গত সংখ্যায় জীবনানন্দ দাশ ও শামসুর রাহমানকে নিয়ে যে আক্ষেপ করা হয়েছিল, তার কিঞ্চিৎ প্রতিফলন দেখা গেছে এবারের সংখ্যায়। তবে জীবনানন্দ দাশ এ সংখ্যায়ও উপেক্ষিত ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনা করেছেন কেউ কেউ। এবার শামসুর রাহমানকে নিয়ে আলোচনা এসেছে কয়েকটি পত্রিকায়।
গত ২৮ অক্টোবর শুক্রবার সমকালের কালের খেয়ার প্রচ্ছদ রচনা ছিলো ‘বাবা ও কন্যা’। শ্বাশত এই সম্পর্ক কালে-কালে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারাক্রমে বদলে গেছে নানাভাবে। তারপরও চিরকালীন এই সম্পর্কে বরাবর জড়িয়ে থাকে অপার্থিব মায়া। এরই আলোকে কালের খেয়ার এবারের প্রচ্ছদ রচনা এটি। এ সংখ্যায় প্রচ্ছদ রচনা লিখেছেন সুম্মিতা ইসলাম, শাহনাজ মুন্নী ও আফসানা বেগম। তবে একটু খটকা লাগলো এখানে যে, তিনজনই কন্যা। বাবাদের অনুভূতি কোথায় পাবো? যাই হোক বাবাদেরও লেখা থাকা প্রয়োজন ছিল।
এ সংখ্যায় গল্প লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি ও হামিম কামাল। দ্বিতীয়জন বয়সে নবীন। তবে তার লেখায় কিছুটা ভিন্নস্বর পরিলক্ষিত হচ্ছে। তার গল্পের নাম ‘দুটি মৃত্যু’। গল্প অনেকটা এ রকম: এক বন্ধু অন্য বন্ধুর কবর দেখতে যায়। সঙ্গে আরেক বন্ধু। সেখানে দাঁড়িয়ে পূর্ববর্তী বছরের স্মৃতিচারণ করছে। কিভাবে ওই বন্ধুকে কবর দিয়েছিল। বন্ধুর বিশেষ অনুরোধে কবরটা দেওয়া হয় আরেকটি কবরের ওপর। ওই কবরটি এমন এক নারীর যাকে ওই মৃত বন্ধুটি ভালোবেসেছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একের ওপর আরেককে কবর দেওয়া সম্ভব হয়। মধ্যখানে দুজনের পৃথক বাস্তবতা বর্ণিত হয়েছে। যে বাস্তবতা তাদের ক্রমশ পৃথক করেছে এবং দুজনকেই পৃথক পথে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে। গল্পের বিষয়ের সঙ্গে বর্ণনা, চরিত্র নির্মাণে বিশেষত্ব রয়েছে। এছাড়া
রয়েছে সিলভিয়া প্লাথের ডায়েরি। আলো নীল বিভাগে স্থান পেয়েছে ‘লেখা শেষের কাটাকুটি’। রয়েছে বইয়ের ভুবন, পদাবলী ও মাহবুব আজীজের ফিকশন ‘মৃত্যুভয় আর জামগাছের ছায়া’র দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
কালের কণ্ঠে সুনীলকে নিয়ে লিখেছেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। শিরোনাম পড়েই মনে পড়ে তার কবিতাটির কথা। ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’ কবিতাটির নাম। নিখিলেশকে উদ্দেশ করে বলা কথাগুলো হয়ে উঠেছে অমর কবিতা। এ কবিতার একটি পঙক্তি ‘মৃত গাছটির পাশে উত্তরের হাওয়ায় কিছু মায়া লেগে আছে’। এ কথাটিই প্রবন্ধের শিরোনাম। তবে লেখক ভূমিকাতে সময়ক্ষেপণ করেছেন। যা কিছুটা ধৈর্যচ্যূতি ঘটায়। সুনীলের এই একটি কবিতার আলোচনা আরও দীর্ঘ হতে পারতো। তবু আরও কিছু কবিতার প্রসঙ্গ তিনি এনেছেন। তবে গভীর কোনো বিশ্লেষণ নয়, বিভিন্ন পঙ্ক্তির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। তাঁর উপলব্ধি আরও ব্যাপক হতে পারতো। কেননা এ কবিতাটি পক্ষান্তরে একটি গল্প হাজির করে পাঠকের সামনে। এছাড়া ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটিও। কবিতার মধ্যে একটি গল্পের প্লট নির্মাণ রবীন্দ্রনাথের পর সুনীল খুব নিপুণভাবে দেখিয়েছেন।
তবে সুনীলকে একটি পঙ্ক্তি বা কবিতায় বন্দি করা যায় না। এমন অমর পঙ্ক্তি তার সুপ্রচুর। তাঁর শৈশবের স্মৃতিতাড়িত কবিতাগুলো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশ থেকে চলে গেলেও তিনি মনে-প্রাণে ধারণ করেছেন এদেশের জল-বায়ু-ধুলামাখা স্মৃতি। বুকারজয়ী পল বিটিকে নিয়ে লিখেছেন দুলাল আল মনসুর। রয়েছে তিনটি কবিতাও। শান্তনু কায়সারের কথা অনুলিখন করেছেন মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। স্মরণ করা হয়েছে সুকুমার রায়কে। গিরীশ গৈরিকের ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করেছেন চানক্য বাড়ৈ। আলোচক নিজেও কবি। ফলে তার আলোচনায় কবিতার বিষয়-আশয়ের পাশপাশি গুরুত্ব পেয়েছে শৈলীও। গল্প লিখেছেন হাবিব আনিসুর রহমান। কিন্তু গল্পটা মনে হয় কোনো ভিজ্যুয়াল দৃশ্য থেকে বিবরণ দেওয়া হয়েছে। লেখক একটি সিনেমা দেখছেন আর তার কাহিনি বর্ণনা করছেন পাঠকের কাছে। খুনের দায়ে জেলখাটা স্টিফেনসনের জেল পালানোর কাহিনি নিয়ে এগিয়ে গেছে গল্প।
সংবাদের এবারের আয়োজন তরুণদের বিশেষ গল্প সংখ্যা-২। এ সংখ্যায় লিখেছেন ইশরাত তানিয়া, মাজহার সরকার, পিন্টু রহমান, জয়নাল আবেদীন শিবু ও আশরাফ জুয়েল। রয়েছে ১২টি কবিতা। পল কলিনেটের অনুবাদ কবিতা রয়েছে ৫টি। অনুবাদক রেজা রাজা।
প্রথম আলো এ সপ্তাহে শামসুর রাহমানের কবিতার বই অনুবাদ প্রসঙ্গে কায়সার হকের প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। ১৯৮৫ সালে ‘সিলেকটেড পোয়েমস অব শামসুর রাহমান’ নামে তাঁর কবিতা অনুবাদ করেছিলেন কায়সার হক। লেখা সূত্রে জানতে পারলাম, নতুন সংস্করণে এই বই আবারও বের হবে অচিরেই। কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অনুবাদক কায়সার হক লিখেছেন তাঁর অনুবাদের অভিজ্ঞতার কথা।
জোহানেসবার্গের জার্নাল বিষয়ে লিখেছেন মঈনুস সুলতান। কবিতা লিখেছেন শিহাব সরকার, লুৎফর রহমান, বিজয় আহমেদ ও মোস্তফা হামেদী। চারুশিল্প নিয়ে লিখেছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী। ‘রহস্যে ভরা এ জগতে’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন ইকবাল আজিজ। গল্পটা তবে বেশি টানতে পারেনি। এমন গল্পের ধরন সাহিত্যে নতুন নয়। তবে গল্পকার বিষয়টিকে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। বর্ণনাত্মক গল্পটি পারিপার্শ্বিক বর্ণনায় বেশি মনোযোগী হয়েছেন। বাস্তবতা-পরাবস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এমন গল্পকে বাছাই না করলেও প্রথম আলোর সম্মান ক্ষুণ্ন হতো না। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রইলাম- চমৎকার গল্পের আশায়।
এছাড়া সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অফ দ্য রেকর্ড’ বই নিয়ে আলোচনা করেছেন সুমনা শারমীন। চিন্ময় গুহের ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। অন্যান্য বিভাগ তো রয়েছেই।
যুগান্তরে শামসুর রাহমানকে নিয়ে তিন তরুণ কবির মূল্যায়ন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথমেই ফারুক আহমেদ বলেছেন, ‘শামসুর রাহমান বাংলা কবিতায় উচ্চস্বরের জোগানদাতা, যেমন নজরুল। তবে উচ্চস্বরের কবিতা সব চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। কারণ এক ধরনের কবিতা লিখতে গিয়ে বেশিরভাগ কবিই এসব শব্দকে বাগে আনতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে আস্তাকুঁড়ে চলে যেতে অন্যদিকে, একটা সময়, নির্দিষ্ট একটা সময় এমন কবিদের জন্ম দেয়। তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে, শক্তিমান কবি না হলে তো এমন সময়কে ধরতে পারার কথা না।’
শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে এমফিল গবেষণা করা আহমেদ বাসার বলেছেন, ‘শামসুর রাহমান তরুণ কবির বাতিঘর। তিরিশের দশকের বাংলা কবিতার উত্তরাধিকার ও বিশ দশকের কবিতার ভাব-ঐশ্বর্য অন্তরে ধারণ করেই শামসুর রাহমানের বিস্ময়কর উত্থান। জীবনযাত্রার অন্তর্নিহিত দহন ও উত্তাপ তার কবিতার শরীরে যেমন দৃশ্যমান, তেমনি নাগরিক নানা অনুষঙ্গ মিথ-পুরাণের আশ্রয়ে পেয়েছে নতুন মাত্রা। আগন্তুক পাঠকের দৃষ্টিতে শামসুর রাহমানের কবিতাকে মনে হতে পারে সহজ-সরল, অতি তরল; কিন্তু সেটি বাহ্যদৃশ্যমাত্র। তার কবিতার গহীনে ডুব দিলেই বোঝা যায়, কতটা শৈল্পিক কারুকার্যে খচিত তার কবিতার নন্দন-বিশ্ব। দৈনন্দিন কথোপকথনের ঢং কিভাবে কবিতার মাহাত্ম্য অর্জন করতে পারে, শামসুর রাহমানের কবিতা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।’
সবশেষে কবি জব্বার আল নাঈম বলেছেন, ‘সময়কে ধারণ করার পাশাপাশি আগামী দিনের ক্যানভাসে নিজেকে ঢেলে দিলে জীবদ্দশার মতো সমানভাবে পাঠকদ্বারে অবস্থান করাটা সহজ হতো কবি শামসুর রাহমানের। তিনি জীবদ্দশায় ছিলেন জনপ্রিয় বড় কবি। কিন্তু মহাকালের যাত্রায় অপেক্ষমাণ যাত্রী। কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া সূর্য। শামসুর রাহমান সদাজাগ্রত সংবেদনশীলতায় এবং তার আমৃত্যু অপরাহত কাব্যচর্চায় সহাবস্থান ঘটিয়েছেন অন্তর্জীবনের পাশাপাশি বর্হিজীবনের। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তিনি গভীর অনুভূতিজাত মূলবোধ, সব সংকীর্ণতামুক্ত উদার মানবিকমূল্যবোধে সন্ধি করেছেন।’
‘ফজলে লোহানী: সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চার পথিকৃৎ’ শিরোনামে লিখেছেন শাকিব লোহানী। সৈয়দ আবুল মকসুদের নিয়মিত রচনা তো রয়েছেই। এবার প্রকাশ হয়েছে ৩১তম পর্ব। ‘ম্যান বুকার হাতে পল বিটি’ শিরোনামে দি নিউইয়র্ক টাইমস অনলাইন অবলম্বনে লিখেছেন মেজবাহ উদ্দীন। এছাড়া কবিতা লিখেছেন বিমল গুহ, হাইকেল হাশমী, আলী হাবিব, শাহজাদা বসুনিয়া, মনিকা আহমেদ এবং মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। ইমদাদুল হক মিলনের ‘জিন্দাবাহার’ নিয়ে আলোচনা করেছেন সৌরভ সিকদার। তবে যুগান্তরের এবারের সংখ্যায় কোনো গল্প নেই।
আজকের আলোচনায় প্রথম শ্রেণির পাঁচটি দৈনিকের সাহিত্য পাতা নিয়েই আলোচনা করলাম। যারা সাহিত্য চর্চা বা প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া ইত্তেফাক, মানবকণ্ঠ, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ, যায়যায়দিন এবং আলোকিত বাংলাদেশ এরকমই গতানুগতিকতার মধ্য দিয়েই চলছে। পার্থক্য করতে হয় না খুব বেশি। ধ্যান-ধারণায় এবং বিষয়-বৈচিত্র্যে সমগোত্রীয়। তাই বাকিগুলো নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে বলে মনে হয়নি আমার। পাঠকের চোখে ব্যতিক্রম কিছু পড়লে জানিয়ে কৃতার্থ করবেন।
মন্তব্য