আগের তুলনায় কৃষি বিষয়ে বাংলাদেশ এগিয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত লক্ষ করলে দেখা যায়, কৃষির অবদান কৃষকদের হাতে রয়েছে। আগের মতো কৃষকরা চাষাবাদ না করে কৃষিবিজ্ঞানের অবদানে ব্যবহার করছে কৃষি সংশ্লিষ্ট সমস্ত কাজে। অন্তত বাংলাদেশে শুরুর দিকে গ্রহণ করা, ব্যবহার করা কিছু কাজ কঠিনবোধ হলেও কৃষিবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কৃষকদের জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। খাদ্য উপাদন থেকে শুরু করে চাষাবাদ সর্বত্রই বিজ্ঞানের স্পর্শ রয়েছে।
তবে বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে কৃষির কৌশল ও বোঝার বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পৃক্ত হওয়া বাকি রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের অজ্ঞতা, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সংরক্ষণে দুর্বলতার কারণে কৃষির অগ্রগতিতে বাধা হচ্ছে। বিশেষ করে সার মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং পুষ্টির ক্ষতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কৃষকরা পিছিয়ে রয়েছে। অবশ্য ব্যবহারবিধি না জানা, দ্রুত গতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার প্রবণতাও এক্ষেত্রে দায়ী করা যায়।
কৃষিতে বিজ্ঞানীদের অবদান অনেক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও সেই অবদানে পুষ্ট। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় কৃষির সঙ্গে যুক্ত করে কৃষি কর্মকাণ্ডকে আধুনিকায়ন করেছেন। কৃষির উপর জ্ঞান লাভ করলে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা যেমন বিজ্ঞানী হতে পারেন, তেমনি কৃষকরাও প্র্যাকটিক্যাল কাজের মধ্যদিয়ে বিজ্ঞানী হতে পারেন। আদি কৃষির উৎপত্তি সাধারণ মানুষের হাতেই। কিন্তু কৃষি বিজ্ঞানে কৃষকরা পিছিয়ে থাকলে কৃষির উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা জলবায়ু, পরিবেশ, মাটি, পানি, উৎপাদন পদ্ধতি এসব বিষয় বিবেচনায় এনে উচ্চতর গবেষণা করছেন। তাদের নিরলস গবেষণার ফলে কৃষিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। আর কৃষকদের এসব প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশের কৃষির সমস্যাগুলো দৃষ্টিগোচরে আনা জরুরি। ফসল উৎপাদনে এ দেশের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে, মাটির পুষ্টি উপাদানের সমস্যা, সার ব্যবস্থাপনা সমস্যা, বন্যা ও খরা সমস্যা, লবণাক্ততা সমস্যা-ইত্যাদি। আর এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা যথেষ্ট অবদান রেখে চলেছেন।
ফসলের বীজ ও নতুন নতুন জাত উন্নয়ন, বীজ সংরক্ষণ, রোগ বালাইয়ের কারণ শনাক্তকরণ, ফসলের পুষ্টিমান বাড়ানো-এ সকল কাজই কৃষি বিজ্ঞানীরা করে থাকেন।
বাংলাদেশের মাটিতে যথেষ্ট পুষ্টির অভাব আমরা দেখতে পাই। ফলে ফসল ভালো হয় না। আর পুষ্টির উপাদান সমস্যার জন্যে মূলত আমরাই দায়ী। মাটির যথাযথ যত্ন আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা বিশেষ করে পলিথিন বা প্লাস্টিক বোতল ফেলে আমরা মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে চলেছি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের আরও জানতে হবে ও কৃষিবিজ্ঞানে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাই সারাদেশে মাটিতে উদ্ভিদের পুষ্টি সমস্যা সমাধানের জন্যে বিজ্ঞানীরা দেশকে ত্রিশটি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে ভাগ করেছেন। কোন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের মাটি কীরূপ এসব বিষয় উদ্ভাবন কৃষিবিজ্ঞানীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এসব অঞ্চলের মাটির ধরন বিবেচনা করে ফসল ফলানোর জন্যে কোন ফসলে কী মাত্রায় সার প্রয়োগ করা হবে সে বিষয়ে কৃষকগণকে নির্দেশনা দেয়া হয়। তেমনিভাবে সার ব্যবস্থাপনায় সুন্দর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পূর্ববর্তী ফসলে যে মাত্রায় সার দেয়া হয়েছে, তা’ বিবেচনা করে পরবর্তী ফসলের জন্যে সারের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কেননা কোন কোন সার নিঃশেষ হয়ে যায় না। মাটির গুণাগুণ বজায় রাখে। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা অজ্ঞতার কারণে মাটির যত্ন যথাযথভাবে নিতে পারে না।
আমরা জানি, বন্যার শেষে ধান চাষের জন্যে বিলম্ব জাত হিসেবে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ব্রিধান ২২ ব্রি ধান ২৩ ব্রিধান-৩৭ এবং ব্রি ধান-৩৮ নামে চারটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া বন্যাকবলিত এলাকার জন্য ব্রি ধান-১১, ব্রি ধান-১২, ব্রি ধান-৫১, ব্রি ধান-৫২ ও ব্রি ধান-৭৯ নামের আরও পাঁচটি জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। এই পাঁচ জাতের ধান পানির নিচে ১০-১৫ দিন টিকে থাকতে পারে কৃষিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বন্যা যেমন কৃষকদের একটি বড় সমস্যা, খরা ও লবণাক্ততা আরও বড় সমস্যা। এজন্য বিজ্ঞানীরা ব্রি ধান৫৬ ব্রি ধান৫৭ নামের খরা সহনশীল ধান উদ্ভাবন করেছেন। উপকূল অঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে চাষের জন্য ব্রি ধান-৪০, ব্রি ধান-৪১, ব্রি ধান-৪৬, ব্রি ধান-৪৭, ব্রি ধান-৫৩, ব্রি ধান-৫৪ ও ব্রি ধান-৫৫ উদ্ভাবন হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাস্তবিক যারা কৃষির সঙ্গে জড়িত তারা অনেক সময় কৃষিক বিষয়ক প্রশিক্ষণগুলো যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারেন না বা সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি জোর দিতে হবে। যেন তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকরাও কৃষিবিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
আমরা জানি, অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে কৃষকেরা নতুন বিষয় আবিষ্কার করে কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। যেমন-ঝিনাইদহের হরিপদ কাপালি হরিধান নামে একটি ধান নির্বাচন করেছেন। কিছু কিছু উদ্ভিদের বিশেষ অঙ্গ বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের বীজ থেকে উৎপন্ন গাছে মাতৃগাছের সকল গুণাগুণ হুবহু পাওয়া যায়। কৃষকগণ কলা, আম, লিচু, কমলা, গোলাপ, চা, ইক্ষু, লেবু ইত্যাদির উৎপাদনে অঙ্গজ প্রজনন ব্যবহার করে থাকেন। ফসলের বীজ ও নতুন নতুন জাত উন্নয়ন, বীজ সংরক্ষণ, রোগ বালাইয়ের কারণ শনাক্তকরণ, ফসলের পুষ্টিমান বাড়ানো-এ সকল কাজই কৃষি বিজ্ঞানীরা করে থাকেন।
তাছাড়া কৃষিবিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত মৎস্য লালন পালন, প্রজনন, উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রেও একদল বিজ্ঞানী অবদান রাখছেন। এ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে গবেষণার জন্যে উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও বিভিন্ন গবেষণা ইন্সটিটিউট রয়েছে। এসব ইন্সটিটিউট ও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী যতটুকু কৃষকদের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন সেভাবে এখনো পৌঁছাতে পারছে না। যদি সর্বস্তরের কৃষকরা এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে তাহলে কৃষিতে আরও উন্নতি লাভ করতে পারবে।
দেশের অঞ্চলভিত্তিক আরও নতুন জাত উদ্ভাবন, কৃষককে ফসলি উৎপাদনে আগ্রহীকরণ, অঞ্চলভিত্তিক কৃষিসেবা প্রদান, বিভিন্ন কৃষি সংস্থার যথাযথ সহযোগিতা এবং কৃষিবিদদের নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষিতে আরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এছাড়া কৃষির যান্ত্রিকীকরণই আরও আধুনিকায়ন করতে হবে।
আমাদের এটা স্বীকার করতেই হবে যে, দেশের উন্নতির জন্যে কৃষিবিদ ও কৃষকরাই বেশি অবদান রেখে চলছেন। কৃষিবিদদের হাতেই সৃষ্টি হচ্ছে ফসলের নতুন জাত কিংবা ফসল উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি। আর হাত পৌঁছে যাচ্ছে প্রান্তিক কৃষকদের হাতে। শুধু ফসল কেন, পাশাপাশি গবাদিপশুর উন্নয়ন, দুধের মান ও পরিমাণ বাড়ানো, মাংসের জন্যে উন্নত জাতের পশুপালন প্রযুক্তি, বিভিন্ন ধরনের মাছের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি খামারের বিভিন্ন প্রকার যান্ত্রিকীকরণ কিংবা কৃষির সব ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ; এসবই কৃষিবিদদের হাতের স্পর্শে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা কৃষকদের পরিশ্রমের ফসল খেয়ে বেঁচে আছি, উজ্জীবিত হই সকলেই। আর এভাবেই ঘুরে দাঁড়ায় এ দেশের মেরুদণ্ডখ্যাত কৃষকের অর্থনৈতিক অবকাঠামো। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার সুবাদে কৃষিবিদরা এ দেশে আজ এক মর্যাদাবান পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃত। সুতরাং বাংলাদেশ যেহেতু কৃষি প্রদান তাই এসমস্ত বিষয়ে কৃষিবিজ্ঞানের জ্ঞানের জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের দেশ ধান উৎপাদনে, সবজি উৎপাদনে বিশেষ অবস্থানে রয়েছি। তাছাড়া মাছ, ছাগল উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছে। আরও আছে আম, আলু, বিভিন্ন ফল।সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হয়, তার ৮৬ শতাংশই হয় আমাদের দেশে। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
তবে আমাদের কৃষকদের কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে। আরও সচেতন করতে হবে কৃষকদের, যেন কৃষিতে আরও সাফল্য আসতে পারে। তবে দু:খের বিষয় যে, একসময় কৃষক যেমন শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হতেন, তেমনি কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু কৃষিবিদরাও সামাজিক অবহেলা তথা অমর্যাদার শিকার হতেন। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির সম্পূর্ণ বিকাশ ও উতকর্ষ ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্যে কৃষকদের গুরুত্ব দিতে হবে, কৃষিকে প্রাধান্য দিতে হবে; কৃষিবিজ্ঞানে কৃষকদের উৎসাহী করতে হবে। তাহলেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে। দেশের অঞ্চলভিত্তিক আরও নতুন জাত উদ্ভাবন, কৃষককে ফসলি উৎপাদনে আগ্রহীকরণ, অঞ্চলভিত্তিক কৃষিসেবা প্রদান, বিভিন্ন কৃষি সংস্থার যথাযথ সহযোগিতা এবং কৃষিবিদদের নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষিতে আরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এছাড়া কৃষির যান্ত্রিকীকরণই আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। এর ফলে সব কৃষিসেবা পৌঁছে যাবে কৃষকের দোরগোড়ায়। উপকূলীয় কৃষিকে গুরুত্ব দিতে হবে, তাহলে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে কয়েক গুণ হারে।