কবি জয়দুল হোসেনের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত এই নিবন্ধটি আমি শুরু করতে চাই আমাদের জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার একটি মূল্যায়নধর্মী বক্তব্যের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে। ‘তিতাসের জয়দুল’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আজীবন গণমানুষের পঙ্ক্তিভুক্ত এ মানুষটি সর্বক্ষণ সৃষ্টিশীলতায় সক্রিয় থেকেও কেমন যেন নিভৃতচারী, কেমন যেন প্রচারবিমুখ। অন্যের জন্য আলো ছড়িয়ে নিজে গুটিয়ে থাকেন আপন ছায়ায়। আপন ছায়ার আপন মায়ার এই বাউল মানুষটিকেও লোকবাংলার বহমান ভাবুক স¤প্রদায়েরই গোত্রভুক্ত ভাবতে পারেন কেউ কেউ, যেমন ভাবি আমি নিজেও। কে না জানে এঁরাই তো একটি জাতিগোষ্ঠীর বাঁকবদলের নীরব সূচক।’
জয়দুল হোসেনের প্রধান পরিচয় তিনি কবি, পরিপূর্ণতায় বিকশিত অনন্য কবি। কবিতার বাইরেও বিস্তর লেখালেখি আছে তার। ছড়া, নাটক, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ ও লোকসংস্কৃতিবিষয়ক শ্রমসাধ্য গবেষণাকর্মসহ; শিল্পসাহিত্যের নানান শাখায় তিনি সৃজনশীল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তবু বলব তার কবি-পরিচয়ই মুখ্য। কবিত্বের সংবেদনশীলতা এবং সংগঠকের দায়িত্বশীলতা নিয়ে তিনি সংস্কৃতিচর্চায় ব্রতী হয়েছেন। একদিনের ব্যক্তি-জয়দুল আজ প্রকৃত অর্থেই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। স্বাধীনতাত্তোর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নবতর প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি করেছেন তিনি, তাঁরই পরমতসহিষ্ণু প্রগতিশীল নেতৃত্বে এখানকার নানামুখী সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হয়েছে। ঘরের কোণে বসে মুখে কলম গুঁজে একাকী নিভৃতে কাব্যচর্চার চেয়েও ঘরের বাইরেই তিনি পেতেছেন কাব্যসংসার তথা সংস্কৃতিসংসার। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন মাটিলগ্ন মহীরূহ, ঘন ছায়াবিস্তারী এবং অনতিক্রম্য। প্রশ্ন উঠতেই পারে— তাঁর কবিসত্তা এবং সংগঠকসত্তার মধ্যে কি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক দৃশ্যমান হয়ে ওঠে না কখনো? হয় যদি, কে জেতে সেই লড়াইয়ে? উত্তর একটাই— কবি। কবির তো পরাজয় নেই। কবি বলেই তো তিনি ভালো সংগঠকও। আর কবিত্বের বিস্তার আছে বলেই তাঁর সংগঠন ছায়াপ্রদায়ী, নিরাপত্তাযুক্ত এবং স্বপ্নাশ্রয়ী।
জয়দুল হোসেনের সংগঠন বলতে সবাই একবাক্যে অঙ্গুলিনির্দেশ করবেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির প্রতি। সেটাই স্বাভাবিক। ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে এ নাগাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্যসেবী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের মাথার উপরে ছাতার বিস্তার নিয়ে অনড় দাঁড়িয়ে আছে এই শেকড়সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি। একদা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও কবি জয়দুল হোসেন পরে সভাপতি হিসেবে আগলে রেখেছেন সর্বজনমান্য এই প্রতিষ্ঠানকে। পদ-পদবি যা-ই হোক একাডেমির আরো অসংখ্য নিষ্ঠাবান কর্মীর মতো নিজেকে তিনি দায়িত্বশীল কর্মী হিসেবেই বিবেচনা করেন। আড়ম্বরপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ পালন শুধু নয় সাহিত্য একাডেমি আরো নানাবিধ অনুষ্ঠান-আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে, সংস্কৃতি-অন্বেষী তরুণ তরুণীকে যুক্ত করেছে, দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করেছে, গণমানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছে। কত শত কাজ আর কত শত পথ! পথের তো শেষ নেই। কিন্তু দেখা যাবে সব পথের মোহনায় দাঁড়িয়ে আছেন জয়দুল হোসেন।
আর আছে অহংকার করে দেখাবার মতো অনন্য এক স্মারক— সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা। বলতে গেলে কোনো রকম অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই মানসম্পন্ন এই পত্রিকাটির মোট ১৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকাটির অসামান্য সাহিত্যরুচির ছাপ বিধৃত রয়েছে এর পাতায় পাতায়, প্রতি সংখ্যার সূচিপত্রে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলে এ সত্য সম্যকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব। এই সবকিছু মিলিয়েই জয়দুল হোসেনের সংস্কৃতিসংসার।
সাফল্য-ব্যর্থতার দোলাচল যেন তাকে হতাশার গহ্বরে নিমজ্জিত না করে। আলোকবর্তিকা তাকেই বইতে হবে, আলো জ্বালাতে হবে তার সমস্ত সৃষ্টিকর্ম দিয়ে। জয়তু জয়দুল হোসেন।
কেবলমাত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমিই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল আস্থাবান কবি জয়দুল হোসেন আরো বেশ কিছু সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে তাঁর সৃজনশীল সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আন্দোলন এবং কার্যক্রম আবর্তিত হয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করেই। নিজে মঞ্চনাটকে অভিনয় করে নাট্যআন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতেও সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন তিরিশ লক্ষ শহিদের রক্তে ধোয়া স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ‘বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা’ কিছুতেই বৃথা যেতে পারে না। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক গতিমুখ বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দেবার অশুভ প্রক্রিয়া দেখে তিনি প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হন। তাঁর সেই ক্ষোভের বারুদ ফুটে বেরোয় রাজনৈতিক ও ব্যঙ্গাত্মক ছড়া-কবিতার মধ্য দিয়ে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
কাঁধে রাইফেল নিয়ে একাত্তরের রণাঙ্গনে যাওয়া হয়নি জয়দুল হোসেনের। তবে যুদ্ধের ভয়াবহ বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছে থেকে। তাঁর বোধ-বিশ্বাস ও বিবেচনার গভীরে সদাজাগ্রত গণমানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। এই দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি প্রবল আস্থা থেকেই তিনি নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধের তৃণমূল পর্যায়ের ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করে উপস্থাপন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তথ্যনির্ভর জীবনী রচনার পাশাপাশি তাঁকে সপরিবারে হত্যার নেপথ্যে সক্রিয় ষড়যন্ত্র নিয়েও গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন জয়দুল হোসেন। এ দেশের কাদামাটিমাখা সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর মমতার সম্পর্ক, তাদের জীবনাচারের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সখ্যতা, তাদের দুঃখ-দৈন্য অভ্যাস-সংস্কার বিশ্বাস ও বোধের সঙ্গে অচ্ছেদ্য নাড়ির সম্পর্ক বলেই তিনি দায়িত্ব হিসেবে কাঁধে তুলে নেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকসংস্কৃতির রূপরেখা নিয়ে গবেষণা করার এবং এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনার। আর এই সবকিছু মিলিয়েই বেড়ে ওঠেন কবি জয়দুল হোসেন এবং তাঁর হাতে রচিত হয় বিচিত্র সব জীবনমুখী কবিতা। জীবনে জীবন ঘষে আগুন জ্বালিয়ে সেই আগুনের উত্তাপে রচিত হয় তাঁর প্রতিটি কবিতার পঙক্তি। জয়দুল হোসেনের কবিতামাত্রই হয়ে ওঠে এক একটি বাতিঘর।
এই বাতিঅলা জয়দুল হোসেনের কবিতা সম্পর্কে কবি আসাদ চৌধুরীর মন্তব্য যথার্থই প্রণিধানযোগ্য, ‘একজন কবি যখন রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশ, সামাজিক অবক্ষয় ও নৈরাজ্যের মুখে চরম প্রতিকূলতা ও বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন, তখন তিনি প্রতিবাদী না হয়ে পারেন না। কবির মন সাধারণত সংবেদনশীল বলেই পারিপার্শ্বিক অনিয়ম ও অব্যবস্থা তাঁকে বিচলিত করে। তখন তিনি প্রতিবাদী হন যাবতীয় অন্যায় অনিয়ম আর শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে। কবির কবিতায়ও তখন এই প্রতিবাদের প্রভাব বিস্তার লাভ করে। কবিতার প্রবাহে সঞ্চালিত হয় প্রতিবাদের ভাষা। কবি জয়দুল হোসেন সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে তিনি মনে করেন শেকড় ও তৃণমূল থেকেই আসে সকল শক্তি ও প্রেরণা। তাই মৃত্তিকা-সংলগ্ন মানুষই তাঁর সাহিত্যের মূল উৎসভূমি।’ (ভূমিকা : পূর্ণদৈর্ঘ্য কবিতা, প্রথম প্রকাশ ২০০৪)
বাতিঅলার ব্রত নিয়েই বাংলা কবিতার ভুবনে এসেছেন মৃত্তিকালগ্ন কবি জয়দুল হোসেন। ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের অন্ধকার যখন আমাদের চতুর্দিকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে উদ্যত, এ সময়ে এই আলোর বাতিঘরটির বড়ই প্রয়োজন। সাফল্য-ব্যর্থতার দোলাচল যেন তাকে হতাশার গহ্বরে নিমজ্জিত না করে। আলোকবর্তিকা তাকেই বইতে হবে, আলো জ্বালাতে হবে তার সমস্ত সৃষ্টিকর্ম দিয়ে। জয়তু জয়দুল হোসেন।