বরাবরই শুক্রবার এলে সাহিত্য পাতার জন্য মুখিয়ে থাকি। কর্মব্যস্তায় সব পড়া হয়ে ওঠে না। অলসতাও দায়ী কিছুটা। তবে যেগুলো মন কাড়ে, দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়, সেগুলো পড়ার চেষ্টা করি। সে পড়ার আলোকেই উঠে আসে এ ক্ষুদ্র আলোচনা।
দেশের প্রথমসারির পত্রিকা থেকে বেছে নেই মাত্র কয়েকটি। অথবা যে দৈনিকগুলোর সাহিত্যপাতায় মানসম্পন্ন লেখা দেখি, সেগুলোই পড়ি। কখনো কখনো অল্প পরিচিত দু’একটি পত্রিকার আলোচনা করতেই হয়। ওই যে বললাম, মন কাড়ে বা দৃষ্টি আকৃষ্ট করে, সে রকম হলে পড়ি।
১৮ নভেম্বর সমকালের ‘কালের খেয়া’র এবারের প্রচ্ছদরচনা ‘ভয়’। এবারের সংখ্যায় ভয়ের গল্প ও প্রবন্ধ প্রাধান্য পেয়েছে। ভয় কী? ভয় কেন? কিসের ভয়? সব ছাপিয়ে ভয়ের চারটি গল্প যেন ভয় নিয়ে আমাদের চিরদিনের কৌতূহলের আরেক জানালা খুলে দিলো। গল্পগুলো লিখেছেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, দ্বিতীয় সৈয়দ হক, সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম ও আহমাদ শামীম।
সুফিয়া কামালকে নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন ফারজানা সিদ্দিকা। শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ নিয়ে লিখেছেন নওশাদ জামিল। রয়েছে নিয়মিত আয়োজন ‘পদাবলি’। এছাড়া বইয়ের ভুবন ও মাহবুব আজীজের ফিকশন ‘কিছুই জানতে চাই না’তো রয়েছেই।
প্রথম আলোতে ‘পুণ্য ও পাপের গীতিকবি লেনার্ড কোহেন’ শিরোনামে লিখেছেন হাসান ফেরদৌস। কবি, গীতিকার ও গায়ক হিসেবে প্রবল জনপ্রিয় লেনার্ড কোহেন। গানে-কবিতায় বারবারই ছড়িয়েছেন বিষাদ। তাঁর মৃত্যু ব্যথিত করেছে অনেককেই। লেখক বলেন, ‘অনন্তকাল নয়, লেনার্ড বেঁচে ছিলেন ৮২ বছর। জন্মেছিলেন কানাডায়, শৈশব কেটেছে ইহুদি বাবা-মায়ের রক্ষণশীল ধর্মীয় আবহে। কঠোর ধর্মপরায়ণ মা চেয়েছিলেন ছেলে হোক তাঁর পিতামহের মতো তালমুদিক পণ্ডিত, কিন্তু লেনার্ড বেছে নিলেন সাহিত্য। কবিতাই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লেট আস কম্পেয়ার মিথলজিস’। প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে, লেনার্ডের বয়স তখন বাইশ। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধ্যাপক লুইস ডুদেক নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে ছেপেছিলেন সেই বই। মোট তেরোটি কবিতার বইয়ের লেখক কোহেন, তাঁর শেষ কবিতাগ্রন্থ, পোয়েমস অ্যান্ড সংস, প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও কোহেন পাননি আর্থিক সাফল্য।’
‘আমাদের সময়ের মনসামঙ্গল’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। প্রচলিত মনসামঙ্গলগুলো সমন্বিত করে দ্য ট্রায়াম্ফ অব দ্য স্নেক গডেস নামে ইংরেজি ভাষায় একটি বই লিখেছেন কায়সার হক। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে বের হওয়া এই বইটি এর মধ্যেই আলোড়ন তুলেছে বিভিন্ন মহলে, হয়ে উঠেছে মনসামঙ্গল-এর নতুন এক সংস্করণ।
মনসামঙ্গল-এর রচয়িতা অনেক। কবি বিজয়গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ লেখেন ১৪৯৪ সালে। ১৪৯৫ সালে বিপ্রদাস লেখেন মনসা-বিজয়। নারায়ণ দেব তিন খণ্ডে সাজানো তাঁর পদ্মপুরাণ লেখেন ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ লেখেন মনসার ভাসান বা মনসামঙ্গল, দ্বিজবংশীদাস ও ষষ্ঠীবর অথবা ওডিশার কবি দ্বারিকাদাসও মনসামঙ্গল রচনা করেন। সাধারণত পয়ার ও ত্রিপদীতে মনসামঙ্গল লেখা হতো।
এবার ‘একটি খুনের বিবরণ’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী। একটি খুনের স্বীকারোক্তি দিয়ে শুরু হয়েছে গল্পটি। গল্পে বলা হয়েছে, ‘স্বীকার করে নিয়েছি আমার যাবতীয় অপরাধের কথা। বলেছি, আমিই খুন করেছি জোহরা খাতুনকে, যার ডাকনাম শিউলি। শিউলিকে আমি খুন করেছি শ্বাস রোধ করে। মুখে কাপড় দিয়ে গলায় গামছার ফাঁস লাগিয়ে তাকে হত্যা করেছি। শরীরটা সম্পূর্ণ নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত দুই হাতে দুই দিক থেকে গামছার ফাঁস টেনে রেখেছি শক্তভাবে।’
জীবনের জটিল হিসাব কষেছেন গল্পকার। ভালোবাসা, ব্যর্থতা মানুষকে অপরাধীও করে দিতে পারে। হত্যার পর এমনই অনুশোচনা হয় প্রত্যেকের। গল্পটি দারুণ লেগেছে। পাঠককে আকৃষ্ট করার মতোই। নিটোলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ঘটনাগুলো।
এছাড়া শিল্প ও সাহিত্য পাতায় শিল্পকলা বিভাগে ‘নবীনের উদ্বোধন’ শিরোনামে লিখেছেন মোস্তফা জামান।
যুগান্তরে মঞ্জু সরকারের ‘টুকু ডাকাতের তেলেসমাতি’ গল্পটি প্রকাশ হয়েছে। আসলে বাস্তব জীবনে এমনই হয়। খারাপ মানুষ ভালো হতে চাইলেও সমাজের মানুষ তাকে ভালো হতে সাহায্য করে না। আর তাই তো গল্পে দেখতে পাই, ‘জেলখেটে বেরুনোর পর ডাকাতি পেশা ছাড়ার প্রমাণ হিসেবে খাজাবাড়ির সামনে দোকান দিয়েছে। মনিহারি বনাম চায়ের দোকান। সাইনবোর্ড নেই দোকানটার, এরপরও ডাকাতের দোকান হিসেবে নামখ্যাতি ছড়িয়েছে এলাকায়। নিজের অন্ধকার অতীত ঢাকতে ধর্মকর্ম ছাড়াও এখন খাজার মাথায় সারাক্ষণ টুপি। দোকানে বসে খদ্দের সেবা করে দিনেরাতে, ঝাপ বন্ধ হলে রাতে দোকানেই ঘুমায়। কিন্তু দোকানদার বলার বদলে লোকজন তাকে দুর্ধর্ষ ডাকাত ভাবে এখনও।’ এছাড়া ‘রেজাউদ্দিন স্টালিন : সময়ের সচেতন কাব্যার্জুন’ শিরোনামে লিখেছেন নিরঞ্জন অধিকারী।
‘পাপড়ি রহমানের গল্পের কেন্দ্র ও ভাষার ব্যবহার’ শিরোনামে লিখেছেন সরদার মাহফুজ। লেখক বলেছেন, ‘এবারের একুশে বইমেলায় চৈতন্য প্রকাশন থেকে প্রকাশ পেয়েছে নব্বইয়ের অন্যতম প্রধান এই গল্পকার পাপড়ি রহমানের ৭ম গল্পগ্রন্থ ‘শহর কিংবা উনশহরের গল্প’। বইটিতে স্থান পেয়েছে ৮টি গল্প। প্রয়াত কথাশিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর তার বইয়ের ফ্ল্যাপে লিখেছেন, ‘পাপড়ি রহমান বরাবরই রিয়েলিস্টিক ইমেজের প্রতি জোর দেন। নানা শ্লোক, মিথ কথকতা তার গল্পে জারিত হয়ে থাকে। তিনি সবদিকেই তাকান এবং পাঠককেও তাকাতে বাধ্য করেন। তিনি আলাদা এক জগতের পিপাসাকাতর লেখক।’
সৈয়দ আবুল মকসুদের সাপ্তাহিক আয়োজন ‘বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’র ৩৪তম পর্ব প্রকাশ হয়েছে। সাহিত্য সংবাদে ড. রকিবুল হাসানের ‘লালন সাঁই পুরস্কার’ পাওয়ার খবর জানানো হয়েছে। আছে কবি মতিন বৈরাগীর ৭০ বছর পূর্তিতে কাব্য আড্ডার খবর।
কবিতা লিখেছেন শফিক আলম মেহেদী। তাঁর কবিতার শিরোনাম ‘অপরাজেয়’। কবি বলেছেন, ‘রাত্রি অনিঃশেষ নয়-/আঁধার গভীর হতে গভীরতর হলেও/ আলোময় ভোরের দিকেই/নিশ্চিত যাত্রা করে।’ ‘বিবাহিত কবিতা’ লিখেছেন জাহিদ সোহাগ। ফারহানা আনন্দময়ী কবিতা লিখেছেন ‘জনৈক সুশীল বলছি’ শিরোনামে। মিজানুর রহমান বেলালের কবিতার শিরোনাম ‘ওম’। ঢাকা লিট ফেস্টে ভিএস নাইপল বিষয়ে লিখেছেন মেজবাহ উদদীন।
কালের কণ্ঠে ঢাকা লিট ফেস্ট নিয়ে বিশেষ আয়োজন ছিল। ভি এস নাইপলকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে লিখেছেন মোহীত উল আলম। লিটারারি ফেস্ট, ঢাকা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য এ বছর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসছেন ২০০১ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভি এস নাইপল এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ এই কলামটি।
লিট ফেস্ট প্রসঙ্গে কাজী আনিস আহমেদ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কালের কণ্ঠকে। ‘বাংলা ভাষার লেখকদের আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছে দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য’শিরোনামে সাক্ষাৎকারটিতে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বনামধন্য লেখকরা কিন্তু প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন; দু-একজন বিরোধিতা করলেও এখন সবাই সমর্থন করছেন। এমন আন্তর্জাতিক উৎসবে হয়তো সবাইকে আমন্ত্রণ করতে পারিনি, কিন্তু প্রতিবছরই চেষ্টা করছি নতুনদের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করতে। বাংলাদেশের তরুণ থেকে প্রথিতযশা—সব লেখকেরই কিছু না কিছু পড়েছি, ব্যক্তিগত জানা তাই অনেকের সঙ্গে।’
লিট ফেস্টের বিরোধিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছোটখাটো অসহযোগিতা তো থাকেই, তবে এখন জানতে হবে যে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়াও দু-একটি বইয়ের অনুবাদ হয়েছে এর আগে। বাংলা একাডেমি কিংবা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আমরা ভাগ করে নিচ্ছি। বাংলাদেশে এত দিন এটা একেবারেই প্রফেশনালি হয়নি। পেশাগতভাবে প্রচুর হওয়া উচিত। অবশ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেছে অনুবাদের কাজ। বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার লেখকদের আন্তর্জাতিক পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই লিট ফেস্টের অন্যতম উদ্দেশ্য।’
‘রেখো মা দাসেরে মনে’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন মাহবুবুল হক শাকিল। একজন ব্লগারের মুক্তচিন্তা এবং সৃষ্ট সমস্যা নিয়ে আবর্তিত হয়েছে গল্পটি। শাকিলের গল্পে একটা আবেদন থাকে বরাবরই। সে আবেদনটা এ গল্পেও লক্ষ্য করা যায়। গল্পের ‘ছবির মতো এই শহরে তাদের জীবন বদলে দেয় একটি ঘটনা। ঘটনা না বলে দুর্ঘটনা বলাটাই শ্রেয়। দুর্ঘটনাটি ঘটে এক শুক্রবারের সন্ধ্যা অতিক্রান্ত সময়ে।’
ঢাকা লিট ফেস্ট নিয়ে ‘আদান-প্রদানে নতুন মাত্রা’ শিরোনামে লিখেছেন হামীম কামরুল হক। লেখক বলেন, ‘ভাষা ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু সাহিত্য অভিন্ন। ভাষা যার যার, সাহিত্য সবার। সাহিত্য ‘সাহিত্যের ভাব’ আনে। মানবিকতাকে এমন একটি মহামিলনের জায়গায় এনে দাঁড়া করায়, যা হয়ে ওঠে সহজ কিন্তু গভীরতায় অগাধ, অতল ও সৌন্দর্যময়। কিন্তু এর জন্য চাই বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের ভেতরের আদান-প্রদান। সেই লক্ষ্যেই ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট।’
অদ্ভুত অভ্যাস বিভাগে ‘অনন্য স্বভাবের সিমবোর্সকা’ শিরোনামে দুলাল আল মনসুর। তিনি ছোটবেলায় কবিতায় বেশ বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ হাজির করতেন হরহামেশাই। এমন কবিতাই নাকি পছন্দ ছিল তাঁর বাবার। তাঁর কোনো কবিতা বাবার পছন্দ হলেই সে কবিতার বিনিময়ে বাবা তাঁকে টাকা দিয়ে সম্মানী দিতেন। স্মরণ বিভাগে ‘বেগম সুফিয়া কামাল’কে স্মরণ করা হয়েছে। তিনি ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া অন্যান্য বিভাগ তো রয়েছেই।
এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক মেঘনা বার্তা পত্রিকার সাহিত্য আয়োজন ‘মেঘনা সাময়িকী’র প্রথম সংখ্যা। এ সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখেছেন সৌম্য সালেক, কবিতা লিখেছেন নির্মলেন্দু গুণ, ফকির ইলিয়াস, ইকবাল পারভেজ, অনিমিক শুভ ও মাহমুদা স্বর্ণা। গাজী মনছুর আজিজের বই ‘একাত্তরের খণ্ডচিত্র’ নিয়ে আলোচনা করেছেন রফিকুজ্জামান রণি।
সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকালে ‘অতঃপর অন্ধকার’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন মাহমুদ নোমান। ‘সৈয়দ হক : ফ্রম দ্য ফার্স্ট লুক’ শিরোনামে সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তারেক মাহমুদ।‘সাহিত্যিক জোচ্চুরি!’ শিরোনামে লিখেছেন কে. কায়েস। আলতাফ পারভেজের বই নিয়ে আলোচনা করেছেন সেলিম শাহনেওয়াজ।
‘চাঁদের আলিঙ্গন’ শিরোনামে হানিফ রাশেদীন, ‘দ্বৈত-অদ্বৈত’ শিরোনামে মাহফুজ রিপন, ‘বাজারি সওদাগর’ শিরোনামে মোকসেদুল ইসলাম, ‘এক নিমিষে’ শিরোনামে রাবেয়া সুলতানা কবিতা লিখেছেন।
খুব বেশি প্রচারিত না হলেও সাহিত্য বিভাগটি মানসম্পন্ন মনে হয়েছে।
মন্তব্য