ঠতা ছিল না; তিনি ইচ্ছামতো এবং গানের প্রয়োজন মাফিক কণ্ঠকে উচ্চগ্রামে ওঠাতে এবং নিম্নস্কেলে নামাতে পারতেন। তাঁর কণ্ঠ এতটাই প্রবল, গভীর, গতিশীল, নমনীয় ও সুরেলা ছিল যে তিনি কণ্ঠকে কখনো মাধবকুণ্ডের বর্ষার ঝর্ণাধারায়, কখনো আশ্বিনের শান্তস্রোতা যমুনায়, কখনোবা জোয়ারের মেঘনায় রূপান্তরিত করতে পারতেন। কখনো তা পূর্ণিমারাতের জোয়ারে প্লাবিত কল-কল্লোলিত সুন্দরবন হয়ে উঠতো, কখনো হয়ে যেতো জোছনার উত্তাল সমুদ্র। কোনো অবস্থাতেই তাঁর দম ফরাতো না; কোনো অবস্থাতেই তাঁর কন্ঠের মাধুর্য শুকিয়ে আসতো না। বাতাসের গুঞ্জরণ, শিশুর চঞ্চলতা, হরিণীর চপলতা, পাতার মর্মর, ঝর্ণার উচ্ছ্বলতা, সমুদ্রের গভীরতা, জোয়ারের প্রবলতা, বেহালার কান্না, বাঁশের বাঁশির মাধুর্য, হারমোনিয়ামের সুরেলা স্রোত, নৃত্যের ছন্দ, তবলার তাল—তাঁর কণ্ঠে সুসমবেত হয়েছিল অসম্ভবপ্রায় অনন্যতায়। বৈচিত্র্যে, পরিমাণে ও গভীরতায় তাঁর কণ্ঠসম্পদ অফুরন্ত-অতল ছিল বলেই তিনি সত্যিকার অর্থেই মেলোডি কুঈন ছিলেন।
ফিরোজা বেগম প্রমিত সুরের শিল্পী। বাণীর সর্বোচ্চ প্রকাশ যতখানি সুরলীলা দাবি করে, তিনি ততখানি সুরে গাইতেন। তাঁর গায়কীতে সুরের অনটন ছিল না কখনোই। আবার তিনি ওস্তাদী আতিশয্যকেও এড়িয়ে চলেছেন। এমন শিল্পী আছেন যারা নজরুলের একটি গান (এমনকি কাব্যগীতিও) গাইতে গিয়ে বেশি বেশি লোভী হয়ে ওঠেন। এক ধরনের বাহাদূরী বা অনন্যতা দেখানোর লোভ পেয়ে বসে তাদের। গানের সুর নিয়ে এত বেশি কণ্ঠ-কসরৎ করেন যে গানের আসল মাধুর্যটাই নষ্ট হয়ে যায়। মনে হয় তারা যেন সুরের সঙ্গে কুস্তি-লড়াই করেন। আবার কিছু শিল্পী আছেন যারা নজরুলের একটি ক্লাসিকাল ধাঁচের নিয়ন্ত্রিত সুরের গানকেও লোকগীতি বানিয়ে ফেলেন। ফিরোজা বেগম এই উভয়বিধ অযোগ্যতাকেই অতিক্রম/জয় করতে পেরেছিলেন।
ফিরোজা বেগম উদাত্ত কণ্ঠের অধিকারী। বিস্ময়কর ব্যাপার এইযে ফিরোজা বেগম প্রমিত সুরের শিল্পী হয়েও একইসঙ্গে উদাত্তকণ্ঠের শিল্পী। তাঁর কণ্ঠ সুরেলা, প্রবল, গভীর এবং খোলা। তিনি সুরের বাঁধন কণ্ঠে নিয়েই গলা ছেড়ে গান গেয়েছেন। আমাদেও দেশের সঙ্গীতের আদি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে—আমাদেও গান মানেই খোলা গলার গান। ঘাটে-মাঠে-নদীতে-বাথরুমে-যাত্রাপালায় সর্বত্র এদেশের মানুষ গলা ছেড়ে গান গাইতে ভালোবাসে। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, আলকাপ, যাত্রাপালা—সবই মূলতঃ খোলা গলার গান।ফিরোজা বেগমও খোলা গলার গানের শিল্পী। তিনি গান গেঢেছেন জোয়ারের প্রবাহের মতো গলা খুলে দিয়ে। কিন্তু কণ্ঠের পর্যাপ্ত অনুশীলন ও সুরের ওপর সবখানি দখল থাকায় তাঁর খোলা গলার গানও প্রমিত সুরেরগান হয়ে উঠেছে। এটি তাঁর গানের ও গায়কীর একইসঙ্গে সফল ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অন্যতম প্রধান কারণ।
ফিরোজা বেগমের সম্পর্কে একটি মৃদু অনুযোগ শোনা যায় যে তিনি তাঁর গানের কোনো শিষ্য বা উত্তরাধিকার তৈরি করতে পারেননি। বা রেখে যাননি। আমি বলি অনুযোগটি তথ্যনির্ভর বটে, তবে একইসঙ্গে সেটি এক ধরনের অজ্ঞতারও ফসল। ফিরোজা বেগম সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী ছিলেন । তাঁর মৃত্যুতে খালি হয়ে গেছে সিংহাসন। সেই সিংহাসনে বসার মতো যোগ্য কেউ নেই। তিনি চেষ্টা করলেও তাঁর মতো আরেকজন সম্রাজ্ঞী সম্রাট তৈরি করে যেতে পারতেন না। তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী নগদানগদী তৈরী হওয়ার কথা নয়। ক্লিওপেট্রার যোগ্য উত্তরসুরী কে ছিল? কে ছিল সম্রাটের আকবরের যোগ্য উত্তরসূরি? কে হতে পেরেছেন মুহম্মদ রফির কিংবা মেহেদি হাসানের যোগ্য শিষ্য? কিংবা উত্তম কুমারের যোগ্য অনুসারীইবা কে হয়েছে? আবদুল আলীমও দুবার জন্মগ্রহণ করেন না। ফিরোজা বেগমও তাই। বিধাতার মজুদ রেজিস্টারে সম্পদের কোনো অভাব না থাকলেও তাঁর এলোটমেন্ট রেজিস্টার কোনোভাবেই সবার ইচ্ছা-পূরণের খাতা নয় । জয় তু ফিরোজা বেগম! জয় তু নজরুলসঙ্গীত !