সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে এক বালকের কণ্ঠে বলেছিলেন ‘বাবা স্বাধীনতা কত দূর?’ সন্তানের প্রশ্নে ওই বাবা কোনো উত্তর দিতে পারেননি। সেই অক্ষমতা ’৪৭-এর দেশভাগের পটভূমিতে রেডক্লিফ-রেখার ভেতরে আজও জাজ্বল্যমান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যে স্বাধীনতাকে জেনেছিলাম—সেও আজ দূর মরীচিকা!
বাংলায় এই স্বাধীনতা হোঁচট খেয়েছে বারবার। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯১১-তে আবার তা বাতিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭-এর ভারতবর্ষ ভাগ এবং ১৯৭১-এ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিল একটি অখণ্ড বাংলার বিভক্তির মধ্য দিয়ে। সেই মুক্তির স্বাদ নিয়ে পৃথিবীর বুকে নতুন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের আপামর মানুষ উঠে দাঁড়াতে চাইল আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীকারের স্বপ্নে। অথচ এ বিজয়ের প্রস্তুতিপর্ব ছিল দীর্ঘ, রক্তাক্ত আর কণ্টকময়। শুধু ধর্ম দিয়ে গঠিত রাষ্ট্র বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। আচার-প্রথা-সংস্কৃতির বৈপরীত্যে তাই বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আর সেই সত্তায় প্রথম আঘাত আসে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির মনন ও মেজাজের প্রতীক রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণার ভেতরে তাকে আরও স্পষ্ট করা হলো। সেই তখন বাঙালি জ্বলে ওঠে দীপ্র উচ্চারণে—‘যতক্ষণ তোমার বাসায়/পোষা ছিলেম/শরীর উষ্ণ ছিল,/তারপর মাটিতে পা দিতেই/ আগুন আগুন।/পথে বেরোতে/আততায়ী নিল পিছু।/ ……./পাড়ি সেরে শেষে দেখি/মাথার উপরে/সেই সনাতন আকাশ,/চারদিকে শুনি/সেই নাম বাতাসে/চিরায়ু।/মেঘে মেঘে বেলা/ যায় না,/তাকে ঘিরে ঘুরি আমরাই/যত পরমাণু।’
আজ চল্লিশোত্তীর্ণ সময়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখি, আমার জন্মলগ্নের ওই বিজয় উৎসব কত ম্রিয়মান, বিষণ্ন, এমনকি বিপন্নও বটে। আর তাই লেখা হলো ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘হে লোকসভ্যতা’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’, ‘কালো কালো মেহনতী পাখি’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’র মতো কবিতাগ্রন্থ। স্বাধীনতার মৌলিক শর্ত পূরণে কবি লিখলেন অবশেষে ‘ভাত দে হারামজাদা/নইলে মানচিত্র ছিঁড়ে খাবো’। আর আজ ‘নিজ বাসভূমে’, ‘বন্দী শিবির থেকে’, ‘হুলিয়া’ কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতারের গণসংগীত ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ। ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘স্টপ জেনোসাইড’ ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ‘সংগ্রাম’ যে উত্তাপ ছড়িয়েছিল জনজীবনে তা থিতিয়ে আসে ‘চাকভুম চাকভুম চাঁদনী রাতে বলবো কথা তোমার সাথে’র মতো ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ ও সর্বোপরি রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল ক্ষেত্রে হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে। তবু আশা এসে বাঁধে ঘর। জেগে ওঠে ‘নূরুল দিনের সারা জীবন’। এই বদ্বীপে ছড়ানো-ছিটানো যুদ্ধস্মৃতির ভেতরে আমার স্বাধীনতা আগামীর পথ খোঁজে—‘আজ যে আঙুলগুলো আমি মাটির ভেতরে পুঁতে রেখে যাচ্ছি,/একদিন তার নেশায় মাতাল হবে ভবিষ্যতের বাংলা আমার।’
তারপরেও ’৭১-এর সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হল, সেই বাংলাদেশে সাধারণ গণমানুষের জীবনকে সরল একরৈখিক রেখায় বিন্যস্ত করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। কেননা শতাব্দী সংক্রান্তির অস্থিরতা, বিশ্বপুঁজিবাদ, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন; পাশাপাশি দেশীয় রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অন্তর্চাপ রয়েই গেল দৈশিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে। ফলে জনজীবনের বিচিত্র জটিল ও বহুভঙ্গিম আবর্ত-সংঘর্ষ, গতি ও সংগ্রামের অভিঘাতে স্বাধীনতার সার্বিক অর্জন ধুলিস্যাৎ হতে থাকে। আর তাই জনমানুষের জীবনভাবনার বৈচিত্র্য, ব্যক্তিগত অভিরুচি, আদর্শিক চিন্তাচেতনা, সমাজ ও সময়ের দ্বন্দ্বলালিত শিল্প-অন্বেষা প্রভৃতির সম্মিলন আমাদের চেতনা ও প্রকরণকে করে তুলেছে রক্তাক্ত, জটিল, ক্ষুব্ধ অথচ জীবন্ময়।
ওই পটভূমিতে আমার স্বাধীনতাকে লকলকিয়ে বেড়ে উঠতে দেখি নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে—’৬৯-কে উপলব্ধি করি আমার তারুণ্যের সেই উত্তাল উদ্যমে। কিন্তু হায়, একদিন সেখানেও হারাতে থাকে গণমানুষের প্রাপ্তি আর চাওয়া-পাওয়া! নগরীর শোভাবর্ধন, প্রতিনিয়ত মহাসড়কের উন্নয়ন আর কাগুজে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ভেতরে আমার স্বাধীনতা খাবি খায়। আনাজের ঝুড়িতে বেড়ে যায় কেবলি খুচরো আধুলির হিশেবনিকেষ আর বছর বছর দুর্বৃত্তায়ন চলে বাড়ি ভাড়া নিয়ে। ‘এ যেন মুখ বুজে শুশুকের শবযাত্রা!’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম হারায় তার খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার মৌলিক উপকরণ। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশ, নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ গতিহারা। বাংলার কৃষক এখন ভূমিহীন বর্গাচাষী। মুঠো থেকে আলগা হয় একমুঠো মাটি। জীবন ও জীবিকা তাকে নিয়ে এসেছে পেশা পরিবর্তনের বিচিত্র পথে। এভাবেই লেখা হয়ে যায় কাব্য ‘নদীহারা মানুষের কথা’ আর ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’ কিংবা ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’-এর মতো উপন্যাস।
বাংলাদেশের আপামর মানুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধীনতার যে বীজমন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করেছিল তার বিনাশ একটু একটু করে ঘটে চলেছে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে। যখন দেখি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেই দানা বাঁধে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্রমবিলীয়মান রূপ, স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং অপারেশন থিয়েটারে কাটাছেঁড়ার মতো ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে যে যার মতো সংবিধানকে করলো ক্ষতবিক্ষত। অথচ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বলি হতে হলো ধর্মান্ধ মুসলমান নামের নরপিশাচদের হাতে সংখ্যালঘু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর সাথে সাথে উদার মুক্তমনা মুসলমান সম্প্রদায়কেও। তাই বুঝি হত্যা করা হলো আমাদের সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। পাশাপাশি নিরীহ, খেটে খাওয়া ধর্মপ্রাণ মুসলমান, তারাও রেহাই পেল না হানাদার বাহিনীর হাত থেকে। তেমনি একজন পটুয়াখালির জোবেদা খাতুন। স্বামীকে হারিয়ে তিনি হলেন যুদ্ধশিশুর মাতা। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের তাঁর স্বীকৃতি মেলেনি। তাঁর ভাষাতেই বলা যাক—‘ মুক্তিযুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছি। শিকার হয়েছি পাশবিক নির্যাতনের। গর্ভে ধারণ করেছি যুদ্ধ সন্তান। এত আত্মত্যাগের পর পেয়েছি প্রবঞ্চনা। আমি এখন শয্যাশায়ী। মৃত্যুর পর আর কী হবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে।’ (ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪, বিজয় দিবস সংখ্যা/দৈনিক ইত্তেফাক)
সুরবালা সিং, রহিমা বেওয়া, প্রভা রাণী মালাকার কিংবা খুলনার উন্মাদিনী গুরুদাসী—এসব বীরঙ্গনার আজ আর কিছুই চাওয়ার নেই। রাষ্ট্রের স্বীকৃতি তাঁদের জোটেনি কপালে অথবা রাষ্ট্র তাঁদের দেখতে চায়নি, যখন রাষ্ট্রই গোপন পথে বিক্রি করেছে চড়া দামে কেনা জনতার স্বাধীনতাকে মুখোশধারী মুক্তিযোদ্ধার কাছে। অথচ আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা কী অসহ্য যন্ত্রণা, দুর্গম পাহাড়সম বাধা আর হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতায় শত্রুর মোকাবেলা করেছে পথে-প্রান্তরে। রণাঙ্গন থেকে লেখা সেসব চিঠির ভেতরে সেই আর্তনাদ শুনতে পাই— ‘মা, তুমি আজ কোথায় জানি না। তোমার মতো শত শত মায়ের চোখের জল মুছে ফেলার জন্য বাংলার বুকে জন্ম নিয়েছে লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। আমি যদি মরে যাই তুমি দুঃখ কোরো না, মা। তোমার জন্য আমার যোদ্ধাজীবনের ডায়েরি রেখে গেলাম আর রেখে গেলাম লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। তারা সবাই তোমার ছেলে। আজ হাসপাতালে শুয়ে তোমার স্নেহমাখা মুখখানি বারবার মনে পড়ছে। আমার ডায়েরিটা তোমার হাতে গেলে তোমার সকল দুঃখ দূর হয়ে যাবে। দেখবে, তোমার ছেলে শত্রুকে পেছনে রেখে কোনো দিন পালায়নি।’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র থেকে/একাত্তরের চিঠি, প্রথমা প্রকাশিত)
‘নেবে স্বাধীনতা?— নাও, অবশেষে তোমাকে দিলাম/প্রগাঢ়বিষাদ, জীবনের স্পষ্ট মানে, আধুনিক/মানুষের ব্যর্থতার বোধ: অন্ধকার, আর্তনাদ,/গভীর গহ্বর; চতুর্দিকে ভারী বুটের আওয়াজ;/অভুত্থান, রক্তপাত, যুদ্ধ: মূল্যবোধের কবর।’ তবু আমার স্বাধীনতা মাথা নোয়াবার নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধার শাণিত অস্ত্রে যে শত্রু-পরাজয় গাথা, তাকে স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে। আমার স্বাধীনতা জেগে থাকে প্রাণের স্পন্দনে। ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, জারি-সারি, হাছন-লালন—এই সংস্কৃতির ভেতরে আমার স্বাধীনতা তার জায়মান সুধা খুঁজে নেয়। জাঁ জ্যাক রুশোর ভাষায়, ‘মানুষ জন্ম নেয় স্বাধীন ভাবে, কিন্তু সে সর্বত্র শৃঙ্খলিত।’ সেই শেকল-ব্যুহ ভেদ করে আমার স্বাধীনতা এখনো প্রাণভরে পৃথিবী দেখে, ‘যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’। তাই বুঝি ’৭১-এ রণাঙ্গন থেকে লেখা অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠিগুলো হয়ে ওঠে আমার স্বাধীনতার অমোঘ শক্তি ‘একাত্তরের এলিজি’—‘এভাবেই লাল রক্তের প্রবহমানতা গড়িয়ে গড়িয়ে মিশে গেল দুর্বা ঘাসে। সবুজের সমারোহে জাগ্রত হল পুব আকাশে সূর্যের লাল আভা। ‘আজাদ’—আজাদী মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গেল আমাদের, একাত্তরের স্বাধীনতাকে পৌঁছে দিল জনতার বিজয়মঞ্চে। ‘বেতিয়ারা’ যে শোক রচনা করেছে এই নভেম্বরে, তাকে শিরোনামহীন শ্লোকে গেঁথে দেই তোমার স্বরযন্ত্রে— এভাবেই গীত হবে একদিন আমাদের জন্মের ইতিহাস— ‘প্রথম কান্না’। ‘কুয়াশায় নদীর জল ঝলকায়’— তবু শাণিত রণক্ষেত্রের মারণাস্ত্র! বেপথু যুবক ছাত্র কিষাণ অধ্যাপক— আম জনতার প্রফুল্ল চোখে একটাই মানচিত্র আঁকা— বর্বর সভ্যতার অপর পিঠে জেগে ওঠে ইতিহাসের আরেক নাম আমার বাংলাদেশ।”