শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। ছুটির দিন। দিনটিতেই কর্মব্যস্ত মানুষ ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহ এলিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আর পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়দের সঙ্গে মেতে ওঠে তুমুল আড্ডায়-খোশগল্পে। কারও কারও সঙ্গী হয়ে ওঠে পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বইপুস্তকও। এই আড্ডামগ্ন জ্ঞানপিপাসুদের মধ্যে সাহিত্যপ্রেমীরা হলো অন্যতম। দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকার সঙ্গেই থাকে প্রতি শুক্রবার সাহিত্য সাময়িকী। যদিও সব দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী সমান মানের নয়। কোনো কোনোটি একেবারেই নিম্নমানের রচনায় ভরে ওঠে। কোনোটি আংশিক মানসম্পন্ন, কোনোটি একেবারেই অপাঠ্য রচনার ভাগাড়ে পর্যবসিত। তবে সুসম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকীর দেখা সহজে যে, মেলে না—একথা আপাতত অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
এ সপ্তাহের নির্বাচিত সাময়িকীগুলো হলো—সমকালের ’কালের খেয়া’, জনকণ্ঠের ’সাহিত্য সাময়িকী’, প্রথম আলোর ‘শিল্পসাহিত্য’, ইত্তেফাকের ‘সাহিত্য সাময়িকী’ যুগান্তরের ‘যুগান্তর সাহিত্য’, ও যায়যায় দিনের ’সাহিত্য’।
শিল্প-সাহিত্যের আদিভূমে প্রথম কোন বৃক্ষটির অঙ্কুরোদগম হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে যে কেউ বলে উঠবেন—‘কবিতা’। কবিতায় মানুষের আবেগ-অনুভূতির পরিশীলিত প্রকাশ ঘটে। তাই কবিতায় পাঠকচিত্ত চিরকালই মজে।
একজনের কাছে যা সুন্দর, সত্য, অন্যের কাছে তা কুৎসিত, মিথ্যা। রুচি, অভিজ্ঞান, কল্পনাশক্তি ভেদে বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠক-কবি রয়েছে। এক শ্রেণির কবি রয়েছেন, যারা কবিতার নব-নব গ্রহ-নক্ষত্র আবিষ্কারে মগ্ন থাকেন। তারা কবিতায় নিয়ে আসেন নান্দনিকতার উৎকর্ষ। তাদের পাঠকেরও রয়েছে সিন্ধু সেঁচে মুক্তা কুড়োনোর কাঙ্ক্ষা। কবিতার এই নানাশ্রেণীর নানা রুচি-মেজাজ নিয়ে ‘কালের খেয়া’। এতে রয়েছে, ‘এতগুলি দিন পথে পথে ঘুরে’, ইকবাল আজিজ; ‘কনসার্ট’, শেলী নাজ; ‘নদী’ রফিকুজ্জামান রণি। দৈনিক যুগান্তরের সাহিত্য সাময়িকীতে ‘সুরের দীক্ষা’, সানাউল হক খান; ‘হিসাব-নিকাশ’, ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম; ‘জন্মভূমি’, নাসরীন নঈম; ‘খেলা’, মিছিল খন্দকার; ‘নৈঃশব্দের রাতে’, রফি হক।
যায়যায়দিনের সাহিত্য সাময়িকীতে ‘অন্তর্গত গোপন জেনে’, সুজাউদ্দিন কায়সার; ‘ডিম’, সুজন হজারী; ‘কবিতা’, সমরেশ দেবনাথ; ‘শিশু হত্যা’, শাহরিয়ার সোহেল; ‘তুমি করলে পাপ, আমি করলে পুণ্য’, তোফায়েল তফাজ্জল; ‘মধুমতি পায়ের দেবদূত’, চন্দন চৌধুরী। দৈনিক জনকণ্ঠের সাহিত্যসাময়িকীতে ‘উপেক্ষার প্রতিমা’, আবদুশ শুকুর খান; ‘তৃপ্তির বন্দর’; ‘দাঙ্গা’, সোহেল মাজহার।
ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকীতে রয়েছে ‘নক্ষত্রের উনুনে পাষাণ গলে যায়’, হেনরী স্বপন; নৈঃশব্দ্যের ভেতরে’, সুহিতা সুলতানা; ‘যুদ্ধ ভাসান আয়লান’, লুত্ফর চৌধুরী।
কবিতার ভাব, বোধ, চিন্তা, দর্শনের উৎসারণ মূলত আমাদের যাপিত জীবন এবং পরিপার্শ্ব থেকে। প্রতিটি কবিতায়ই কোনো না কোনো বোধ, চেতনা, অভিজ্ঞান, পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্চারিত। কিন্তু এ বোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞান কবিতায় কতটা শৈল্পিকভাবে সঞ্চালিত এবং কবিতাকে কতটা স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করে, তাই-ই দেখার বিষয়। এক কবির কবিতা থেকে অন্য কবির কবিতা তখনই স্বাতন্ত্র্য অর্জন করে, যখনই কবিতাটিতে আলাদা স্বর, ভাষা, বোধ, রূপক, উপমা, চিত্রকল্প, প্রকাশভঙ্গি প্রকাশিত হয়।
অসংযম, বাকবাহুল্য ও উপমা, রূপকের অসামঞ্জস্যতাই কবিতা হয়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধক। এ হিসেবে বর্তমান কবিদের কবিতা কতটা কবিতা হয়ে উঠছে পাঠক মাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন। তবে দক্ষ কবিমাত্রই যে কোনো ছন্দে যে কোনো বিষয়ে মোক্ষম শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃত কবিতা সৃষ্টি করতে পারেন। এমন কবির সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়, কিন্তু তুলনায় কম।
এ সপ্তাহের সাময়িকীগুলোয় প্রকাশিত কবিতা পাঠ করে আহত হলাম। কবিতায় যদি কবিতার স্বাদ না পাওয়া যায়, তবে আশাহত না হয়ে কি উপায় থাকে? এ সপ্তাহের সাময়িকীগুলো পাঠ করলে সচেতন পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন, কেমন সব কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে। উদাহরণ দিচ্ছি—
হাজার বছর ধরে আমি
পথ হাঁটিতেছি এই বাংলার বুকে
শস্যভরা ক্ষেতের আল ধরে
(দৈনিক যায়যায়দিনের সাহিত্য সাময়িকী)
তবে কিছু কবিতা তো আছেই, যেগুলো পাঠককে প্রচণ্ডভাবে আপ্লুত করে, বিমোহিত করে; কিন্তু তা নিতান্তই কম। কিছু-কিছু চরণ মুগ্ধ করেছে। যেমন—
আমার ফাইলটা সই হবে তো?
বোতাম খুলতে খুলতে মেয়েটি বলে।
(সংলাপ: সমরেশ দেবনাথ)
এবার আসা যাক প্রবন্ধ ও অন্যান্যবিভাগে। রেহমান সোবহান। অর্থনীতি, রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রামে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত যিনি বহুল আলোচিত ’ফোরাম’ সম্পাদনা ও প্রকাশের মধ্য দিয়ে শোষকগোষ্ঠী পাকদের অনাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ শিরোনামের বই লিখে বাঙালিকে বুঝিয়েছিলেন পূর্ব বাংলার অর্থনীতির স্বরূপ। এই উজ্জ্বল মুক্তচিন্তকের জীবন সংগ্রাম নিয়ে মাহবুব রেজা দৈনিক জনকণ্ঠের সাময়িকীতে লিখেছেন, ’রেহমান সোবহান: অন্ধকারের বাতিঘর’ ।
ভাষাসংগ্রামী, কবি ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক ৮৬তম জন্মদিন উপলক্ষে কবি ইমরান মাহফুজের নেওয়া একটি সাক্ষাৎকার রয়োছে দৈনিক যায়যায়দিনের সাহিত্যপাতায়। এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে আহমদ রফিকের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কথা, এতিম বালকের সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশের কাহিনী এবং কবিতাসহ নানা বিষয়। কিন্তু পুরো সাক্ষাৎকারটি অপরিকল্পিত-অপরিচ্ছন্ন। একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকের জন্মদিনে সম্মান জানাতে হবে, তাই, তাই সাক্ষাৎকার ছাপানো, এর বেশি কিছু নয়। অহেতুক, পৃষ্ঠা নষ্ট, পাঠকের সময়ের অপচয়। এছাড়া ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ চারুকলা অনুষদের ১৪ বছরের পদার্পণ উপলক্ষে চারুকলা অনুষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহজাহান আহমেদ বিকাশের নেওয়া একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে যায়াযায়দিন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অপূর্ব কুমার কুন্ডু।
যুগান্তর প্রকাশ করেছে আধুনিক কবিতা নিয়ে সরকার মাসুদের লেখা, ‘কবিতা, পর্যবেক্ষণের ভাষা’। লেখাটি তরুণ কবিদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। লেখক ইউরোপ আমেরিকার আধুনিক কবিতার উদাহরণ টেনে সমসাময়িক বাংলা কবিতাকে ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছেন।
এদিকে, শিল্পী শাহাবুদ্দিনের জন্মদিনকে ঘিরে দৈনিক সমকালের ‘কালের খেয়া’য় প্রকাশিত হয়েছে তার একটি সাক্ষাৎকার। ‘ছবি আঁকতে আঁকতে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারটিতে তার শিল্পকর্মের নানান দিক উঠে এসেছে।
সাময়িকীগুলোতে আরও যাদের লেখা প্রকাশ পেয়েছে —
‘কালের খেয়া’য় কথাসূত্রম, শোয়াইব জিবরান; ‘আচ্ছা, জীবনানন্দ দাশ যদি …’, হামিদ কায়সার; ‘কথা কেবল কথা নয়, আত্মার নিঃশ্বাস’, ফারুক ওয়াসিফ; ‘আগাগোড়া সুখবাসী’ (গল্প), আকিমুন রহমান; ‘চিন্তায় নবজাগরণে শহীদুল জহির’, মুহম্মদ সবুর; ‘ফুসফুস ভরা হাসি’, মাহবুব আজীজ।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘পথের পাঁচালী: ৬০ বছর অপুর মায়ের সঙ্গে দেখা’, আবুল মনসুর; ‘মানসিক ক্ষতের গল্প’, তুষার কালুকদার; ‘সুখের লাগি’ (গল্প), অভীক সোবহান; যায়যায়দিনে ‘জলোৎসবে জলজীবন’, হোসনে আরা মণি; জনকণ্ঠে ‘শিল্পী শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে নৌভ্রমণে, শেখ মেহেদী; ‘কবিতাক্রান্ত তারুণ্যের যাত্রা পথ’, হাসনাত মোবারক। প্রতিটি লেখা-ই দায়সারা গোছের বললে মিথ্যা বলা হয় না। তাই বিস্তারিত আলোচনা থেকে বিরত থাকলাম।
ইত্তেফাক সাময়িকীতে রয়েছে আবু সাঈদ তুলুর লেখা ’শিল্পকলায় গঙ্গা যমুনা নাট্য উত্সব’, মনি হায়দার লিখেছেন, ‘বুলবুল চৌধুরীর উপন্যাস ‘প্রাচী’: চৈতন্যের রক্তবর্ণ দাগ’, তুহিন সাইফুলের লেখার শিরোনাম ‘মার্কেজের পিছু নিয়েছিল এফবিআই!’, মাসুক হেলাল লিখেছেন, ‘এই তো আমার মিলন ভাই’, জয়া ফারজানার গল্পের নাম, ’মুনতাসির ফ্যান্টাসি গল্প’, জাফর আলম নিজের সাম্প্রতিক লেখালেখি নিয়ে বলেছেন, ’‘আক্ষরিক অনুবাদ করা ঠিক নয়’। এছাড়া মোহাম্মদ নূরুল হক লিখেছেন তরুণ কবি শরাফত হোসেনের কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে আসি কাচের শহরে’ নিয়ে আলোচনা ‘নাগরিক অভিজ্ঞতার বয়ান’।
এ সপ্তাহের সাহিত্যপাতাগুলো পড়ে, পাঠক হিসেবে হতাশ হওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। অধিকাংশ রচনা পড়ে মনে হয়েছে, সপ্তাহান্তে কেবল পাতা ভরানের জন্য, আর অনুরোধে ঢেঁকি গেলার জন্যই এসব রচনা প্রকাশিত হয়েছে। বেশির ভাগ রচনা-ই গতানুগতিক, বিরক্তিকর। কোনো নতুন চিন্তা, নতুন কল্পনার ছোঁয়া নেই। এছাড়া নেই তেমন কোনো আপ্লুত হওয়ার মতো গল্প কিংবা কবিতেও। যুগান্তরের সাহিত্যসাময়িকীতে সরকার মাসুদের প্রবন্ধ ‘কবিতা, পর্যবেক্ষণের ভাষা’ ভাবসম্প্রসারণের মতো হলেও ওই একটি রচনা-ই মোটামুটি গদ্য হিসেবে পাঠযোগ্য। এছাড়া কবিতায় ইত্তেফাক সাময়িকীতে হেনরী স্বপনের ‘নক্ষত্রের উনুনে পাষাণ গলে যায়’, যায়যায়দিনে সমরেশ দেবনাথের ’সংলাপ’ কবিতার প্রসঙ্গ বাদ দিলে দৈনিকগুলোর সাহিত্যপাতায় তেমন কবিতা কই? তবে কবিতার আকাল চলছে? নাকি যারা যথার্থ কবিতা লিখছেন, তারা দৈনিক এড়িয়ে চলছেন?