প্রতি সপ্তাহের দৈনিকের সাহিত্যপাতা পর্যালোচনার প্রথম পর্বে অনেকের পরামর্শ আমাকে বিমোহিত করেছে। আজ শুরুতেই কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে পাঠকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাদের দেশে যে পরিমাণ সাহিত্যপাতা প্রকাশিত হচ্ছে, তার বিস্তারিত আলোচনা এক সপ্তাহে সম্ভব নয়। তবু কিছু ধারণা দিতেই এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
শুরুতেই কিছু সামগ্রিক কথা বলে নেওয়া ভালো। এ সপ্তাহের একটি সাহিত্যপাতায়ও অনুবাদ তেমন চোখে পড়েনি। তাই মনে হচ্ছে যে, বিশ্বসাহিত্যকেও বাঙালি পাঠকের সামনে হাজির করা জরুরি। পাশাপাশি পাতার দৈন্য কমিয়ে আনতে পারলে আরও বেশি ভালো হয়। তারওপর আবার বিজ্ঞাপন গিলে খাচ্ছে সাহিত্যপাতাগুলোকে।
গত শুক্রবার ১৪ অক্টোবর সমকালের কালের খেয়ার এবারের আয়োজন ‘ট্রেনে জানা গল্প’ নিয়ে। সেই শৈশবের বিস্ময় জাগানিয়া ট্রেন বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে কত-কত গল্পের পসরা নিয়ে উপস্থিত হয়ে আমাদের সামনে। তাই কালের খেয়া’র এবারের প্রচ্ছদরচনা লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল, শাকুর মজিদ ও মেহেদী উল্লাহ। গল্প লিখেছেন আফসানা বেগম ও মুস্তাফিজ সেলিম। কবি হেলাল হাফিজকে নিয়ে রয়েছে বিশেষ আয়োজন ‘কবির অন্তরঙ্গ কথোপকথন’। রয়েছে হেলাল হাফিজের নতুন একগুচ্ছ কবিতা। রয়েছে ষাট দশকের ‘বিড়াল’ গল্পখ্যাত শহীদুর রহমানের বিস্মৃতপ্রায় একটি নিবন্ধ। শহীদুর রহমান লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হকের ‘রক্তগোলাপ’ নিয়ে। এটির পুনর্পাঠ প্রকাশিত হয়েছে। রয়েছে মাহবুব আজীজের ফিকশন ‘মৃত আবদুল জলিল যখন ফিরে এলো’। মাহবুব আজীজের ফিকশনটি একজন বদলি আসামির জীবন নিয়ে। স্ত্রী ও সন্তান হারিয়ে অবশেষে নিঃশ্ব এক বাবা-স্বামীর করুণ আর্তনাদ মূর্ত হয়ে ওঠে।
প্রথম আলো সাহিত্য সাময়িকীর প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেক জুড়ে বিজ্ঞাপন। বাণিজ্যিকীকরণ যাকে বলে। তবে প্রথম আলোর মূল রচনাটি অনবদ্য। ফকির লালন, কাঙাল হরিনাথ ও মীর মশাররফকে তারা এক ফ্রেমে বেঁধেছেন। আবুল আহসান চৌধুরীর এ লেখাটি অবশ্যই পাঠককে আকৃষ্ট করতে পেরেছে।
প্রথম আলো এবার একটি প্রবন্ধ, একটি গল্প ও দু’টি বইয়ের আলোচনা দিয়েই শেষ করেছে। এতে বদরুন নাহারের ‘তুষারকন্যার খোঁজে ‘ গল্পটি দুই বন্ধুর বাল্যকালের স্মৃতি নিয়ে। প্রবাস জীবনে ফেসবুকের কল্যাণে তাদের যোগাযোগ এবং একত্রিত হওয়া। একজন তুষারকণা দাসের স্মৃতি হাতরাচ্ছেন। মাঝখানে চলে আসে আমেরিকার সাম্প্রতিক নির্বাচনি বিতর্ক। একটা সময় এনায়েত উল্লাহ নামের এক ভদ্রলোক চলে আসেন গল্পের প্রাসঙ্গিকতায়। গল্পের সময়কাল অতি সম্প্রতি। কিন্তু সবশেষে তুষারকণার খোঁজ আর মেলে না- এখানেই লেখকের সার্থকতা।
যুগান্তরের ৩টি কবিতাই ভালো লাগার মতো।
যুগান্তরের প্রবন্ধ নিয়ে বিস্তারিত বলার কিছু নেই। তবে গল্পটা আকর্ষণ করলো। শুধু শিরোনামে নয়, লেখকের নামেও। কবিতা বা গল্পে ‘নীরা’ মানেই সুনীল অর্থাৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়। কিন্তু এ নীরা সুনীলের নীরা নয়। এটি একটি মধ্যমমানের গল্প। একা একা বকবক করে যাওয়া এক প্রেমিক বা স্বামীর মনোবৈকল্যের বিশ্লেষণও বলা যায়। গল্প যা-ই হোক, এর বানানগুলো নিশ্চয়ই নজর কাড়বে। যেখানে ‘রবীন্দ নাথ’, ‘মুহুর্ত’, ‘ঘন্টা’, ‘বিষন্ন’ বানানগুলো একাধিকবার চোখে পড়বে। এছাড়া শব্দের প্রথম এ-কারের মাত্রাটাও ঠিক করা হয়নি।
‘সাহিত্য চর্চার একাল ও সেকাল’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছেন সাইফুর রহমান। সৈয়দ আবুল মকসুদের ধারাবাহিক রচনা তো আছেই। কবি-সাংবাদিক হাসান হাফিজ শিরোনামে লিখেছেন কামাল লোহানী। এছাড়া সাহিত্য সংবাদ ও অন্যান্য বিষয়ও রয়েছে।
কালের কণ্ঠে রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদকে একটু স্মরণ করা হয়েছে। তাঁর কোনো সৃষ্টিকর্ম কি আলোচনার দাবি রাখে না? তবু ধন্যবাদ কালের কণ্ঠকে। অন্যরা তো স্মরণই করলো না। কবি হাসান হাফিজ সম্পর্কে কিছু কথা লিখেছেন তপংকর চক্রবর্তী। মাসউদ আহমাদের ‘আলো-অন্ধকারে যাই’গল্পটি পড়লে ভালো লাগবে। ফারুক মঈনউদ্দীনের ভ্রমণকাহিনি এবং মঈনুস সুলতানের ভ্রমণকাহিনি দু’টি চমৎকার। পড়তে পড়তে নিজেও ঘুরে দেখার মতো। এবারের সংখ্যাটা তাহলে ভ্রমণসংখ্যাই বলা ভালো। কালের কণ্ঠের এ সংখ্যায় কবিতার কোনো স্থান নেই। কিন্তু কেন? দেশে কি কবিতার অভাব? দুই-তিনটা কবিতা তো শোভা পেতে পারতো। তাহলে কি সবাই এখন গদ্য লিখতে বসে যাবে? মানে যারা শুধু কবিতাই লিখে যাচ্ছেন, তাদের জন্য কালের কণ্ঠ কী উদ্যোগ নেবে?
জনকণ্ঠের নিয়মিত জার্নাল ও ধারাবাহিক নাটক ছাড়া যুক্ত হয়েছে রতনতনু ঘোষের অকালে চলে যাওয়া নিয়ে প্রবন্ধ। আলমগীর রেজা চৌধুরী ও ফকির ইলিয়াসের কবিতাও চমৎকার লাগবে। চিঠি লিখতে হয়তো ভুলে গেছি আমরা। হয়তো হারিয়ে গেছে নীল-হলুদ খাম। বইয়ের ভাঁজে রাখা গোলাপের পাপড়িরও খোঁজ রাখি না আজকাল। সেসব কিছুই স্মরণ করিয়ে দেয় ‘পত্রলেখা’ কবিতাটি। ছোটকাগজ নিয়ে প্রবীর বিকাশ সরকারের লেখাটি ভাবিয়ে তোলে। ছোটকাগজের বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে লেখাটিতে। দীর্ঘ এ লেখায় বেশ কিছু ছোটকাগজের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। তিনি মূলত বলতে চেয়েছেন লিটলম্যাগ কালচার এখন কোন পথে? পাঠকের কাছেই হয়তো রয়েছে এর উপযুক্ত জবাব।
মানবকণ্ঠের একপাতার আয়োজনে মাত্র তিনটি লেখা। কবি হাসান হাফিজকে নিয়ে কবি ও প্রাবন্ধিক মামুন রশীদের একটি প্রবন্ধ রয়েছে। রয়েছে ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি। অপার্থিব প্রেম শিরোনামে লেখাটি আসলে কোন ধরনের, তা প্রথমেই বলা মুশকিল। তবে গল্পটা মন্দ নয়।
ভোরের কাগজের চার পৃষ্ঠার আয়োজনের শেষ পৃষ্ঠা পুরোটাই ছিল বিজ্ঞাপনের দখলে। সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে প্রবন্ধ রয়েছে। আকবর হোসেনের শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা পাবেন এখানে। ধারাবাহিক উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনি তো থাকছেই। তবে এ সংখ্যায় একটি গল্প থাকলেও কোনো কবিতা নেই।
দৈনিক সংবাদ পুরনো পত্রিকা হলেও এ সংখ্যাটি গতানুগতিক। অন্যান্য পত্রিকার আয়োজনও বৈচিত্র্যহীন। আগামী সংখ্যায় চমকপ্রদ কিছু থাকছে, এমনই প্রত্যাশা নিয়ে পাঠক অপেক্ষা করতেই পারেন।
বাংলাদেশ প্রতিদিন, আমাদের সময়, আলোকিত বাংলাদেশ, যায়যায়দিন, পূর্বকোণ, উত্তরা প্রতিদিন, পূর্বদেশ, আজাদীসহ অন্যান্য পত্রিকা যথাযথভাবেই প্রকাশ করেছে সাহিত্যপাতা। আগামী কোনো এক আলোচনায় হয়তো উঠে আসবে কোনো একটির সফলতার গল্প।
মন্তব্য