এক.
দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলো সাহিত্যচর্চার প্লাটফর্ম হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশের সুযোগ দিয়ে আসছে। এতে যেমন প্রবীণরা লিখছেন, তেমনি লেখার সুযোগ পাচ্ছেন নবীনরাও। কাজেই নবীন-প্রবীণের যে সেতুবন্ধন স্থাপন—তা বহু আগেই সাহিত্য সাময়িকীগুলো করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে দশ-বারোটি দৈনিক নিয়মিতভাবে সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করে থাকে। আর এতে প্রচুর লেখক লেখা প্রকাশের সুযোগ পান।
প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো তরুণ সাহিত্যকর্মীর প্রথম লেখাটিই হয়তো প্রকাশিত হচ্ছে। বেশির ভাগ পত্রিকারই সাহিত্যপাতাগুলো চার পৃষ্ঠার হয়ে থাকে। ফলে পাতাগুলোয় প্রচুর লেখককের স্থান হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এসব লেখার কতটি মান বজায় রেখে প্রকাশিত হয়েছে—সেটাও বিবেচনার বিষয়। সংখ্যার আধিক্য নয়। সাহিত্যে সংখ্যার হিসাবটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, আমি ২০০ বই লিখলেই যে আমি বড় লেখক, সেটা দাবি করার সুযোগ নেই। কত বই অথবা কতটি লেখা প্রকাশিত হলো সেটা বিবেচনা করা নিতান্তই মূর্খতা। বরং কতটি লেখা গুণগত মানের হলো, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন পিপাসার্ত জেলের কাছে অতল সমুদ্রের সবটুকু জল বৃথা, কেননা লবণের কারণে সেই জল পানযোগ্য নয়। তেমনিভাবে মহাকালের কাছে মানহীন ও বস্তাপচা লেখাগুলো পিপাসার্তের সমুদ্রজলের মতো। কাল এগুলো ছুড়ে ফেলে। আর লেখাগুলো হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। এত কথার প্রয়োজন পড়ল, সেটা বাহুল্যের কারণেই। বাহুল্যটা যেমনটা জাতীয় দৈনিকের সংখ্যায়, তেমনি সাহিত্য সাময়িকীর পাতার সংখ্যাতেও।
বিজ্ঞজনেররা বহু আগেই বলে গিয়েছিলেন যে, বেশি কোনো কিছুই ভালো না। তো চারপাতার সাহিত্য সাময়িকী মানসম্মত লেখা দিয়ে প্রতি সপ্তাহে প্রকাশ করা যে কঠিন কাজ, সেটা স্পষ্ট একটি বিষয়। জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে যে বাণিজ্যিকীকরণের একটা সম্পর্ক আছে, সেটা অস্বীকার করছি না। আবার স্বীকার করে তাদের দোষও দিচ্ছি না। কিন্তু কথা হলো, চারপাতার সাহিত্যপাতা পূর্ণ করতে সাহিত্য সম্পাদককে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেকে হয়তো চাকরি বাঁচানোর জন্য পাতাগুলো ভরাট করেই মুক্তি পেতে চান। কিন্তু পাতাটা সমৃদ্ধ হলো কি না—তার খেয়াল তাদের থাকেই না। এ জন্যেই প্রচুর মানহীন লেখা দৈনিকের পাতাগুলোয় এখন দেখতে পাই। মানহীন লেখা ছাপানোর জন্যে অনুরোধ বা তদবিরও রয়েছে। এমন নানা পরিপ্রেক্ষিতেই এ কথা এখন অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে যে, মান হারাচ্ছে সাহিত্য সাময়িকীগুলো, বাড়ছে লেখক সংখ্যা, আর অজস্র খারাপ লেখার মাঝে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়েছে ভালো লেখাটি। যে লেখাটি পড়ে পাঠক প্রকৃত অর্থেই উপকৃত হবেন, আনন্দিত হবেন কিংবা বলবেন—ইনিই হচ্ছেন লেখক, আর এই হচ্ছে লেখা।
দুই.
দেখতে দেখতে ২০১৬ সালের প্রথম মাসটি আমরা পার করে আসছি। বরাবরের মতো জানুয়ারিতেও আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো দৈনিকের পাতাগুলোয়। এ মাসেও অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এ মাসে প্রায় তিনশটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তবে স্বাভাবিকভাবে এ প্রাচুর্যের মাঝে ভালো লেখা কমই ছিল; সেটা স্বাভাবিক। অনেক লেখা সময়ের অভাবে পড়া সম্ভবও হয়নি। এই মাসে আমরা ভালো কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ পেয়েছি।
২৮ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদে মুহাম্মদ সবুরের ‘গানের ভেতর দিয়ে ভুবনখানি’ প্রবন্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সঙ্গীতের নানা দিক ও রহস্যের উন্মোচন করেছেন, নতুন করে বলেছেন নতুন আঙ্গিকে। তার উপস্থাপন ঢং রচনাটিকে সুখপাঠ্য করে তুলেছে। এ প্রবন্ধের কিছু অংশের পাঠ নেওয়া যাক। মুহাম্মদ সবুর লিখেছেন—‘এই বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে সঙ্গীত। আর বাংলা তো গানের দেশ। সুরের দেশ। সুরের দোলায় দোলে মানুষ। গান নবজাগরণ আনে বাংলায়। ভোরের বেলায় পাখির কণ্ঠে জেগে ওঠা আনন্দ—সেও তো গান। নগরে, গ্রামে পল্লীসঙ্গীত, ভাটিয়ালি, বাউল, ভক্তিগীতি, নগর সংকীর্তন, জারি, সারি, মুর্শিদী, মারফতি, আলকাপ, গম্ভীরা—সে কতো রকমের গানের বাহার এই বাংলাজুড়ে। সুরের মূর্ছনা সবখানে। ফেরিওয়ালার ডাকেও থাকে সুরের ছন্দ। আর এ যুগে প্রযুক্তির বিকাশ সঙ্গীত শ্রোতার সংখ্যা অজস্র গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য গানের শুরুটা বাঙালি জীবনে মায়ের কাছেই। গান গেয়ে শিশুকে ঘুম পাড়ানো, সে রূপকথা যুগ থেকেই শুরু। সঙ্গীতের এক ধরনের উপযোগিতা তো রয়েছেই মানবজীবনে।’
এছাড়া, ১৫ জানুয়ারি সমকালে প্রকাশিত শান্তনু কায়সারের ‘বঙ্গীয় বাস্তবতায় উত্তর-আধুনিকতা’, ২২ জানুয়ারি যায়যায়দিনে প্রকাশিত মোবারক হোসেন খানের ‘অনুরাগে রঞ্জিত ঠুমরি গান’, ২৯ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে লেখা রফিকুজ্জামান রণির ‘মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের কথাকার’ এবং দৈনিক যুগান্তরে আবুল মকসুদের ‘নীল নোট বই’ সিরিজের প্রবন্ধগুলো পাঠকের ভালো লেগেছে বলেই আমাদের ধারণা। গল্পের মধ্যে ৮ জানুয়ারি কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হাবিবুর রহমান আনিসের ‘ফসিল’ ও ২২ জানুয়ারি ইত্তেফাকে প্রকাশিত মোহিত কামালের ‘জ্যোতিঃপ্রভা’ পড়ে পাঠক তৃপ্তি পেতে সক্ষম হবেন। এ মাসে চলনসেই অনেক গল্পই আমরা পেয়েছি।
তিন.
আর কবিতার কথা বলতে গেলে বলতে হয়—বিগত মাসের তুলনায় বেশ কিছু ভালো কবিতা এ মাসে পেয়েছি। তবে, এ সব কবিতার বিচারের ভার নিবিষ্ট পাঠকের হাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
চার.
গল্প ও প্রবন্ধ প্রতি সপ্তাহের সাহিত্য সাময়িকীতে থাকলেও সমালোচনা সাহিত্যের খোঁজ এখন খুবই কম পাওয়া যায়। যদিও বহু আগে সমালোচনা সাহিত্য সম্পর্কে শ্রীশচন্দ্র দাশ বলেছিলেন—‘সত্যিকার সমালোচনা পথভ্রষ্ট সাহিত্যিককে নিয়ন্ত্রণ করিয়া তাঁহাকে দৃষ্টিদান করে এবং সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি শাণিত ও অনুভূতিকে জাগ্রত করে।’ একইসঙ্গে আবদুল মান্নান সৈয়দের কথাও উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘জীবন সম্ভবত বিশৃঙ্খল। শিল্প তাকে শৃঙ্খলা দ্যায়। সাহিত্য তাকে শৃঙ্খলা দ্যায়। সমালোচনাও তাকে শৃঙ্খলা দ্যায়। সমালোচনা হচ্ছে তৃতীয় নির্মাণ। প্রথম নির্মাণ জীবন, যে জীবনের কোনো বিকল্প সম্ভব নয়। দ্বিতীয় নির্মাণ সৃষ্টিকর্ম, যা সরাসরি জীবন থেকে পরিগ্রহণ করে। সমালোচনা তৃতীয় নির্মাণ, কেননা সৃষ্টিকর্ম ও জীবন দুয়ের সঙ্গেই তার বিনিময় চলে। বিনিময়ই তাকে সমাজমনস্ক করে; নির্জন, একাকী, বিভক্তি থাকতে দ্যায় না। সেজন্য এমন সমালোচনা সম্ভব, যা শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের তুল্য বা প্রতিদ্বন্দ্বী।’ এই মূল্যায়নের পরে জাতীয় দৈনিকের সাময়িকীগুলোয় কেন সমালোচনা সাহিত্য প্রকাশিত হচ্ছে না সেটা বিস্ময়ের বিষয়। একইভাবে মুক্তগদ্যেরও প্রকাশ কম হচ্ছে। কিন্তু মুক্তগদ্যও আরও গুরুত্বসহ প্রকাশিত হওয়া উচিত বলে মনে করি।
বই আলোচনাও এখন স্তুতি-নিন্দার পর্যায়ে চলে গেছে। যেন প্রশংসা-নিন্দা করাই হচ্ছে আলোচনা। অথবা আলোচনাই হচ্ছে প্রশংসা-নিন্দা করার জন্য। এ থেকে বের হওয়া দরকার। বের হওয়া যে দরকার, সেটা আগে সম্পাদকদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে পাঠকদেরও। তবেই সুন্দর কিছু প্রত্যাশা করা সম্ভব।