কবি হেলাল হাফিজ—বোহেমিয়ান জীবনের দুরন্ত প্রতিকৃতি। উড়ন্ত তারুণ্যেই দেখেছেন সাফল্যের সোনালি ঈগল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে সবাই যখন ক্যারিয়ার-চাকরি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন, তিনি তখন রীতিমতো তারকাখ্যাতির অধিকারী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যাবহিত পূর্বের অগ্নিগর্ভ সময়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মিছিলের কণ্ঠে কণ্ঠে আগুন ঝরিয়েছে তার লেখা পঙক্তিমালা। সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়েছে সেই অমর দ্রোহের বাণী—‘এখন যৌবন যার যুদ্ধ যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ যুদ্ধের দামামায় তারুণ্যের মননে ফুয়েল ঢেলে দেওয়া এই কবি জীবনের ৭১ বছর পার করে ফেললেন। ৭ অক্টোবর (২০১৯) কবির ৭১তম জন্মবার্ষিকী ও ৭২-এ পদার্পণের দিন।
তারুণ্যের শুরুতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা কবি হেলাল হাফিজ পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছেন নিজের মতো করেই। আধুনিক সময়ে এসে তার জীবনের দিকে ফিরে তাকালে মনে হয়—ঠিক যেন রূপকথা। কবি যশোপ্রার্থী হিসেবে সংগ্রাম শুরু করার আগেই রাজসিক উত্থান, রূপকথার রাজকুমারের মতো রাতারাতি কবিখ্যাতি প্রাপ্তি, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ‘স্টার লাইফ’। অতপর কী হলো? হুট করেই যেন মঞ্চ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তার কবিতা মুখে মুখে ঘুরতে থাকলো, কিন্তু দৃশ্যমান নন কবি।
এত কম বয়সে (২১ বছর বয়স) জীবিত কোনো ব্যক্তির কবি হিসেবে এত খ্যাতি এই দেশে ব্যতিক্রম, বিশেষ করে একটি আন্দোলনের স্লোগানের নিয়ামক হয়ে ওঠে যখন তার কবিতা, সেই হিসেবে তিনি সৌভাগ্যের বরপুত্র। তবে এই সৌভাগ্যকে তিনি ধারণ করেননি, জীবনের টইটুম্বুর এই সময়টা কাটতে না কাটতেই যেন পায়ে ঠেলে দিলেন ভাগ্যলক্ষ্মীকে। ধীরে ধীরে হয়ে গেলেন ফেরারি।
পরবর্তী দৃশ্যে হেলাল হাফিজ আরও অনেকবার আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ তার একমাত্র মৌলিক কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার মুদ্রিত বইয়ের মর্যাদা পেয়েছে। খ্যাতিময় রাজকীয় ছাত্রজীবন শেষে ব্যক্তি জীবনে অনেকের কৌতূহলের কারণ হয়েছেন এই নিঃসঙ্গ কবি। দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ছড়ানো কবিতা লেখার হাত দিয়েই লিখেছেন প্রেম-বিরহের পঙ্ক্তি।
তবে তাকে নিয়ে সমালোচনারও শেষ নেই। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক তর্কেরও জন্ম দিয়েছেন। নানাবিধ কারণে লেখালেখি থেকে দীর্ঘসময় দূরে থাকলেও নারীর সংস্পর্শে ডুবে থাকার কারণে রমনীমোহন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। মদিরায় মগ্ন ছিলেন, জুয়ার টেবিলে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের অজস্র রাত্রি। অকপটে স্বীকার করেছেন জীবনের নানাবিধ একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ও। এসব কারণে সৃষ্টি হয়েছে বহুমাত্রিক বিতর্ক। তারপরও তিনি টিকে গেছেন, তার খ্যাতিতে আঁচড় কাটতে পারেনি এসব পারিপার্শ্বিক বিষয়, একেবারে নতুন প্রজন্ম পর্যন্ত তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে গেছে। হয়তো তিনি টিকে থাকবেন অনন্তকাল অবধি। অন্তত আমার মতে, বাংলা ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছেন তিনি। বাংলা ভাষায় মানুষ প্রেম-বিরহ কিংবা দ্রোহ প্রকাশ করবে যতদিন, মহাকালের বুকে কবি হেলাল হাফিজও বেঁচে থাকবেন ততদিন।
তবে, কবির জীবন যেমন বহুমাত্রিক রঙিন রঙে রাঙানো, তেমনি বিষাদের নীল জলেও নীলাভ জীবন সাঁতরেছেন তিনি। শৈশবে মাতৃবিয়োগ, খ্যাতির চূড়ায় থাকা অবস্থায় প্রেমিকার প্রস্থান আর পারিবারিক টানাপড়েন তার আবেগকে উত্তাল করে দিয়েছে, সেই ঝড় সামলাতে পারেননি তিনি। একপর্যায়ে দেশত্যাগ করে প্রবাসজীবন, ফের ফিরে আসা। তারপর বুঝলেন—দেশজুড়ে তার জনপ্রিয়তা, জীবনের নিষ্ঠুর ঝড়ের কবলে পড়ে আবেগের কাছে নতজানু কবি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলেন অনেকটা সময়, সেই ঘোর কখনোই কাটেনি; তারপরও নিরবধি কষ্টের সাগরে ডুবে নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন তিনি। কবি হেলাল হাফিজ যেন রঙিন শরাবে টলমল তুমুল একাকীত্বের নিপুণ তাপস।
বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন কবি। সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন, ফিরেও এসেছেন। যথারীতি প্রেসক্লাবেই বসছেন আগের মতো, তবে শরীর অনেকটাই খারাপ। তারপরও মৃত্যু নিয়ে খুব একটা ভীত নন তিনি। প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে দুদিন আগেই কথা হলো, ছোট ভাই শিহরকে নিয়ে কবির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমাদের ফিস কাটলেট, সিঙ্গারা আর চা খাওয়ালেন কবি। অনেক বিষয়ে কথা হলো। কথাপ্রসঙ্গে কবি বললেন, ‘মৃত্যু খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। এটা নিয়ে ভীত নই আমি, তবে খুব ভয় পাই অসুস্থতাকে। কারণ একা থাকি, একা মানুষ। অসুস্থ হলে দেখাশোনার অনেক ব্যাপার থাকে। দেখাশোনা করার কেউ নেই। পাশে একজন মানুষ থাকলে ভালো হতো।’
আজন্ম কষ্টের চোরাবালিতে দেবে থাকার কথা উল্লেখ করলেও জীবন সম্পর্কে খুবেই ইতিবাচক তিনি। জীবনকে মনে করেন একটি উপহার হিসেবে। কবি বলেন, ‘জীবন একটি সৌভাগ্যের বিষয়। শৈশবে মাকে হারিয়েছি, পারিবারিক জীবনটা কষ্টের ছিল, তারুণ্য-যৌবনেও প্রতিনিয়ত দুঃখ-দারিদ্র্যের ভিতর দিয়েই গিয়েছি, পরাজিত হয়েছি। তবু জীবন নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই, কোনো আফসোস নেই, আমি সন্তুষ্ট। আমাকে যদি জীবনের কোনো মুহূর্ত্ব ফিরে পাওয়ার সুযোগের ব্যাপারে বলা হয় তাহলে আমি পুরো জীবনটার কথাই বলবো। জীবন একটা সৌভাগ্য।’
দীর্ঘদিনের পরিচয় থেকে একবার যদি কবির জীবনের দিকে দেখি, আরেকবার দেখি কবিতার দিকে; তাহলে কষ্টের নানাবিধ রঙের খেলা চোখে পড়ে। বিদ্রোহের নানারকম রূপ ধরা পড়ে। প্রেম ও বেদনার অভিমানী কণ্ঠ ভেসে ওঠে। নিজেকে অকপটে গ্রামের পোলা দাবি করে কবির উচ্চারিত স্বাগতোক্তি গিয়ে ধাক্কা মারে উঁচু তলার নৈরাজ্যে। কিন্তু নারী ও প্রেমের প্রতি কবির নৈবেদ্য কোনোটাই জীবনকে স্থিরতা এনে দেয়নি। আসলে আপেক্ষিকতার এই জীবনে কোনোকিছু দিয়েই কোনোকিছুর অভাব পূরণ হয় না। সবকিছুই নিজের স্থানে খানিকটা মৌলিক। কিছু নান্দনিক সঙ্গ, সুগন্ধী সময়, পেলব স্পর্শ কবিকে কি আসলেই জীবন থেকে পালিয়ে থাকতে সাহায্য করেছিল? না কি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বারবার বেদনাকেই জাগিয়ে তুলেছেন তিনি? যেসব তীব্র ব্যথায় জীবনের সব প্রলোভন হাতছাড়া করে অজান্তে পালাতে চেয়েছেন, সেই প্রচেষ্টাগুলোই কী বারবার তাকে নিষ্ঠুর জীবনের মুখে ফিরিয়ে দিয়ে যায়নি?