এক.
নিউজ পোর্টাল পরিবর্তন-এ জাকির তালুকদার তাঁর ‘বইমেলা ২০১৬: প্রশ্ন ও প্রত্যাশা’য় বলেছেন, ‘সাড়ে তিন হাজার বই লেখার মতো প্রতিভাবান লেখক-কবি আমাদের দেশে নেই। ভালো কবিদের মধ্যে আছেন মেরে-কেটে কুড়ি-পঁচিশজন। কথাসাহিত্যে দশ-বারোজন। আর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বই লেখেন এমন মনস্বী মানুষের সংখ্যা আট-দশজন। সবমিলিয়ে গোটা পঞ্চাশেক বই প্রকাশিত হয়, যেগুলো বাংলাদেশের কবি-লেখকদের সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।’ একই লেখায় একটু পর তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানের প্রধান মিডিয়াগুলো যে ধরনের রুচির পরিচয় দেয়, বা যে ধরনের মালকে শিল্প বলে চালাতে চায় বা প্রমোট করতে চায়, তা দেখে মিডিয়ার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা মূর্খামি।’ মিডিয়া হিসেবে এ কথার ধার জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতাকেও যে ছুঁয়ে যায়। বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রচুর বই যে আগেও প্রকাশিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে, এবারও যে হলো ও আগামীতেও যে হবে—এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। জাকির তালুকদারের মতো আমাদের অনেকেরই প্রশ্ন থাকে, প্রকাশিত বইগুলো কতটা মানসম্মত অথবা কতটা পাঠকের অথবা সাহিত্যের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। আর প্রশ্নটা যেহেতু অনেকেরই, সেহেতু এমন পরিস্থিতিতে সাহিত্য সাময়িকীগুলোর ভূমিকা কী হতে পারে সেটাও একটা গুরুত্ববহ বিষয়। আমরা মনে করি সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে যেসব বইয়ের আলোচনা প্রকাশিত হয়, সেসব বই এবারের বইমেলার উল্লেখযোগ্য বই। আমরা সাহিত্যকর্মীরা যেমন একথা মনে করি, তেমনি মনে করেন আপামর পাঠকও। অনেক লাইব্রেরি আছে, অথবা অনেক পাঠক আছেন—যারা দৈনিকের সাহিত্য পাতার বইয়ের খবরগুলো দেখে বই কেনার তালিকা করেন। কাজেই জাতীয় পত্রিকায় কোনো বইয়ের আলোচনা-সমালোচনা বা প্রচ্ছদ দেওয়ার মানেই হচ্ছে, এই বইটি একটু অন্যরকম। এই বইটি নিয়ে পাঠক সমাজ উপকৃত হবে। কাজেই এমন পরিস্থিতিতে সাহিত্য পাতার ওপর পাঠকদের যে কী ভরসা তা অনুমেয়। কিন্তু পাঠকরা তখনই হতাশ হন, ব্যথিত হন, যখন দেখেন তার কেনা বইটি মানসম্মত নয়। এর কারণ সাহিত্য পাতায় হয়তো এমন একটি বইয়ের আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে, যেটি আসলে সাহিত্য মানের বিচারে প্রকাশ করা হয়নি। হয়তো কোনো লেখকবন্ধু অন্য একজন লেখকবন্ধুর বই আলোচনা করে দিয়েছেন। বন্ধু স্বাভাবিকভাবে বন্ধুর গ্রন্থের প্রশ্বস্তি গাইবেন, এমনটিই স্বাভাবিক। সাহিত্য সাময়িকীগুলো এটা ভুলে যায় যে, বই আলোচনা বা সমালোচনা সমালোচকের কাজ। সেই সমালোচক অবশ্যই নির্মোহ হবেন। এমন নির্মোহ সমালোচনা হয়নি বললেই চলে। কারণ আমরা সব আলোচনাতেই দেখি, সবাই কেবল প্রশংসাই করছেন বইয়ের। কোনো ভ্রান্তি নিয়ে কথা বলছেন না। একপক্ষীয় হয়ে পড়েছে আলোচনাগুলো।
দুই.
যুগান্তর সাহিত্য সাময়িকীর ৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ‘রাত্রীশেষ-এর কবি আহসান হাবিব’ শিরোনামে লিখেছেন ময়ূখ চৌধুরী, ‘সাহিত্য জগতে লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক’ নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ, বিশ্বসাহিত্য নিয়ে লিখেছেন মেজবাহ উদ্দিন। এছাড়া, প্রকাশিত হয়েছে মণিপুরী কবিতা, লিটলম্যাগ ‘লেখা’র আলোচনা ও বইমেলায় প্রকাশিত কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ। কিন্তু এ সংখ্যায় কোনো গল্প প্রকাশিত হয়নি। যদিও সাহিত্য সাময়িকীতে আমরা সবসময় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও আলোচনা-সমালোচনা প্রত্যাশা করে থাকি। আবার এই সংখ্যার মেজবাহ উদ্দিনের ‘সরলতার প্রদর্শনী’ শিরোনামের লেখটা দায়সারা হয়েছে। লেখাটি আরও বিস্তৃত হতে পারতো।
প্রথম আলোর সাময়িকী তার চিরাচরিত চরিত্রের মতো বিজ্ঞাপনের বেড়াজাল থেকে এবারও বের হতে পারেনি। অনেকেই বইমেলায় প্রকাশিত ‘শিল্প-সাহিত্য’ পাতাটিকে সাহিত্যপাতা না বলে বিজ্ঞাপন পাতাও বলেছেন। এ সাময়িকী সবসময়ই খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি বাজিয়ে আসছে। যতটুকু না সাহিত্যবিষয়ক লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তার তিন থেকে চারগুণ প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞাপন। এটি হাস্যকর একটি ব্যাপার। জাতীয় দৈনিকগুলো বাণিজ্যিক, এটি আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু সাহিত্য পাতায় এত বিজ্ঞাপন না দিয়ে আলাদা করে দুটো পাতা শুধু বিজ্ঞাপনের জন্যে বাড়ানো যেত। তাহলে হয়তো সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। ১২ ফেব্রুয়ারির শিল্প-সাহিত্যের পাতায় প্রকাশিত হয়েছে ১টি গল্প, ১টি প্রবন্ধ ও দুটি কবিতা। অর্থাৎ সাকুল্যে তিন পৃষ্ঠায় মাত্র ৪ জন লেখক স্থান পেয়েছেন। ধরতে গেলে শিল্প-সাহিত্যের জন্যে যে তিনপাতা রাখা হয়েছে, তার দুপাতাতেই ছিল বিজ্ঞাপন। মাত্র একপাতায় ছিল সাহিত্য! আলোচ্য সংখ্যায় ‘শাহ আবদুল করিমের ঘরানা বাহিরানা ও বাউলিয়ানা’ শিরোনামে লিখেছেন সুমন রহমান। ‘হুইলচেয়ার’ গল্পটি লিখেছেন রবিউল করিম। কবিতা লিখেছেন মোহাম্মদ সাদিক ও শ্যামলী মজুমদার।
ভোরের কাগজ বরাবরই তরুণদের প্রাধান্য দিয়ে আসছে। তাদের এই প্রাধান্য অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আবার তার মানে এই নয় যে, তরুণদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে মানহীন লেখা ছাপতে হবে। যেসব তরুণ মানসম্মত লেখা লিখেন, তাদের লেখাই মূলত ছাপানো উচিত। ২৬ ফেব্রুয়ারির ভোরের কাগজের সাময়িকী পাতায় প্রবন্ধ লিখেছেন আশরাফ উদদীন আহমেদ। সৌম্য সালেকের কবিতা ভাবনা, মোস্তফা কামালসহ আরও বেশ কয়েকজনের বই আলোচনা করা হয়েছে। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে মতিন বৈরাগী, মাসুদ মোস্তাফিজ, সাগর তামিম, নুসরাত নুসিন ও নাজমুল হাসানের। এই সংখ্যায় অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিয়ে আশরাফ উদদীন আহমেদের লেখা প্রবন্ধটি তথ্যবহুল হয়েছে।
সমকালের কালের খেয়া বরাবরই পাঠকপ্রিয়। এ পাঠক প্রিয়তার কারণ কিছু না কিছু ভালো লেখা সবসময়ই থাকে। ১৯ ফেব্রুয়ারির কালের খেয়ার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো হায়াৎ মামুদের লেখা ‘আনিস স্যারের জন্যে, তাঁকে নিয়েই’। এই আনিস স্যার আর কেউ নন, শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান। এ প্রবন্ধে আনিসুজ্জামান সম্পর্কে বলতে গিয়ে হায়াৎ মামুদ তাঁকে নিয়ে যেমন বলেছেন, তেমনি বলেছেন নিজেকে নিয়েও। একারণেই এই লেখাটি গুরুত্ববহ। লেখার শেষ দিকে তিনি লিখেছেন, ‘যেখানে কেউ অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার চিন্তা পণ্ডশ্রম, আমি জানি। অধিকন্তু, আমার স্বভাবে দ্বন্দ্বরস অনুপস্থিত। তাই স্যারের বিষয়ে ভাবতে গেলে আমার একবারও এমন আক্ষেপ মনে আসে না, আমি কেন অধ্যাপক বা লেখক হিসেবে প্রথিতযশা হইনি তাঁর মতো। আমার কেবলই মনে হয়, নির্মল হৃদয় ও সামাজিক সৌজন্য, নির্লোভ স্বভাব ও চারিত্র্যিক দৃঢ়তার যে ছবি আমারই একান্ত সমকালীন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মধ্যে আমি প্রত্যক্ষ করি, তা হয়ত-বা আমার ন্যায় অকিঞ্চনের পক্ষেও অর্জন সম্ভব; কারণ এর জন্য কোনো দৈবী প্রতিভার মুখাপেক্ষী না হলেও চলে, নিজের ঔচিত্যবুদ্ধি, শ্রম ও সাধনায় মনে হয় তার নাগাল পাওয়া যায়।’ আলোচ্য সংখ্যায় জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লিখেছেন ফারুক মঈনুদ্দিন, গল্প লিখেছেন উম্মে মুসলিমা। গদ্য লিখেছেন আহমদ রফিক, হরিশংকর জলদাশ প্রমুখ। কবিতা লিখেছেন নির্মলেন্দু গুণ ও টোকন ঠাকুর। এই বয়সে এসে হুলিয়ার কবি গুণ কি কবিতা লিখেছেন তাও উপলব্ধির বিষয়। তাঁর এই সংখ্যার প্রকাশিত ‘গতকাল একদিন’ কবিতার কিছু অংশের পাঠ নেওয়া যাক।
আমরা দু’জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে
লুকিয়েছিলাম প্রেম,
গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল
বুঝিনি কী হারালাম!
গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে
বাতাস তুলেছে গ্রিবা,
চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার
উজ্জ্বল মধুরিমা ।
গতকাল বড়ো মুখোমুখি ছিল
সারাজীবনের চাওয়া,
চোখের নিমিষে চোখের ভিতরে
চোখের বাহিরে যাওয়া।
কালের কণ্ঠ, যায়যায় দিনও অন্যান্য পত্রিকার মতো আচরণ করেছে। তবে যায়যায় দিনের অঙ্গশয্যা প্রশংসার দাবি রাখে। ইত্তেফাক ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। ইদানীং আমরা এর আভাস পাচ্ছি। জনকণ্ঠও তাই। সবমিলিয়ে বলতে গেলে, পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ছিল সাহিত্যের করুণ সময়। তবে, আমাদের প্রত্যাশা বেশি কিছু নয়। মানসম্মত লেখা প্রকাশ করুক সাহিত্য সাময়িকীগুলো। ভূমিকা রাখুক বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে।