সপ্তাহের একদিন অপেক্ষা করি সাহিত্যপাতার জন্য। নতুন কিছু খুঁজি। কিন্তু সবার ভাবনাই এক। কোনো বৈচিত্র্য নেই। দেশে সম্ভবত অনুবাদকের অভাব। দু’একটা পত্রিকা ছাড়া অনুবাদ খুঁজে পাওয়া যায় না। গল্পের মান নিয়েও সংশয় আছে। গল্পে নতুনত্ব নেই। প্রত্যেকটি গল্পেই কিসের যেন ছায়া। এই গল্পটি ওই গল্পের মতো। এ রকমই একটা গল্প পড়েছিলাম আগে। কেবল এ রকমই মনে হয়। গল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা জাগে না।
বেশির ভাগ প্রবন্ধেও চর্বিতচর্বণ। লেখকের বা কবির নতুন কোনো তত্ত্ব বা তথ্য নেই। নেই গবেষণা। পূর্বসূরিদের অনুসারী হয়ে শুধু বয়ান করে যাওয়া। একঘেয়ে ও একপেশে মনে হয়। জানতে চাই, এমন কিছু যা এখনো জানতে পারিনি। জানতে চাই এমন কিছু, যা নিয়ে এখনো আলোচনা হয়নি। আরও গবেষণা দরকার। আরও চর্চা করা দরকার। পাঠককে আকৃষ্ট করার মতো লেখা কই? মগজে নাড়া দেওয়ার মতো লেখা চাই। শুধু লেখা দিয়ে পাতা ভরলে কী হবে?
বই আলোচনায় চাটুকারিতা বেশি। লেখার মান, সাহিত্যের দাবি, সার্থকতা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই বললেই চলে। একটু তেলবাজি বা চাটুকারিতা। অথবা নিন্দায় আকীর্ণ এসব আলোচনা। কিন্তু কেন? এমন কারও বই নিয়ে আলোচনা করুন- যাকে কখনো দেখেননি। যার সঙ্গে একদিনও কথা হয়নি। শুধু বই পড়েই অনুভূতি ব্যক্ত করুন। তবেই নির্মোহ আলোচনা করতে পারবেন।
ছোটকাগজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ আপনারা। কয়টি কবিতা, কয়টি গল্প, কয়টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো তা-ই লিখলেন। লিখলেন কবিদের নাম। কবিদের দীর্ঘ নামের তালিকা। সবাইকে খুশি করতে চান। অথবা যাকে যাকে ভালোবাসেন তার নাম লিখে দিলেন। বাকিরা প্রমুখ। ছোটকাগজ আলোচনায় তালিকার কী প্রয়োজন? মান সম্পর্কে কথা বলুন। সম্পাদকের বারোটা বাজিয়ে কী লাভ? মান বিচার না করে মান ভাঙানোর সুযোগ খোঁজেন সবাই। ভবিষ্যৎ খুব অন্ধকার। হাতেগোনা কয়েকটি ছোটকাগজ ছাড়া বাকিরা ছাইপাশ। তা-ই মনে হয় আলোচনায়।
সাহিত্য সম্পাদক যদি পাতা ভরার দায়িত্ব নিয়ে থাকেন, তবে ভিন্ন কথা। যদি মনে করেন পত্রিকায় চাকরি করেন, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু নিজেকে যদি সাহিত্যযোদ্ধা ভাবেন, তবে যুদ্ধের ফল অবশ্যই আশাব্যঞ্জক হওয়া চাই।
এবার চোখ ফেরাই মূল কথায়। ২১ অক্টোবর শুক্রবার সাহিত্য সাময়িকীগুলো প্রকাশিত হয়েছে বব ডিলানকে ঘিরেই। উপেক্ষিত হয়েছেন জীবনানন্দ দাশ ও শামসুর রাহমান। জীবনানন্দ দাশ ২২ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া ২৩ অক্টোবর শামসুর রাহমানের ৮৮তম জন্মদিন ছিল। তাঁদের নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা প্রকাশিত হয়নি।
এবারের কালের খেয়ার প্রচ্ছদ আলোচনা ছিলো বব ডিলান। ‘বিশ্ব মানবের গানওলা’ শিরোনামে লিখেছেন বেলাল চৌধুরী, কবির সুমন ও ফজলে হাসান। রয়েছে বব ডিলানের কথামালা, গানের ভাষান্তরসহ অন্তরঙ্গ ভুবন সম্পর্কে বিস্তারিত। ২২ অক্টোবর জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুদিন উপলক্ষে রয়েছে ফারুক মঈনউদ্দীনের বিশেষ নিবন্ধ। কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন ২৩ অক্টোবর। এ উপলক্ষ্যে বিশেষ আয়োজন ঝর্ণা তাঁর আঙুলে। এছাড়া ২৩ অক্টোবর ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে নিয়ে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো আয়োজন ছিল না।
‘ইলিপের নৌকা’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন স্বকৃত নোমান। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে গল্প। তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। বানভাসী ও ত্রাণের জন্য হাহাকার করা মানুষের দিনলিপি। গল্পের চরিত্রে পতনের ওপর পতন। কোনো উত্থানের আভাস নেই।
নিবন্ধ লিখেছেন আফসার আহমদ। রয়েছে পদাবলী ও বইযের ভুবনসহ নিয়মিত বিভাগ। আছে মাহবুব আজীজের ফিকশন ‘মৃত্যুভয় আর জামগাছের ছায়া’(প্রথম পর্ব)।
কালের কণ্ঠে বব ডিলানকে নিয়ে দুটি প্রবন্ধ পাওয়া যায়। রয়েছে বব ডিলানের গান। শামসুর রাহমানকে নিয়ে লিখেছেন হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তবে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে কোনো আয়োজন ছিল না। শুধু স্মরণ করা হয়েছে। জীবনানন্দকে নিয়ে আলোচনা থাকলে ভালো লাগত। এছাড়া দুটি বইয়ের আলোচনা পাওয়া যাবে কালের কণ্ঠে।
জনকণ্ঠেও রয়েছে বব ডিলানকে নিয়ে প্রবন্ধ। কবি কামিনী রায়ের ওপর আলোচনা করেছেন হাবিবুর রহমান স্বপন। রয়েছে গওহর গালিবের গল্প ‘স্বীকারোক্তি’। দুটি বই আলোচনা স্থান পেয়েছে এতে। ছোটকাগজ ‘চাষারু’ নিয়ে লিখেছেন রফিকুজ্জামান রণি। কবিতা লিখেছেন দুলাল সরকার, শাহীন মাহমুদ ও সুমন রায়হান। নিয়মিত আয়োজন ধারাবাহিক নাটক তো রয়েছেই।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই রসিকতা ভালো লাগছে না। মাত্র অর্ধেক পাতা নিয়ে সাহিত্য বিভাগ। প্রয়োজন ছিল না এমন বিভাগের। ওটা বরং বন্ধ করে বিজ্ঞাপন বিভাগ করলে পত্রিকা লাভবান হবে। একটি আলোচনা এবং তিনটি কবিতায় সাজানো হয়েছে তাদের সাহিত্য বিভাগ। এখানে যথারীতি আলোচনার বিষয় বব ডিলান।
যুগান্তরেও বব ডিলানকে নিয়ে প্রবন্ধ রয়েছে। স্রোতাদের জন্য সাহিত্য নিয়ে লিখেছেন মেজবাহ উদদীন। রয়েছে বই আলোচনা, ছোটকাগজ পরিচিতি ও সাহিত্য সংবাদ। তিনটি কবিতাও স্থান পেয়েছে এখানে। শুধু নেই জীবনানন্দ দাশ কিংবা শামসুর রাহমান।
প্রথম আলোও বব ডিলানকে নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। তার সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন মোজাফফর হোসেন। কবিতার অনুবাদ করেছেন সাজ্জাদ শরীফ। নুরুননবী শান্তর গল্পও রয়েছে একটি। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার কিছু নেই বলে মনে হয়।
বিস্তারিত আলোচনার কিছু নেই এ কারণেই বললাম যে, যা কিছু প্রকাশিত হয়েছে, তা চক্ষুগোচর। আমি শুধু দৃষ্টিকটু বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলতে চেয়েছি। কেননা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হয়েছে অনেকদিন। আলোচনাও কম হয়নি তাকে নিয়ে। হয়তো আরো কিছুদিন চলবে। সে চলতে পারে- আপত্তি নেই। যত বেশি আলোচনা হবে, ততই জানা যাবে বব ডিলানের বিষয়ে।
ভোরের কাগজ, মানবকণ্ঠ, যায়যায়দিন, আমাদের সময়, আলোকিত বাংলাদেশ পাঠকরাই দেখে নিন। খুঁজে বের করুন এদের সফলতা ও ব্যর্থতা। সবাই চলছে চর্বিতচর্বণে। প্রথাভাঙার সাহস হয়তো নেই। বা গড়ে ওঠেনি আজও। সাহিত্যের জয় হোক।
মন্তব্য