মার্চ মাস সংগ্রামের মাস। রক্ত আর আত্মত্যাগের সূচনা দিবসের মাস। এ মাসেই বাঙালিরা পেয়েছে রক্তে আগুনধরা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। পেয়েছে ২৫ মার্চের বর্বরতার পরিচয়। আর এখন এমন দিনে প্রকৃতিতে ফাগুনের হাওয়া ছিল উদ্দাম। গাছেরা আর ফুলেরা ছিল অন্যরকম সাজে। প্রকৃতি লাবণ্য ও জাতীয় জীবনের চেতনা বরাবরই সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়। আমাদের কবিরা বর্ষায় এক ধরনের আবার বসন্তের দিনে অন্য ধরনের কাব্যচর্চায় নিয়োজিত হন। এই অন্য ধরনটা হলো প্রকৃতির প্রভাব। প্রকৃতি ও প্রেমিকাই কখনো লেখকে রোমান্টিক, কখনো বিরহ আবার কখনো সৌন্দর্যবন্দনার দিকে ধাবিত করে। আর যেহেতু বাঙালির রক্ত আমাদের দেহে, রন্ধ্রে-রক্তে প্রবাহমান—জাতীয় বিশেষ ঘটনাগুলোর উপস্থাপন তাই আমাদের কবিদের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধে ও উপন্যাসে উপস্থিত। এমন চিন্তা ও চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে। সময়কে ধারণ ও উপস্থাপন করার জন্যে মার্চের সাময়িকীগুলো ও এর সম্পাদকরা প্রশংসার দাবি রাখে। ৪ মার্চ, ১১ মার্চ ও ২৫ শে মার্চের সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প স্থান পেয়েছে বিশেষভাবে। অন্যদিকে কিছু-কিছু পত্রিকার আয়োজনের সঙ্গে ছিলো ফাগুনের পদাবলি। এক্ষেত্রে সমকালের ৪ মার্চ প্রকাশিত ‘কালের খেয়া’র কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। ফাগুনের কবিতা লিখেছেন মুহম্মদ নূরুল হুদা, রবিউল হুসাইন, ফারুক মাহমুদ প্রমুখরা। কিন্তু মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার কথা অবশ্যই বলতে হবে। আগে তাঁর কবিতাটির পাঠ নেওয়া যাক:
বিশ বছর পর বললাম, ‘ভালোবাসি’।
বিশ বছর। পাশাপাশি আমাদের ঘর।
তুমি অবাক হলে না। হাসলে।
‘আমার উত্তরটাও পাবে বিশ বছর পর’।
না, আমি অপেক্ষায় থাকি না।
আমি প্রতিদান পেয়ে ভালোবাসি না।
আমার ভালোবাসা তাকায় না। হাসে না।
আমার ভালোবাসা বোবা চোখে কাঁদে।
এইতো আমার নিয়তি। যেহেতু শেষমেশ
আমিও পা রেখেছি ভালোবাসার ফাঁদে।
আমি কি তোমার উত্তরের জন্য
উবু হয়ে বসে থাকবো হাজার বছর?
জেনে রেখো, ততদিনে ভূপৃষ্ঠ থেকে
নিশ্চিতই মুছে গেছে আমার কবর।
না মহাকাল। না সকালবিকাল।
না অনন্ত। না চিরকালের দ্বন্দ্ব।
আমরা মীমাংসিত। আমরা চিরবসন্ত।
আমরা ওই শরীরের চিরঅশরীরী গন্ধ।
দূরে কাছে বাজে ছায়ার বাঁশি।
মন বলে, ভালোবাসি।
(ছায়ার বাঁশি: মুহম্মদ নূরুল হুদা)
পাঠক কবিতাটি পাঠে নিশ্চয় উপলব্ধি করেছেন, খুব ভালো একটি কবিতা উপহার দিয়েছেন মুহম্মদ নূরুল হুদা। বোধকরি গত ছ’মাসে সাহিত্য সাময়িকীগুলোর মধ্যে প্রকাশিত কবিতাগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে ভালো কবিতার একটি। তবে, নানাদিক বিবেচনায় এ মাসের সাহিত্য সাময়িকীগুলো আগের তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত হয়েছে।
এ মাসে আছে একটি বেদনার খবরও। কবি রফিক আজাদ প্রয়াত হয়েছেন ১২ মার্চ। দেশের একজন প্রধান কবির অন্তর্ধানে শোকাহত ছিলেন কবি ও লেখকরা। ১৮ মার্চের সাহিত্য সাময়িকীগুলোয় ছিলো তাঁকে ঘিরে নানা আয়োজন। কালের কণ্ঠের দশদিকে রফিক আজাদকে নিয়ে লিখেছেন হাসান আজিজুল হক, হাবিবুল্লাহ সিরাজী ও জাহিদ হায়দার।
হাসান আজিজুল হক ‘কবির অকালপ্রয়াণ’ গদ্যে লিখেছেন, ‘রফিকের মতো অমায়িক, ভদ্র, সুমিষ্ট লোক আর দেখা যায় না। কবি রফিক আজাদ বাংলাদেশের অঙ্গুলিমেয় কবিদের মধ্যে অন্যতম এবং তিনি তাঁর সৃজনকর্মের ব্যাপক অবদান আমাদের সামনে রেখে গেলেন। তিনি আমাদের মাঝে স্মরণযোগ্য হয়ে আছেন, লোকের মুখে মুখে রয়ে গেছেন।… রফিক আজাদ এতটা পঠিত এবং তার কবিতা এতটা সহজ ও সরল, যেটা মুখস্থ করার দরকার হয় না। পুরো কবিতাটা বুঝতে পারা যায় যে রফিক আজাদের ভাবনা, রফিক আজাদের চিন্তা, মানুষের জন্য তার ভালোবাসা, মানুষের জন্য তার কনসার্ন এগুলো খুব দাবি করে।’ প্রথম আলোর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন বেলাল চৌধুরী। প্রকাশিত হয়েছে রফিক আজাদের অপ্রকাশিত কবিতাও। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রফিক আজাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার আল নাঈম। সেটিও শিল্প-সাহিত্যে পত্রস্থ করা হয়েছে। আবার ১৮ মার্চ ছিলো বিশিষ্ট রম্যরসিক আবুল মনসুর আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে নিয়ে ‘আবুল মনসুর আহমদের গল্প: সমাজের নিষ্ঠ ভাষাচিত্র’ শিরোনামে লিখেছেন বিশ্বজিৎ ঘোষ। এ প্রবন্ধটিও অন্যসব প্রবন্ধের চেয়ে আলাদা। বিশ্বজিৎ ঘোষ এ প্রবন্ধে আবুল মনসুর আহমদের গল্পের ভূবনে বিশেষ দৃষ্টি ফেলেছেন। প্রবন্ধটি সুখপাঠ্য। বিশ্বজিৎ একস্থানে লিখেছেন: ‘ছোটগল্পের আবুল মনসুর আহমদ প্রধানত ব্যঙ্গ-রচয়িতা। তাঁর ছোটগল্পে ব্যঙ্গ-রসের প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষ করা যাবে। মুসলিম সমাজে প্রচল নানামাত্রিক কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা, ধর্ম ব্যবসায়ীর ভণ্ডামি ও পীর প্রথার ভয়ঙ্করতা আবুল মনসুর আহমদের ছোটগল্পে পৌনঃপুনিকভাবে এসেছে। রঙ্গ-ব্যঙ্গ-কৌতুকের মাধ্যমে তিনি নির্দেশ করতে চেয়েছেন সামাজিক অসঙ্গতি এবং একইসঙ্গে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন এসব অসঙ্গতি থেকে মানুষের মুক্তির। তাঁর রঙ্গ-ব্যঙ্গের সঙ্গে কখনো মিলেছে করুণ হাস্যরস, কখনো-বা বৈদগ্ধ্যপূর্ণ পরিহাস। সামাজিক অসঙ্গতি আর ভণ্ডামি প্রকাশে তিনি ভয় পাননি, বরং নিজের কথাটি বলেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। কাজটা যে খুব সহজ ছিল না, তা সহজেই অনুমেয়। সামাজিক চাপটা তিনি সামলেছেন, অন্যদিকে নজর দিয়েছেন শিল্পের প্রতিও। কথাটাকে শিল্প করে তুলতেও তিনি রেখেছেন নৈপুণ্যের স্বাক্ষর। দ্রোহী মানসিকতার আন্তরগরজে হাসির আয়ুধ দিয়ে তিনি ধমকে দিয়েছেন ভয়াল ভয়ঙ্কর আর সামাজিক রক্তচক্ষুকে।’
ক্লাসিক সাহিত্য সম্পর্কে ওই অর্থে তাদের ধারণা স্বচ্ছ নয়
১৮ মার্চ ভোরের কাগজের সাময়িকীতে কবিতা লিখেছেন সুজন হাজারী, মাজেদুল হক, মোহাম্মদ হোসাইন, আহমাদ সেলিম, আতোয়ার হোসেন। গল্প লিখেছেন আশরাফ উদদীন আহমদ, গদ্য লিখেছেন গালিব আসাদ উল্লাহ, আফরোজা নাসরীন ও শেলী নাজ। ঢালী আল মামুনের চিত্রকর্ম নিয়ে লিখেছেন জাহিদ সোহাগ। জাহিদ সোহাগ মূলত কবি। কিন্তু তাঁর চিত্রসমালোচনার হাত যে ভালো, তা এই লেখার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। ‘অস্থিনির্মিত আমাদের প্রকৃতি’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘মামুনের এই স্থাপনা মানুষকে নিজের সামনেই দাঁড় করায়। দ্যাখো, তোমার অপরিণামদর্শী উন্নয়ন, লোভ, শঠতা আর নিরন্তর মুনাফা লুটে নেওয়ার ফলে তোমার বাসযোগ্য পৃথিবীকে তুমি করে ফেলেছো অস্থিসার, পতিত। এই সব কীর্তির উত্তর দিচ্ছে লাট সাহেবের চেয়ার। দ্বিখণ্ডিত এই চেয়ারটি মোঘল আমল ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশকে চিহ্নিত করেছে। নির্মাণকৌশলও অনন্য। মেঘল আমলের অংশটুকু ঘোড়ার কঙ্কাল দিয়ে আর ব্রিটিশ আমলের অংশটুকু গরম মশলা (লবঙ্গ) দিয়ে। আবহমান বাংলার নরম মাটিতে এই দুই শাসনকাল জন্ম দিয়েছে লুণ্ঠনের রাজনীতি ও সংস্কৃতি। হয়তো এই রাজনীতি ও সংস্কৃতি নানা ফর্মে বাংলায়, পৃথিবীতে প্রকৃতির বিরুদ্ধে, সাধারণ মানুষের শান্তিময় বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এসব কথাই মামুন নানাভাবে বলেছেন।’
৪ মার্চ জনকণ্ঠ সাময়িকীতে প্রবীণ সাহিত্যিক ছাড়াও বেশ কয়েকজন তরুণের লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ‘বাংলা ভাষা বাংলা খেয়াল’ শিরোনামে লিখেছেন আজাদ রহমান, ‘ক্ষণকালের মায়াবী শিশির’ শিরোনামে কিটসকে নিয়ে লিখেছেন রফিকুজ্জামান রণি। শান্তনু কায়সারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। সাক্ষাৎকারে শান্তনু কায়সার সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে বলেছেন, ‘সমকালে যারা সাহিত্য চর্চা করছেন, তাদের একটা নেতিবাচক দিক আছে। সেটা হচ্ছে এখনকার তরুণরা অনেকেই এখনকার লেখাই কেবল পড়ছেন। কিন্তু আগের লেখকদের লেখা তারা পড়ছেন না। ক্লাসিক সাহিত্য সম্পর্কে ওই অর্থে তাদের ধারণা স্বচ্ছ নয়। অনেকেই হয়ত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বা শহীদ কাদরী বা শামসুর রাহমানই পড়ছেন না। এটা একটা ক্ষতিকর ব্যাপার। কেননা, সাহিত্যের ধারাক্রম জানাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি যদি নতুন কিছু করতে চাই, তবে পুরাতন বা অতীতকে জানতে হবে। অতীতকে না জেনে তো নতুন কিছু করা সম্ভব নয়। আগে জানতে হবে সাহিত্যে এমন এমন কাজ কী বা কোথায় হয়েছে। তারপর এর বাইরে গিয়ে লেখার চেষ্টা করতে হবে। তবে তরুণদের চেষ্টা ও উদ্দীপনা আমার কাছে ভালো লাগে।’
১১ মার্চ যুগান্তর সাময়িকীতে গদ্য লিখেছেন রফিকুর রশিদ। ‘দার্শনিক হতে চাইলে’ শিরোনামে ইয়ান রেভেনসক্রপট-এর লেখা অনুবাদ করেছেন জেরিন তাসনিম সাকি। কবিতা লিখেছেন ময়ুখ চৌধুরী। ‘কাদের আলীর শেষ দিন’ গল্পটি লিখেছেন তাহমিনা হক। ছিলো সৈয়দ আবুল মকসুদের নিয়মিত লেখাটিও—‘বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’।
আমরা চাই, প্রতিটি সাহিত্য সংখ্যা সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হোক। তাহলে তরুণ লেখকরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি পাঠকরাও উপকৃত হবেন।