হোর্হে লুইস বোর্হেসের কবিতার অনুবাদ তাঁর কবিতার প্রকৃত রস থেকে আমাদের ভুল ব্যঞ্জনায় আলোড়িত করে। একমাত্র স্পেনিশ রক্ত প্রবাহিত হলে তাঁর কবিতার মর্মার্থ সৌন্দর্য বোধের জগতে অনুকম্পন জাগাতে পারে। আমি স্পেনিশ নই। ইংরেজি ভাষা এবং স্পেনিশ ভাষার প্রতিভাষে নান্দনিক সৌন্দর্যকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি মাত্র। বোর্হেসের নিজকণ্ঠের অভিব্যক্তি তাঁর কবিতা পাঠে সাহায্য করবে আমাদের; ভিন্ন ভাষার কবিতা বোঝার জন্য এটি পরিপূরক একটি পথ। কবিতা পাঠের আগে বোর্হেস-উচ্চারিত বিশ্বাস আমরা জেনে নিতে পারি।
কবিতা বিষয়ে বোর্হেসের অভিব্যক্তি
যদি আমার কবিতায় কার প্রভাব সর্বাপেক্ষা বেশি প্রশ্ন করা হয়; তবে আমি বলব, আধুনিক ধ্যান-ধারণাই আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছে। আধুনিক মননের মধ্যে যে মানবসত্তার সামগ্রিক মুক্তি, তা স্পেনিশ ভাষাকেও নতুন মাত্রা দিয়েছে এবং তা এখনো সঞ্চারিত। আমাদের যে ভাষা, সেই ভাষার অন্তঃস্থল থেকেই মূল প্রবণতাটিকে চিহ্নিত করতে হবে। কেবল আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই সে প্রবণতা খুঁজলে চলবে না।
যাদের লেখা আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি, তাদের প্রভাব অবশ্যই আছে আমার লেখায়। ভাষা এক ধরনের অস্তিত্ব, যা সব সময়ই সজীব-স্পন্দমান। সুতরাং ভাষা শুধু নির্দিষ্ট কোনো প্রতীক অথবা তাৎক্ষণিক সমীকরণের বিষয় হতে পারে না।
আমার নিজের ক্ষেত্রে, কাব্য নির্মিতির প্রক্রিয়াটা বৈচিত্র্যহীন। একটি আবছা অবয়ব তৈরি হয় আমার মনশ্চক্ষে; যেন একটা দূরাগত দ্বীপ; এখান থেকেই তৈরি হবে একটা গল্প অথবা কবিতা। প্রথমটুকু আর শেষটুকুই আমি দেখতে পাই; মাঝেরটুকু নয়।
আমি আমার যাবতীয় মতসহ নিজেকে সরিয়ে রাখি। কেননা অভিমত বিষয়টা এতই তুচ্ছ যে, এতে পরিণামে আমার কবিতারই ক্ষতি হয়। অথচ যাঁরা বলে থাকেন শিল্পকৃতি এক প্রকার আপস-কৌশল, তাঁরা সরলীকরণ করেন মাত্র। কেননা প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্পীরা কেউই জানেন না আসলে কী হতে যাচ্ছে। কিপলিং স্বীকার করেছেন, নীতিটুকু অনুধাবন না করেই একজন লেখক নীতিকথা বলে ফেলেন। কেউই প্রকৃত প্রস্তাবে মরেন না; কারণ তারা সকলেই তাদের ছায়া প্রদর্শন করেন। আমি একটি আয়নার কথা ভাবি। আয়নাতে আমি নিজেকে মুখোস পরা অবস্থায় দেখি। অথবা দেখি অন্য একজনকে, সে হলাম আমি; কিন্তু তাকে আমি চিনতে পারি না। যদি আমাদের জীবনের কী অর্থ, তা ব্যাখ্যা করা হয়, তা হলে আমরা তা বুঝব না।
আমি স্বভাবতই বাস্তববাদী। প্রায় সবার ক্ষেত্রেই বাস্তব সম্পর্কে ভাবনা, স্থান নিয়ে চিন্তা এবং তাদের সৃষ্টি রহস্য শুরু হয় শূন্য দিয়ে। আমি সময় নিয়ে ভাবি। আমি মনে করি সব কিছু ঘটে যাচ্ছে কালের ভেতর। আমি অনুভব করি শূন্য ছাড়াই সব কিছু চিন্তা করতে পারি অথচ কাল ছাড়া পারি না।
জগৎ তৈরি করা হচ্ছে আসলে সময় সৃষ্টি করা। যদি তা না হয় সবাই জিজ্ঞেস করবে, জগৎ তৈরির আগে ঈশ্বর তা হলে কী করছিলেন? অথচ এর উত্তরে বলা হচ্ছে পূর্বে কিছু ছাড়াই প্রথম মুহূর্তটি রয়েছে। বিষয়টি অসম্ভব, কারণ একটি মুহূর্তের কথা যদি ভাবি তবে সেই মুহূর্তের আগে আমি সময়ের কথা ভাবব।
আমি তরুণ বয়স অপেক্ষা এখন অনেক বেশি সুখী বলে অনুভব করি। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। এমনকি আমি জানি না সামনে কী পড়ে আছে; কারণ এই ছিয়াশি বছর বয়স, সন্দেহ নেই, ভবিষ্যৎ অপেক্ষা অনেক বেশি পড়ে থাকবে অতীত। আমি নিশ্চিত, মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে সব শেষ হয়ে যাবে। অথচ মাঝে মাঝে মনে হয় শারীরিক মৃত্যুর পর অন্য কোনো রূপে আমি জীবন যাপন করব হয়তো।
হোর্হে লুইস বোর্হেসের কবিতা
সমুদ্র যাত্রায় অ্যাংলো-স্যাক্সন ব্যাকরণ পাঠ
পঞ্চাশ জেনারেশন পর
(যেমন গাল্ফগণ আত্মপ্রকাশ করেছিল আমাদের সময়ে)
আমি ফিরে এলাম দূরবর্তী তীরে, নদী থেকে অসংখ্য দূরত্বে
নরওয়েজীয়দের বিশাল জাহাজ বহরে কখনোই যাইনি আমি
অথবা কর্কশ-কর্মব্যস্ত উত্তেজিত শব্দরাজীর মধ্যে
যে কণ্ঠস্বর এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত ধুলোকণা মাত্র,
আমি স্পষ্ট দিনের ভেতর ব্যবহার করেছি নর্থামব্রিয়া এবং মার্সিয়াদের
যখন এসে পৌঁছেনি হোর্হে অথবা বোর্হেজ।
শেষ শনিবারে আমরা পড়েছিলাম জুলিয়াস সিজার
তিনিই প্রথম আগন্তুক যিনি বৃটেন হতে শত অনুসন্ধানে রোমে পৌঁছিলেন
আর দ্রাক্ষাকুঞ্জ পেকে ওঠার আগেই আমি শুনে নেব
নাইটেঙ্গেলের প্রহেলিকাসঙ্গীত।
বারজন যোদ্ধা সুর করে পাঠ করে শোকগাথা
পাহাড়ের চুড়ায় দাফন করা হলো তাদের মহান রাজাকে।
এই যাবতীয় শব্দাবলীকে আমার কাছে মনে হলো প্রতীক,
অপরাপর সমস্ত প্রতীকের প্রতীক অথবা একই বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন রূপ
অর্থাৎ ইংরেজ অথবা জার্মান
যতক্ষণ না পর্যন্ত নতুন কোন কল্পবিন্দুতে উপনীত হয়
এবং একজন মানুষ এই কল্পবিন্দুর ব্যবহারে ঈশ্বরকে সংস্কারের উদ্দেশ্যে
সমুদ্র অথবা বীজবপনকারীকে আহবান জানায়।
আগামীকাল অগ্নিদেহে জ্বলবে না কোন অগ্নিশিখা
অথচ চমৎকার আগ্রহের সাথে
গৃহপালিত ঈশ্বরের লেশমাত্র সংস্কারের জন্য
প্রাচীন কোন আতঙ্ক ব্যতিত কেউ একজনও পারে না
ঈশ্বরের মুখোমুখি হতে।
সমস্ত প্রশাংসা সঙ্গীত অসীম অফুরন্তের প্রতি
সমস্ত পথের সঙ্গমস্থলই এর কারণ যা ক্রিয়াশীল
যে রহস্য প্রকাশিত হবার পূর্বেই আমার নিকট তা স্বচ্ছ দর্পণ
যেখানে আমি দেখি না কাউকেই অথবা দেখবো না অপর কারো অস্তিত্ব
আমার জন্য এই নির্ভুল গভীর ধ্যানমগ্ন চিন্তন
যেখানে সমস্ত ভাষা নির্বাক।
আমার অস্তিত্ব
আমি কোনোদিন দেখি নাই আমাদের মাথার খুলির ভেতরের
গোপন অস্তিত্ব, রুদ্ধ হৃদয়, রক্তপ্রবাহ পথ, স্বপ্নের নিষিদ্ধ বিশ্ব,
অতীত প্রোটিউস গ্রীবা, নাড়িভুড়ি, হাড়হাড্ডি কঙ্কাল।
এই সমস্ত কিছুই হচ্ছি আমি।
অবাক বিস্ময়ে আমি এক তরবারির স্মৃতিচিহ্ন,
একক নিঃসঙ্গতার স্মৃতি এবং অস্তগামী সূর্য;
স্বর্ণে রূপান্তরিত হবার পর ধূসরতা তারপর শূন্যতা।
একজন মাত্র আমি, পোতাশ্রয় থেকে তাকিয়ে থাকি
বিনষ্ট পাণ্ডুলিপির মতো আমি দুর্লভ খোদাইচিত্র
সময়ের সাথে বিনাশ বিনষ্ট
আর এর মধ্যেই সেইসব মৃতদের মাঝে
তাদেরই একজন ঈর্ষাকাতর।
ক্রমাগত অপরিচিত হয়ে ওঠে মানুষ
শব্দে শব্দে বুনে যায় মানুষ
গৃহে গৃহে কোন এক বসতগৃহে।
শোকগাথা
হায় বোর্হেস! হায় নিয়তি!
এই পৃথিবীর অদ্ভুত সব সমুদ্রে জাহাজ ভাসাতে হলো
আর্শ্চয নামগুলোর একটি, নির্জন সৈকতে
থাকতে হয়েছে এডিনবুর্গের কোন এক স্থানে
জুরিখে, দুইকোরডাবাসে, কলম্বিয়া অথবা
টেকসাসের কোন এক ভূমিতে
প্রজন্ম প্রজন্ম পর ফিরে আসি
পরিত্যক্ত পুরনো দেশ
আন্দালুসিয়া, পুর্তুগাল আর সেইসব দেশে
যেখানে স্যাক্সনরা যুদ্ধে মেতেছিল ভেনিসদের সাথে
তারা মিশিয়েছিল তাদের রক্ত মাটিতে।
ভ্রমণ করতে হয়েছে লন্ডনের লাল নিস্তব্ধ গোলকধাঁধায়
বহু আয়নাতে আয়নাতে বেড়েছে বয়স
ভাস্কর্যের মর্মর দৃষ্টিতে বৃথা খুঁজলাম
খুঁজেছি লিথোগ্রাফে, বিশ্বকোষে
মানচিত্রে করতে হয়েছে অনুসন্ধান
দেখতে হলো সবকিছু, যা মানুষেরা দেখে থাকে
মৃত্যু, স্থবির অলসকাতর সকাল, সমতল ভূমি
আর স্পর্শকাতর নক্ষত্রসমূহ,
আর কিছুই দেখোনি, প্রায় কিছুই দেখোনি বোর্হেস!
বুয়েনেস এয়ারেসে একটি বালিকার মুখ ব্যতিত
সেই মুখ তোমাকে চায়নি, এইটুকু স্মৃতিতে গভীর।
হায় বোর্হেসের নিয়তি!
সম্ভবত তুমি ব্যতিত আর কোন অপরিচিতা নেই।
গ্রিক কাব্য সংকলনের গৌণ কবির প্রতি
কোথায় এখন সেই স্মৃতিচিহ্ন
সেই দিনগুলো যারা ছিল তোমার হাতে বোনা একান্তই তোমার
সেই বিষাদদগ্ধ আনন্দ এবং তোমার নির্মিত অক্ষয় কর্মসমূহ?
সর্বজনস্বীকৃত গণনা হতে
সময়ের বার্ষিক নদী আজ তাদের হারিয়ে ফেলেছে
তুমি এখন সূচিপত্রের একখানা শব্দ মাত্র।
আর সকলের প্রতি ঈশ্বর দিয়েছেন গৌরব, যার কোন বিনাশ নেই
পদাঙ্কিত শব্দাবলী, প্রভাব-প্রতিপত্তি,স্মৃতিসৌধ
বিবেকবান ঐতিহাসিক সকলেই এবং আমরাও তোমাকে জানি
বন্ধু তুমি এখন ম্লান অন্ধকার মাত্র
এভাবেই তুমি শুনেছিলে কোন এক সকালে নাইটেঙ্গেলের সুর।
ছায়াশোভিত স্বর্গপুষ্প, তোমার ছাউনি,
ছাউনির ভেতরের অহঙ্কার
এবং দেবগণের নিষ্ঠুরতা নিশ্চয়ই দয়ার্দ্র হবেন।
অথচ প্রতিটি দিন যেন বিপদসঙ্কুল ছোট একটি জাল
এবং সেখানেই একটি বৃহত্তর আশীর্বাদ
তারপর ভস্মিভূত ছাই, যা কীনা বিস্মরণ দ্বারা নির্মিত?
আর সকলের মস্তকে ঈশ্বরের আশির্বাদ
এবং অপ্রতিরোধ্য রাত্রির গৌরব,
যার মেধাসমূহ মিশে আছে গোপন তন্ত্রীতে
এবং প্রতিটি আবিষ্কৃত অপরাধের মধ্যে।
গৌরব, যা কীনা অন্তত গোলাপের বার্ধক্যের মত
পবিত্র এক শ্রাদ্ধার্ঘ
তারাই তোমার প্রতি অধিকতর উদার।
এমন এক বিমোহিত সন্ধ্যার ভেতর,
যে সন্ধ্যা কখনোই রাত্রি হবে না
তুমি শুনছো এক সমাপ্তিবিহীন ঐশ্বরিক নাইটেঙ্গেলের গান।
বাগানচত্বর
সন্ধ্যায়
ক্লান্তিকর বাগানের দু’তিনটি রং।
পূর্ণচাঁদের পরিপূর্ণ সরলতা
সহজ আকাশকে জাদু করে।
বাগান-প্রাঙ্গণ, স্বর্গের পানিপথ।
ঢালু বাগানচত্বর নেমে আসে
যেখানে আকাশ বয়ে যায় গৃহ অভিমুখে; প্রসন্নতায়,
চিরন্তন অপেক্ষা তারকার পথ প্রবাহে।
বন্ধুত্বের কালো রাস্তায় বেঁচে থাকার মত ভালোবাসা
বৃক্ষ আর ঝরনার শিরোদেশে এ পথের পূর্ণ প্রবেশ।
শূন্য চিত্রশালা
মেহগনীর স্থায়ী আসবাব
কিংখাব সংশয়; অবিরাম সন্ধ্যা-আসর।
ড্যাগিওরোটাইপ্স ফটোশিল্পের মত
নিকট সান্নিধ্যে তারা মিথ্যা বলে
আয়নার পর্দায় বৃদ্ধের নিভৃত আশ্রম
অস্পষ্ট বৎসর শেষে, অচেনা দিনের মত
বৃদ্ধেরা এড়িয়ে চলে আমাদের।
তাদের কলংকিত আচরণ, উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর
দৌড়ে যায় আমাদের আত্মার ওপর দিয়ে;
অর্ধ শতাব্দীরও পর, কদাচিৎ সেখানে পৌঁছিতে পারে
আমাদের শিশুজীবনের প্রথম সকাল।
মূলত বিরতীহীন; গ্রহণযোগ্য রক্তাভ হিংসাত্মক সংশয় এবং
রাজপথে ভ্রাম্যমান কনভয়ের ভিড়ে তোমাকে অভিনন্দন
দৈব মহিমার উপহারে আজ সমস্ত প্রাণময় প্রাচুর্য
যখন দিনের আলো খুলে দেয় জানালার ফালি ফালি কাচ
তখন আরাম কেদারায় বার্ধক্য-লজ্জা
কোণঠাসা শ্বাসরোধে ঝুলে থাকে শুধু
সমস্ত প্রপিতামহের ম্লান কণ্ঠস্বর।
সমাধিলিপি
আন্দিজ অতিক্রম করে যায় সাহস।
সৈনিক আর পর্বতশ্রেণির বিপক্ষে তাঁর যুদ্ধ।
স্পর্ধাই তাঁর তরবারির একমাত্র স্বভাব।
জুনিনের যুদ্ধে তাঁর গৌরব, অনিবার্য বিজয়
এবং পেরুভিয়ান বল্লমে তাঁর স্পেনিশ রক্ত।
তিনি লিখেছেন পৌরুষবীর গাঁথা; সংহত গদ্যে
ঠিক যেন লড়াইয়ের ময়দানে বারাঙ্গনা সঙ্গীত।
দুর্গপ্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্ঠিত তাঁর নির্দয় নির্বাসন।
অথচ এখন তিনি গৌরবদীপ্ত একমুঠো ধুলো!
আবার দেখা হবে
আমার ভালোবাসা আর আমার মাঝে জেগে ওঠে
তিনশ রাতের মত তিনশ প্রাচীর
এবং আমার আর তার মাঝে জন্ম নেয় জাদু সমুদ্র।
অসহ্য সময় চিৎকার করে ওঠে
রাজপথ জমে যায় বুকের ভেতর।
কিছুই অবশিষ্ট নেই, শুধুই স্মৃতি।
(হায়, যন্ত্রণাদগ্ধ দুপুর, রাতের চাহিদায় তুমি,
অলস সময় মলিন আকাশ
পড়ন্ত দেবশিশুর মত জলাশয়ের গভীরে লজ্জা
এবং আমার সেই করুণার জন্যই তোমার জীবন
এবং সেই ঢালু অলস শহরতলি আর আনন্দঘন সময়
আজ আমার জমকালো ভালোবাসার আলোকিত প্রহর…)
মর্মর মূর্তির মতই চূড়ান্ত তোমার অনুপস্থিতি
বিষণ্ন করে তোলে অপরের ভূমি প্রান্তর।
সরলতা
বাগানের লৌহফটক
বিনম্র ভৃত্যের সাথে
যার নিয়ত প্রশ্ন অনুরাগ
এবং কদাচিৎ আমাদের চোখেরা ভেতরের
দেখে না কিছুই
প্রোথিত হয়েছে যা স্মৃতির ভেতর।
সেই উদ্ভাবিত নিজস্ব ভাষা
বুঝে ফেলি সহজাত প্রাণে
এখনও যা সঞ্চয় করে মানবীয় আচরণ।
কিছুই বলার প্রয়োজন নেই
মিথ্যা বলার সুযোগ;
মোড় ফেরা পুরো পথটিই আমার পরিচিত,
ওরা স্পষ্ট খুঁজে পায় আমার দুর্বলতা আর দুশ্চিন্তাসমূহ।
এই ভালো, অতিরিক্ত কিছুর চেয়ে,
সেই কেমন সময়ের মতই আমাদের স্বর্গ উপহার;
আমার সাফল্যে আশ্চর্যের কিছু নেই
বরং সেটিই ঠিক আমার জন্য যা নির্ধার্রিত
যেমন বৃক্ষ আর প্রস্তর খণ্ডের মতই,
বাস্তব সত্যকে করা যায় না অস্বীকার।
অচেনা নগরপথ
কপোত গোধূলি
বিকেলের প্রথম স্পর্শকে বলি মিহিসুতো আঁশ
পদভারে যখন ছায়ারা হয়ে ওঠে না ক্লেদাক্ত
এবং পরিচিত রাত্রির আগমন
যেন অপেক্ষারত সঙ্গীত,
নয় যেন শুধুমাত্র ব্যবহার্য প্রতীক।
সেই সময়ের পরিণত মরুদ্যুতির ভেতর
আমার পদক্ষেপ আবিষ্কার করে এক অচেনা নগরপথ,
প্রবেশদ্বারে প্রশস্ত অভিজাত গৃহছাদ,
দেয়াল আর কার্নিশের আত্মপ্রকাশ
ঠিক আকাশের মতই তার নরম রং
যা আবিষ্ট করে পেছনের দৃশ্য-প্রান্তর।
সহজ গৃহগুলোর সব কিছুই আশ্চর্য আয়তনে ছন্দায়িত,
দরজার হাতল আর গৃহস্তম্ভের জাঁকজমক কৌশল,
বেলকনির রেলিঙে কোন এক বালিকার স্বপ্ন
আমার ভেতরে তার হৃদয়
স্পষ্ট ফোঁটায় ফোঁটায় খসে পড়ে পরিষ্কার চোখের জল।
সম্ভবত সেটাই একমাত্র সময়
নগরপথের গৌরবদীপ্ত দুঃসাহসিক অভিযাত্রা,
দিয়ে যায় স্নেহশীল সুকুমার অধিকার,
রূপকথা অথবা একটি কবিতার মতই জন্ম নেয় বাস্তবতা;
কী নিশ্চিতভাবে আমি বিষণ্ন নিকট দূরত্বকে অনুভব করি
একটি স্মৃতির মতই যার আগমন ক্লান্তিকর
যার একমাত্র কারণ
আত্মার গভীরতম তল থেকে তা উঠে আসে।
ঘনিষ্ট গভীর উত্তেজক, নগরপথের অলৌকিক বিস্ময়
এবং শুধুমাত্র পরবর্তী সময়ে আমি বুঝতে পারি
সেই জায়গাটি ছিল অসম্ভব অচেনা,
সেই প্রতিটি গৃহ এক একটি আলোর দীপাধার
যেখানে জীবন জ্বলে ওঠে প্রতিটি পৃৃথক আলোক শিখায়
আমাদের সেই প্রতিটি নিকটবর্তী পদক্ষেপ
গলগোথাসের ওপর দিয়ে তৈরি করে অপরের পথ।
যেকোনো মৃত্যুতে পাপের জন্য অনুশোচনা
আশা আর স্মৃতির স্বাধীনতা,
সীমাহীন, তন্ময়, নিকট ভবিষ্যৎ
মৃত ব্যক্তি, মৃত নয়; ‘ইহা হয় মৃত্যু’।
ঈশ্বরের মতই দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত রহস্যঘন মহাপুরুষ,
কোন মহিমা ছাড়াই যার প্রশংসা ঘোষিত হয়,
মৃত ব্যক্তি এই ভূগোলে অচেনা আগন্তুক
তুচ্ছ ধ্বংসাবশেষ মাত্র এবং অনুপস্থিত।
আমরা সমস্ত কিছু হরণ করি,
বাদ দেই না কিছুই; একটি রং, একটি অক্ষর।
এখানে বাগান, যার চোখেরা বেড়ে ওঠেনি কখনো,
সেখানে পার্শ্বপথ, যেখানে রাস্তা শুয়ে থাকে আশা নিয়ে বুকে।
এমনকি আমরা যা ভাবতে থাকি
তারাও হয়তো তাই ভাবছে।
চোরের মতই আমরা তার অংশীদার হই।
রাত্রি এবং দিনের বিস্ময়কর ঐর্শ্বয।
যেকোনো সমাধীতে উৎসর্গ
বিপদ মুহূর্তে মার্বেল পাথর অবিবেচক নয়।
ভুলে যাওয়া সমস্ত শক্তির ভঙ্গুর বাচালতা,
অসংখ্য শব্দের পুনরআহ্বান
নাম, যশ, কীতি, জন্মভূমি।
অন্ধকারের সর্বাপেক্ষা বা’ দিকে উজ্জ্বল মণিমাণিক্য
এবং মার্বেল পাথর বলতে পারে না মানুষের অসাধ্য কিছু
অথবা মানুষের জীবনে মৃত্যুর চাহিদা
অথবা কম্পমান ইচ্ছাসমূহ, কষ্টের অলৌকিক প্রচ-তা
অনুভূতির আহলাদে বিস্ময়কর সমস্ত জীবন নেব মেনে
দীর্ঘ দিনের অন্ধ জেদী আত্মার প্রার্থনা
অপরের নিশ্চিত মৃত্যুর পরও
যখন তুমি তোমাকে ক্রমাগত রূপ দিতে থাকো
তারাও যারা তোমার সময়ে নেই
এবং অন্যেরাও থাকবে তোমার অমরত্বে পৃথিবীর বুকে।
শেষ রশ্মি
সূর্যাস্ত সর্বদাই ক্লান্তিকর
যা কীনা নাট্যমঞ্চতুল্য অথবা সমাহিত, বোবা।
অথচ এখন আরও ক্লান্তিকর; ম্রিয়মান সেই শেষ রশ্মিচ্ছটা।
যখন দিকচক্রাবালের বা’ পাশে কিছুই থাকে না
অথবা অস্তমিত সূর্যের জাকজমক কোলাহল
আশ্চর্য দৃঢ়তায় ধরে রাখে সেই শেষ রশ্মিচ্ছটা যেন
টানটান স্নায়ুবিক আত্মপ্রকাশ অথবা
সীমাহীন মহাকাশ অন্ধকারে প্রোথিত মানুষের ভয় মরিচিকা
এবং তাৎক্ষণিক প্রতিহত
মুহূর্তেই বুঝে ফেলি তার আশ্চর্য প্রতারণা;
স্বপ্ন ভেঙে যায়; ঘুমন্ত মানুষ বুঝে ফেলে সে স্বপ্ন দেখছে।
কসাইখানা
গণিকালয় অপেক্ষা নোংরা
মাংসের দোকান সগর্বে প্রকাশ করে নিজেকে
যেন রাজপথে অপমান।
দরজায় গো-শাবক-মস্তক বিস্ময়ে তাকায়, অন্ধদৃষ্টি;
পাহারায় থাকে ডাইনির বিশ্রাম
চামড়াচেড়া মাংস আর মার্বেল পাথরের পাটাতন
কোনো এক প্রতিমার দূরাগত মহিমা।