দেশের প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিকগুলো সপ্তাহে একদিন সাহিত্যপাতা বের করে। এ কারণে সপ্তাহ শেষের এই দিনটির অপেক্ষায় থাকেন অনেক কবি-সাহিত্যিক-পাঠক। পাতাগুলো নবীন-প্রবীণ কবি-লেখকের লেখায় সমৃদ্ধ থাকে। আমাদের দেশে নিয়মিত সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে সাহিত্য পাতাগুলোকেই প্রধানতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকে। ফলে অনেকেই সাহিত্ পাতাগুলো দেখেই বোঝার চেষ্টা করেন সমকালীন সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি।
বেশিরভাগ দৈনিকই শুক্রবারকেন্দ্রিক সাহিত্যপাতা প্রকাশ করে। এর ব্যতিক্রমও আছে। দেশের পুরনো সংবাদপত্র ‘দৈনিক সংবাদ’ সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার। সম্প্রতি দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ সাহিত্যপাতা চালু করেছে শনিবার। বিশেষ আয়োজনে বৃহৎ কলেবরে এটি প্রকাশ করে দৈনিক সমকাল।
অন্য সংবাদপত্রগুলো চার পাতা, দুই পাতা, এক পাতা এবং অর্ধেক পাতায় সাহিত্য প্রকাশ করে। ম্যাগাজিনের বাইরে চার পাতার সাহিত্য সাময়িকী মোটামুটি খোরাক মেটাতে সক্ষম হয়ে ওঠে। এর বাইরে এক পাতা বা অর্ধেক পাতার সাহিত্য সাময়িকী নামমাত্র সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
পাঠকদের উদ্দেশে আগেই বলে রাখি, সব পত্রিকার প্রতিটি লেখা ধরে ধরে আলোচনা করা হয়তো সম্ভব হবে না। তবে নবীন-প্রবীণ লেখকের সঙ্গে একনজরে পরিচয় ঘটতে পারে। পরে আলোচিত শিরোনাম ধরে অন্তর্জালের আশ্রয় নিতে পারেন।
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ অর্থাৎ ০৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার চার পৃষ্ঠার সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেছে ‘দৈনিক সংবাদ’। পত্রিকাটি কোনো বিশেষ সংখ্যা করেনি। বিভিন্ন বিষয়ের প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতায় ভরপুর ছিলো সংখ্যাটি। একটি নিবেদিত কবিতা ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিবেদন করে কবিতাটি লিখেছেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। কবিতার নাম- ‘হাসিনা তুমি আশ্চর্য’। রয়েছে ৩টি প্রবন্ধ। ‘জাপানি উপন্যাসের পথরেখা’ শিরোনামে আলোচনা করেছেন আবুল কাসেম, ‘প্রবল মানবিকতার যৈবতী কন্যার মন’ শিরোনামে লিখেছেন লাবণ্য মণ্ডল। দুটি গল্পও স্থান পেয়েছে এতে। ‘দখল’ শিরোনামে রোকন মাহমুদ ও ‘ক্লিওপেট্রা এবং আমরা’ শিরোনামে লিখেছেন সুকান্তা করিম। কবিতা লিখেছেন- রবিউল হুসাইন, খোরশেদ বাহার, পঞ্চানন মল্লিক, পরিতোষ হালদার, দেলোয়ার হোসাইন, আলোময় বিশ্বাস ও রোকসানা আফরীন। জাকির জাফরানের অনুবাদে ধারাবাহিক রচনা ‘আকরায় পাওয়া পাণ্ডুলিপি’র ৭ম পর্ব প্রকাশি হয়েছে এ সংখ্যায়। মূল লেখক পাওলো কোয়েলো। দুটি বইয়ের আলোচনাও স্থান পেয়েছে এ সংখ্যায়। শাকুর মজিদের ‘ভাটির পুরুষ-কথা’ নিয়ে আলোচনা করেছেন সুমনকুমার দাশ এবং সেলিম রেজার ‘ক্রীড়ানায়ক শেখ কামাল’ নিয়ে আলোচনা করেছেন ওবায়েদ আকাশ।
০৭ অক্টোবর শুক্রবার যুগান্তরের সামহিত্য সাময়িকীতে কবি হেলাল হাফিজের জন্মদিন উপলক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কবি জব্বার আল নাঈম। দীর্ঘ এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কবির জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অনেক বিষয়। গল্প লিখেছেন কাজিম রেজা। কবিতা লিখেছেন আলী রিয়াজ, আসাদ উল্লাহ ও সৌম্য সালেক। শাহাবুদ্দীন নাগরীর ‘আমি ফিরেছি ভিটেয় নবনীতা ফেরেনি’ গ্রন্থের আলোচনা করেছেন মুসাররাত নওশাবা। ধারবাহিক ‘বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’ শিরোনামের ২৮তম পর্ব লিখেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। এছাড়া দুটি অনুষ্ঠানের সংবাদ ছাপা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের অর্ধেক পৃষ্ঠার আয়োজনে ‘মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন: সওগাত ও বেগম’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছেন পূরবী বসু। কবিতা লিখেছেন কামাল চৌধুরী, আশরাফ আহমদ ও ফখরে আলম।
প্রথম আলোর তিন পৃষ্ঠার আয়োজনে গোলাম মুরশিদের প্রবন্ধ ‘প্রমীলার প্রতীক্ষা’ প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যে নোবেল ২০১৬ নিয়ে এবারও ‘দারুণ বাজি’ শিরোনামে লিখেছেন তুষার তালুকদার, চারটি দেশের অনুবাদ কবিতা প্রকাশ করা হয়েছে এতে। সিরিয়ার ফওয়াদ মুহম্মদ ফওয়াদ, মিসরের মোহামেদ মেতওয়াল্লি, লেবাননের ইয়েহিয়া জাবের ও ইরাকের মানাল আল-শেখের কবিতা স্থান পেয়েছে অনুবাদে। অনুবাদ করেছেন মাহমুদ আলম সৈকত। ‘স্টেপ সান’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন আসিফ নজরুল। শিশির ভট্টাচার্যের ‘বাংলা ব্যাকরণের রূপরেখা’ বইটি নিয়ে শ্যামল কান্তি দত্ত লিখেছেন। রয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘জিন্দাবাহার’ নিয়ে একটি আলোচনা। চারুশিল্প নিয়ে লিখেছেন মোবাশ্বির আলম মজমদার। এছাড়া কিছু অংশজুড়ে শোভা পেয়েছে বিজ্ঞাপন।
আমার মনে হয় সাহিত্য বিভাগটাকে বিজ্ঞাপনের আওতামুক্ত রাখা যেতে পারে। এ পাতাটাকে বাণিজ্যিকীকরণ না করাই ভালো। সে যে পত্রিকাই হোক। পাঠকরাও হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক কোনো প্রচার-প্রচারণা যদি বিজ্ঞাপন আকারে আসে তা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনো সরকারি-বেসরকারি বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কোনো বিজ্ঞাপন প্রত্যাশিত নয়।
কালের কণ্ঠে ‘অন্যদের লেখা প্রশংসা করতে শেখো’ শিরোনামে লিখেছেন পূরবী বসু। লেখাটি অনুলিখনে ছিলেন মুহম্মদ ফরিদ হাসান। ‘এ বছর সাহিত্যে নোবেল পাচ্ছেন কে?’ শিরোনামে লিখেছেন শরীফ আতিক-উজ-জামান। কবি হেলাল হাফিজকে নিয়ে লিখেছেন মাহমুদ শাওন। যোসেফ ব্রডস্কির অদ্ভুত অভ্যাস নিয়ে লিখেছেন দুলাল আল মনসুর। স্মরণ করা হয়েছে সতীনাথ ভাদুড়ীকে। এছাড়া রয়েছে বুকরিভিউ। বিশ্ব সাহিত্যের তিনটি সংবাদ উপস্থাপন করেছেন রিয়াজ মিলটন।
সমকালের কালের খেয়া ভিন্ন কারণে ভিন্ন অনুভবে পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন হিসেবে এর বেশ কদর। কালের খেয়া প্রতিটি সংখ্যা একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এবারের বিষয় ছিলো ‘রাগ’। সমর সেনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে লিখেছেন মারুফ রায়হান। এবারের সাহিত্যে নোবেল কে পাবেন-বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন রাফিক হারিরি। প্রচ্ছদ রচনা লিখেছেন হরিশংকর জলদাস, মানস চৌধুরী, টোকন ঠাকুর। ‘কুড়ি বছর পরে’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন মাহবুবুল হক শাকিল। গল্পে একজন সাহিত্য সম্পাদকের বোধ-মানবিকতা-বন্ধুত্ব-দায়বদ্ধতা ফুটে উঠেছে। কর্পোরেট দুনিয়ায় আজকাল কবি-লেখকরাও একপ্রকার বন্দি হয়ে আছেন। তবে গল্পের শেষে তিনি মুক্তির পথও দেখিয়েছেন। কোনো আপষ করেননি। গল্পটি এজন্যই ভালো লেগেছে। কোনোর প্রলোভন-জাগতিক স্বার্থের কাছে গল্পের সাহিত্য সম্পাদক হেরে যাননি। তবে বাস্তবে তা কতটুকু সম্ভব সেটা বাস্তবতাই বলে দেবে।
‘আগুনের রংধনু’ শিরোনামে আরেকটি গল্প লিখেছেন মনি হয়দার। গল্পটিতে স্বামী-স্ত্রীর যৌন আচরণ, পাশবিকতা, বিবাহভাগ্য বর্ণিত হয়েছে। শুরু থেকে শেষ অবধি দাম্পত্য সম্পর্কে ভাঙনের সুর। তবে ভালো লাগার মতো। গল্পের বেশ কয়েক জায়গায় বানানে সমস্যা এবং শব্দই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যেমন- ‘অন্যের বই এখন’ না হয়ে ‘অন্যের বউ এখন’ হবে। ‘বাসনার বাঁশ’ জিনিসটা কী বোঝা গেল না। বাঁশ লিখতে আবার আ-কার দুটি। আবার ‘প্রত্যেকে’র বদলে ‘প্রত্যকে’ হয়েছে। ‘দুষ্টমি’ না ‘দুষ্টুমি’ হবে? ‘কাজে’ স্থলে ‘কাছে’ হয়েছে। সম্পাদনার ক্ষেত্রে আরও একটু যত্নশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়।
কালের খেয়ায় কবিতা লিখেছেন কাজী রোজী, ইকরাম কবীর ও মোস্তফা হামেদী। ‘মৃত আবদুল জলিল যখন ফিরে এলো’ শিরোনামে ফিকশন লিখেছেন মাহবুব আজীজ। এছাড়া নিয়মিত বইয়ের ভুবনে পাভেল রহমানের বই ‘সাংবাদিকতা: আমার ক্যামেরায়’ নিয়ে আলোচনা করেছেন অজয় দাশগুপ্ত। মাসুদ পথিকের ‘চাষার পুত’ নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক। আরও আছে কিছু নতুন বইয়ের খবর।
জনকণ্ঠে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক লালন রবীন্দ্রনাথ নজরুল’ শিরোনামে লিখেছেন নাজনীন বেগম। পাশপাশি স্থান পেয়েছে ছোটকাগজ কিংশুক ও হৃদয়ে চলনের আলোচনা। কবিতা লিখেছেন কবি নাসির আহমেদ ও মুহম্মদ সামাদ প্রমুখ।। রয়েছে নুরুল করিম নাসিমের জার্নাল ও বই আলোচনা। প্রবন্ধ লিখেছেন গোলাম কিবরিয়া পিনু। ধারাবাহিক নাটক লিখছেন জিয়া হায়দার।
ভোরের কাগজে প্রবন্ধ লিখেছেন আল মনসুর, শিউল মনজুর, সঞ্জয় দে রিপন, লিটন মহন্ত ও আনসার উল হক। একগুচ্ছ কবিতা লিখেছেন মাজেদুল হক। ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন কাজী সাইফুল ইসলাম। ভ্রমণ ধারাবাহিকের ঊনষাট পর্ব লিখেছেন কামরুল হাসান। গল্প লিখেছেন সোলায়মান সুমন। ছোটকাগজ ‘প্রতিকথা’নিয়ে আলোচনা করেছেন শেখ মেহেদী।
পাশাপাশি রাজশাহীর উত্তরা প্রতিদিনের সাহিত্য পাতাও প্রশংসার দাবিদার। তাদের আয়োজন পাঠককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত আজাদী, পূর্বকোণ, সুপ্রভাত বাংলাদেশ ও পূর্বদেশ পত্রিকার সাহিত্যপাতাও কোনো কোনো জাতীয় দৈনিকের সমপর্যায়ের। পরবর্তী সময়ে এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস পাব আশা করি।
মন্তব্য