প্রতি সপ্তাহে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্যপাতা নিয়ে কথা বলছি। কথা কম নয়, তাই কিছু কথা রয়েই যায়। সব কথা হয় না বলা, অনেক কথা যায় না বলা। তবু বলি, আরও বলব। ঘটনার কোনো পরিবর্তন নেই। যা ছিলো তা-ই। কোনো মাথাব্যথা নেই। লোকে কী বলে, তাতে কী আসে যায়? এমন ভাবটাই বিরাজ করছে সবার মনে। সৃষ্টিকর্ম চলছে জোরকর্ম হিসেবে। সম্পর্ককর্মও এগিয়ে যাচ্ছে রে রে করে। নবীনের আহ্বানে নতুন মাত্রা পাওয়ার পরিবর্তে হাবিজাবি হচ্ছে কেবল পাতাজুড়ে।
তবে যা-ই হোক, এবার মূল আলোচনায় আসি- ১১ নভেম্বর শুক্রবার প্রথম আলো ছাড়া প্রথম শ্রেণীর সবপত্রিকাই সাহিত্যপাতা প্রকাশ করেছে। সবগুলো পড়ার সুযোগ হয় না। কখনো কখনো সুযোগ হলেও লেখার সময়-সুযোগ থাকে না। ফলে মূল কয়েকটি পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই আলোচনার ইতি টানতে হয়।
আমরা সবাই জানি, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা ভাষার অনন্য এক শিল্পী। ১৩ নভেম্বর ছিল তাঁর ৬৮তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে সমকালের ‘কালের খেয়া’র প্রচ্ছদ রচনা ছিল ‘আনন্দ বেদনার হুমায়ূন আহমেদ’। এবারের মূল বিষয়ে লিখেছেন হাসান আজিজুল হক ও আলমগীর রহমান। ‘আমার হুমায়ূন আহমেদ: নির্বাচিত লেখামালা’ বিভাগে সমকালীন তরুণ-প্রবীণ লেখক-কবির অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। এ বিভাগে লিখেছেন মালেকা পারভীন, বীরেন মুখার্জী, বিদ্যুৎ দেব, আব্দুল্লাহ আল কেমী প্রমুখ।
‘নালন্দা কী পাস’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন উম্মে মুসলিমা । ‘এইসব বেঁচে থাকা দিন’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন ইমন চৌধুরী। রয়েছে সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর ৮১তম জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ সাক্ষাৎকার। কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্র গোপ, মাসুদ খান, রেজা সেলিম, অভীক সানওয়ার রাহমান। বইয়ের ভুবন আর শিল্পকলা তো রয়েছে। আরও পাবেন মাহবুব আজীজের ফিকশন ‘অন্তর্গত ঘূর্ণি’।
প্রথম আলো তাদের ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা বের করেছে এইদিন। তাই সেদিন সাহিত্য বিভাগে কোনো লেখা ছিল না।
বাংলাদেশ প্রতিদিনে বরষার বিরূপ দুঃস্বপ্নে জর্জরিত ‘প্রাণীদের কথা’লিখেছেন ইকবাল আজিজ। লেখক বলেছেন, ‘বিত্তবান যারা বরষার সন্ধ্যায় আপন বাড়ির জলসাঘরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রাগরাগিনীর আসর বসান, তাদের কেউ কেউ বরষা-বাদলের দিনে রাস্তায় জমে থাকা কাদাপানির বিরূপ পরিবেশে বড় বেশি বিরক্তিবোধ করেন। তবে বরষার জল ছলছল কলকল ধারা হয়তো ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষের মনকে উদাসীন করে তোলে। হয়তো এই মিশ্র অনুভূতি নিয়েই জীবনের অভিযাত্রা প্রবহমান। অবশ্য বরষা নিয়ে কবি আর গীতিকারদের মুগ্ধতা ও তার প্রবণতার শেষ নেই।’
‘আমাদের পাখিগুলো’ শিরোনামে কবিতা লিখেছেন রবিউল হুসাইন। কবি বলতে চেয়েছেন, ‘আমাদের পাখিগুলোর ডানা নেই কিন্তু তবুও তারা উড়ে উড়ে…ছাত্রাবাসের ঘুলঘুলি গলিয়ে গড়িয়ে জড়িয়ে জড়াজড়ি করতে/ করতে শূন্যে হুটোপুটি লুটোপুটি উল্টোপুটি ঘুরে ঘুরে উড়তে উড়তে’। কামরুল হাসান তার ‘যে সব অঞ্চলে রেলপথ গেছে’ কবিতায় বলেছেন, ‘যে সব অঞ্চলে রেলপথ গেছে সেখানে চায়ের গাছ প্রতিশ্রুতিময়,/ অজস্র কাপের প্রান্তে দ্যুতিময় ঠোঁটের সংরাগ, অমর্ত্যলোক ঘুরে আসা/ বৃক্ষেরা কখনো জানলো না বেড়াবার মাঠ খোলা আছে, প্রকৃতিবিরুদ্ধ/ হলে উহাদের ভালো হতো; বেড়ানোর এত মুক্ত প্রান্তর পৃথিবীতে আছে।’ ‘রবীন্দ্র বিষয়ক’ শিরোনামে আশুতোষ ভৌমিক বলেছেন, ‘একি ব্যর্থতা নাকি সফলতা/ তাও তো হলো না জানা/সারা ঘরে বিশুদ্ধ নির্জনতা-/প্রভাতী ছায়া’।
কালের কণ্ঠে ‘একটি কম্বল’ শিরোনামে হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করেছেন হরিশংকর জলদাস। লেখকের আলোচিত দুটি লেখা নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।
একটি উপন্যাস—‘গৌরীপুর জংশন’, অন্যটি গল্প—‘শীত’। এই দুটি লেখায় শীত বিশেষ গুরুত্বে উপস্থাপিত হয়েছে। কাহিনির মোচড়ে শীতের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে এই দুটি লেখায়। আলোচক বলতে চেয়েছেন, ‘শেষ অবধি কম্বলটি ‘শীত’ গল্পে শুধু উষ্ণতার প্রতীক হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে একজন মুক্তিযোদ্ধার পিতার লাঞ্ছনার, একজন নারীর আর্তনাদ-হাহাকারের অভিজ্ঞান।’
‘ছোটগল্পের হুমায়ূন আহমেদ’ শিরোনামে লিখেছেন প্রশান্ত মৃধা। লেখক বলেছেন, ‘ছোটগল্পের যে আঁটসাঁটো গঠন, প্রায় কোথাও ঔপন্যাসিক-গদ্যের কোনো প্রকার বিস্তারে যাওয়ার সুযোগ নেই, যদি একটি সাহিত্যমাধ্যম হিসেবে ছোটগল্পের গঠনের প্রাথমিক ‘মান্য’ কায়দাটার কথা মনে রাখি, তাহলে সেই কৌশল একেবারে শুরু থেকেই হুমায়ূন আহমেদ রক্ষা করেছেন। অথবা বলা যায়, এটি তাঁর প্রধান কৌশল। কথা কত কম বলা যায়। কত কম বলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। বর্ণনার কৌশলে কতটা মন্তব্যহীন আর থাকা যায় প্রায় নির্লিপ্ত।’
আলোচক আরও বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের এই কনিষ্ঠ সন্তান গদ্য লেখকদের একনিষ্ঠ মনোযোগ ছাড়াই কবিতার পরে সবচেয়ে শিল্পসফল! সেখানে এতখানিক আফসোসের পরে হুমায়ূন আহমেদের যে সফলতা বিরাজমান, তাতে তাঁর কয়েকটি ছোটগল্পের কাছে বারবার ফিরে যাওয়া যায়। তাঁর গল্পসমগ্র পড়া যায় যেকোনো সময়!’
‘ভ্রম’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন শামীম আহমেদ। কথকের ভাষায়, ‘বৃষ্টিতে ভিজতে, নগ্ন হতে বড্ড ভালো লাগে আমার।’ অথবা ‘আমি আবার গোসল করার সময় গায়ে সুতোটাও রাখতে পারি না!’ সে যাই হোক, গল্পে এত বেশি প্রসঙ্গ রয়েছে যে, মনযোগ ধরে রাখাটা দুঃসাধ্য। কোথাও স্থিরতা নেই। হাজারও প্রসঙ্গে জর্জরিত গল্পে একসময় শুনতে পাই- ‘ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এসেছে, এমন সময় মনে হলো—কেউ বোধ হয় পর্দা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে। পরনে সবুজ শাড়ি, পায়ে নূপুরের শব্দও শোনা যায়। আমার কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগে।’স্বপ্ন এবং বাস্তবতার দোলাচলে দুলতে থাকে গল্পের চরিত্র। শেষটা তেমন মনপুঃত হয়নি বলা যায়। কবিতা লিখেছেন মুহাম্মদ সামাদ, আলমগীর রেজা চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া অন্যান্য বিষয়েও লেখা রয়েছে।
যুগান্তরে এবার ৮টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য মুহম্মদ নুরুল হুদা, হাসান হাফিজ প্রমুখ।
মুস্তাফা মজিদের ‘কবিতাসমগ্র’ নিয়ে আলোচনা করেছেন রবিউল হুসাইন। আলোচনাটি কবি মুস্তাফা মজিদের নয়টি কাব্যগ্রন্থের একত্রিত এক কবিতাসমগ্র সম্পর্কে উপস্থাপনা। ‘স্বাতীর কাছে চিঠি’, ‘মেঘবতী সুবর্ণভূমি’, ‘কুসুমিত পঞ্চদশী’, ‘তোকে নিয়ে প্রেম প্রেম খেলা’, ‘পুষ্পপত্রে নীলকণ্ঠ’, ‘জনযুদ্ধের কনভয়’, ‘সাকিন সুবিদখালী’, ‘নেপালি জনযোদ্ধার ডায়েরি’, ‘মিন্টো রোডে পান্থজন’ শীর্ষক কবিতাগ্রন্থ ছাড়াও সাতটি অগ্রন্থিত কবিতা ও পাঁচটি মণিপুরী ভাষার বাংলা ভাষায় অনূদিত কবিতা এই কবিতাসমগ্রে গ্রন্থিত হয়েছে।
রবিউল হুসাইন আলোচনা করতে গিয়ে কবি মুস্তাফা মজিদ সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রেমের জটিলতা, সরলতা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, কাতরতা ইত্যাদি বিভিন্ন অবচৈতনিক মনোগত অবস্থার পরিচয় এবং তদ্রূপ সমাজে অবিচার, অন্যায়, শোষণ, অনাচার, অত্যাচার ও অবমূল্যায়ন প্রক্রিয়ার বিষদ বিবরণ কবির কবিতা-পঙ্ক্তির ভেতর দিয়ে সরাসরি প্রকাশিত হয়েছে এবং সেগুলো খুব সহজেই পাঠকের অনুভূতিতে ধরা পড়ে। তাই এই কবিকে স্বাভাবিকভাবেই এক দ্বৈত সত্তার কবি হিসেবে অভিহিত করতে পারি।’
হুমায়ূন আহমেদকে নিবেদন করে ‘দলছুট’ শিরোনামে গল্প লিখেছেন জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ। নন্দিত কথাসাহিত্যিকের বিখ্যাত চরিত্র মিসির আলীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে গল্পটি। শুরুটা এ রকম-‘আসা-যাওয়ার এই পথে লোকটিকে প্রতিদিনই বসে থাকতে দেখি। কোনো কথা নেই। শুকনো খড়কুটো হাতে তুলে ঢিল ছোড়ে এদিক-সেদিক। আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে ঢুঁকরে ঢুঁকরে কাঁদে।’ তবে গল্পের শেষটা ঠিক এমন- ‘কথাগুলো বলতে বলতে আগুনের পাশ ঘেঁষেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল সে। হতবিহ্বল আমি , আগুনের প্রখর তাপ দেহে লাগিয়ে চারপাশ খুঁজতে থাকি অন্য এক মিসির আলীর রূপছায়া।’ একটি সহজ-সরল গল্প। নাটকীয়তার অভাব রয়েছে বর্ণনায়। সাদামাটা বিবরণে সৌন্দর্য হারিয়েছে দলছুট।
সৈয়দ আবুল মকসুদের ধারাবাহিক ‘বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’র ৩৩তম পর্ব প্রকাশিত হয়েছে এ সংখ্যায়। এছাড়া বিশ্বসাহিত্য, সাহিত্য সংবাদ, বই আলোচনা তো রয়েছেই।
শেষে এটুকু বলতে পারি, গত এক মাসেও কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। আশায় বুক বাঁধি- ভবিষ্যতে হয়তো হবে। অনেক কিছুই বলতে পারি না। আবার বলাও হয় না। যারা পড়ছেন, তারাই এর বিচার করতে যথেষ্ট। সংবাদপত্রের সাহিত্যপাতা আরও সমৃদ্ধ হোক। ঝড় তুলুক কোনো লেখায়। উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক কোনও সাহিত্যযোদ্ধা। সেই কাজটা এখনো বাকি। খুঁজে বের করুন, সবাইকে মূল্যায়ন করুন।
মন্তব্য