মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রায় সবকিছুকেই তার নিজের পছন্দের অনুকূলে রাখতে চায়, ভাবতে চায়। অন্যের মাঝে নিজের ছায়া আবিষ্কার করলে খুবই পুলকিত অনুভব করে। একইভাবে সে যা করতে চায় সেটা অন্যের সৃষ্টিকর্মের মধ্যে পেলে অতি সহজেই তার সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এই একাত্মতা ক্রমাগত ওই সৃষ্টিকর্মের অনুরাগী করে তোলে। একসময় হয়ে ওঠে প্রিয়।
সৃষ্টিকর্মটি যদি হয় পাঠ-মাধ্যম তখন একাত্ম হবার এই বিষয়টির সাথে জড়িয়ে যায় দু’টি পক্ষ। লেখক এবং পাঠক। লেখক একাত্ম হবেন তাঁর সৃষ্টির সাথে, সৃষ্টির শিল্পমূল্যের সাথে, অভিজ্ঞতা-অভিজ্ঞানের মেল বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি রচনা করবেন সৌন্দর্য। যে সৌন্দর্যের মাঝে স্বপ্নের মোড়কে থাকবে ‘কী হতে পারতো’ কিংবা ‘কী হওয়া উচিত’-এর আকাঙক্ষা, আর অনাকাঙিক্ষতভাবে যা হয়েছে তার জন্য হাহাকার। অন্যদিকে পাঠক তার নিজস্ব অনুভব-আকাঙক্ষার সাথে মিলিয়ে দেখবেন তার স্বপ্নের জগতের সাথে লেখকের আকাঙক্ষা ও হাহাকার কোনো বিন্দুতে মিলিত হয় কি-না।
দু’টি পক্ষের এই মিথষ্ক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের আধুনিক সাহিত্যের পাঠক-বিমুখতা আর হুমায়ূন আহমেদের বিপুল জনপ্রিয়তার বিষয়টি। আধুনিক কবিতার পাঠক-বিমুখতা নিয়ে অমিয় চক্রবর্তীকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, কবি যতটা উপরে উঠেছেন পাঠক ততটা উঠতে পারেননি। এমতাবস্থায় পাঠককে যেমন উপরে উঠতে হবে কবিকেও নিচে নামতে হবে। তবেই না উভয়ের দূরত্ব কমে আসবে।
এখন প্রশ্ন হলো, হুমায়ূন আহমেদ কি নিচে নেমে এসেছিলেন আর পাঠকও অমিয় চক্রবর্তীর কথা শুনে কি উপরে উঠেছিলেন? সেটা পরখ করতে গেলে ঢুকতে হবে হুমায়ূন আহমদের সৃষ্টির ভেতরের মনস্তত্বে, ঢুকতে হবে পাঠকের মানসকক্ষে।
তবে ওঠা নামার এই পারদে গরজ না দিয়ে কিংবা বাঁদরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠা-নামার অঙ্ক কশা নিয়ে ঘুম হারাম না করেও আমরা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারি হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির স্বাদ গ্রহণের জন্য কাউকে উপরেও উঠতে হয়নি, কাউকে বিশেষ প্রস্ততি নিয়ে নিচেও নামতে হয়নি। এক রহস্যঘেরা ভোরের আলোর মতো সবাইকে ধাঁধিয়ে গেছেন তিনি।আর পাঠকও শুধু বুঁদ হয়নি তার সৃষ্টির প্রতি, হয়েছে নতমুখী।
জনপ্রিয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই নতমুখী হবার বিষয়টি নিয়ে সতীনাথ ভাদুরীও মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, লেখকই পাঠকের চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করেন।
এখন তো আরেকটি প্রশ্ন চলে এলো। সতীনাথ ভাদুরীর কথাটিকে উদাহরণ হিসেবে ধরে নিলে পাঠক চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করার বিষয়টিও বিচার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু তিনি প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে সমান জনপ্রিয়। এমনকি তার জনপ্রিয়তা কেনোদিন কমেনি। দিনকে দিন বেড়েছেই। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যদি ক্রমাগত পাঠকের চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করেন তাহলে চল্লিশ বছর তার দম থাকার কথা নয়। কারণ এতদিনে পাঠকের মানস-রুচি পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু হুমায়ূন আহমদের ক্ষেত্রে তা ঘটতে দেখা যায়নি।
তাহলে কথা উঠতে পারে হুমায়ূন আহমেদ নিজের মতো করে কী সৃষ্টি করলেন? এক কথায় উত্তর হবে ফিকশন। ফিকশন তো আবার দুই প্রকার। লিটারারি ফিকশন আর পাল্প ফিকশন। সাহিত্যিক উপন্যাসকে লিটারারি ফিকশন বলি আর গোয়েন্দা গল্প, সায়েন্স ফিকশনকে বলি পাল্প ফিকশন। লক্ষ করলে দেখা যাবে হুমায়ূন আহমেদ লিটারারি ফিকশনের পাশাপাশি পাল্প ফিকশনও লিখেছেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো তিনি লিটারারি ফিকশনকে যেমন ভেঙেছেন-গড়েছেন তেমনি পাল্প ফিকশনের ভেতরেও ঢুকিয়েছেন লিটারারি ফিকশনের উপাদান। এই অনন্য গুনের জন্যই তিনি অদ্বিতীয়।
কিন্তু তিনি কাজটা কীভাবে করলেন। কাজটা বলতে, বলতে চাচ্ছি ওই যে লিটারারি ফিকশনকে ভাঙলেন-গড়লেন কীভাবে কিংবা পাল্প ফিকশনের ভেতরে কীভাবে মেশালেন লিটারারি ফিকশন। লক্ষ্য করলেই মনে পড়বে বাঙলা ভাষায় প্রথম সায়েন্স ফিকশন (তোমারদের জন্য ভালোবাসা) তার হাতেই লেখা। বিষয়টিকে একটি নিছক তথ্য হিসেবে ধরে এর বিশেষত্বকে পাশ কাটিয়েও যাওয়া সম্ভব। কিন্তু যে জিনিসটিকে অস্বীকার করা অসম্ভব সেটি হলো এর অনন্য কিছু দিক। যেমন বাঙলা ভাষাভাষী পাঠক এই প্রথম সায়েন্স ফিকশনের ভেতর পেল মানবীয় দিক। আগে যেখানে পাঠকের অভিজ্ঞতা ছিল সায়েন্স ফিকশন মানেই জটিল কিছু সূত্রের অবতারণা আর সম্ভব-অসম্ভবের খেলা। হুমায়ূন আহমেদই প্রথম এই প্রচলিত কাঠামো ও উপাদানের বাহিরে গিয়ে সায়েন্স ফিকশনকে করে তুললেন আবেগী আর মানবীয়। কিংবা মিসির আলীর কথাই ধরা যাক। মিসির আলী সিরিজকে আপনি কী নামে অভিহিত করবেন। সাহিত্যের কোন শাখায় এটাকে ফেলবেন? পাল্প ফিকশনের ভেতরে পাচ্ছি গোয়েন্দা কাহিনি। কিন্তু মিসির আলী সিরিজ কি নিতান্তই গোয়েন্দা গল্প? কিন্তু গোয়েন্দা গল্পের অনেক উপাদানই তো এতে রয়েছে। গোয়েন্দা গল্পে বিশেষভাবে বস্তুগত বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। মহামূল্যবান সম্পদ উদ্ধার কিংবা খুনের রহস্য উদঘাটন কিংবা রহস্যঘেরা কোনো পাহাড় বা ভবনের রহস্য উদঘাটনÑ এরকম চিরাচরিত বিষয়, কাঠামো আর উপাদানেই গড়ে ওঠে গোয়েন্দা কাহিনি। মিসির আলি সিরিজেও রয়েছে রহস্যের উদঘাটন-প্রয়াসী মনোভাব। কিন্তু তা কোনো নিতান্তই বস্তুগত নয়। মানুষের মানবিক বিষয়ের, মানবিক বিপর্যয়ের, মনের রহস্যময় অলিগলি আর জটিল মনস্তত্বের রহস্য উদঘাটনে প্রায়সী হতে দেখা যায়। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি যে চরিত্রগুলোর সমাবেশ ঘটান তারা আমাদের সমাজেরই মানুষ। তাদের বিবিধ মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কটের সমাধানের জন্য যে টেকনিকগুলো মিসির আলি ব্যবহার করেন তাও অভিনব কিন্তু প্রয়োগিক। এই অভিনব কিন্তু প্রয়োগিক টেকনিকগুলো যেভাবে আর যে মাত্রায় ব্যবহৃত হতে দেখি তাতে নিছক গোয়েন্দা কাহিনির গোত্র থেকে মিসির আলি সিরিজকে পৃথক করা যায় সহজেই।
মিসির আলি সিরিজের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, রহস্য উদঘাটন করতে গেয়ে অন্যতর বিবিধ রহস্যের ভেতরে চলে যাওয়া। আমরা জানি বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ মানেই নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা মেনে চলার মাধ্যমে বিভিন্ন নিরীক্ষা পরিচালনা করা। এভাবেই একটা সিদ্ধান্তে বা অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। মিসির আলি যেসব পরীক্ষণ পরিচালনা করেন তাতে রহস্য উদঘাটনের পাশাপাশি অন্যতর বিবিধ এবং গভীর কোনো রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
এ তো গেল পাল্প ফিকশনের কথা। তাঁর লিটারারি ফিকশনেও রয়েছে বহুবিধ বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোর সংমিশ্রণ। নন্দিত নরকে (প্রকাশ ১৯৭২, ভ’মিকাঃ আহমদ শরীফ) কাঠামো নিয়ে কোনো নিরীক্ষা করেননি তিনি। কিন্তু যে সাবলীল ভাষা আর দৃশ্যকল্পের ব্যবহার করলেন তাতে মধ্যবিত্তীয় মানস এই প্রথম তাদের জীবনের সাথে অনুপুঙ্খ মিথষ্ক্রিয় উপাদান পেয়ে গেল। ভাষাটা নিজের চেনাজানা, ব্যবহার্য, আটপৌরে। দৃশ্যগুলো চেনা কিন্তু ইতোপূর্বে অনুক্ত। দৃশ্যকল্পগুলো যে নিজেদের ভাবনারই প্রতিচ্ছবি। এর চেয়ে আপন আর কী হতে পারে! এই আপন করা নরকটিই হয়ে উঠলো আমাদের আটপৌরে মধ্যবিত্তের স্পন্দন। কারণ এতেই যে নিহিত ছিল মধ্যবিত্তের প্রাগৈতিহাসিক স্পর্শ। এরপর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ হয়ে অসংখ্য ফিকশনে তিনি কাঠামোগত কোনো নিরীক্ষা চালাননি। জোসনা ও জননীর গল্প (২০০৪)-এ এসে তিনি ভেঙে ফেললেন উপন্যাস সঙক্রান্ত যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের কাঠামোকে। একাধিক কাঠামো আর ঢঙের সংমিশ্রণ ঘটালেন তিনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত এই উপন্যাসে তিনি প্রথম দেখালেন উপন্যাস কীভাবে ইতিহাসের মৌলিকত্ব ধারণ করে সত্যনিষ্ট হতে পারে। দেখালেন চরিত্র ও গল্পের ভেতরে কীভাবে লেখক তার স্বীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢুকে পড়তে পারে। দেখালেন কাহিনি বলছি তা নিছক কাহিনি নয়, দেখালেন কাহিনিটি ইতিহাসের একেবারে মৌলিক অংশের সাথে কীভাবে মিশে যাচ্ছে, সেই মৌলিক ইতিহাসের সাথে নিজের সম্পৃক্ততায় তা আরো কীভাবে জীবন্ত হয়ে উঠছে। সাহিত্যের পাঠক এই প্রথম দেখলো এক উপসংহারিক বৈপরীত্যÑ
‘মরিয়ম যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে আছে। যুবকের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলছে,Ñ আহা এইভাবে সবার সামনে আমাকে ধরে আছো কেন? আমাকে ছাড় তো। আমার লজ্জা লাগে।
নাইমুল কিন্তু তার স্ত্রীকে ধরে ছিল না। তার হাত এখনো প্রসারিত। কঠিন হাতে নাইমুলকে জড়িয়ে ধরেছিল মরিয়ম নিজেই।
পাঠক, মহান বিজয় দিবসে যে গল্প শেষ হবে সেই গল্প আনন্দময় হওয়া উচিত বলেই আমি এরকম একটা সমাপ্তি তৈরি করেছি।
বাস্তবের সমাপ্তি এরকম ছিল না। নাইমুল কথা রাখে নি। সে ফিরে আসতে পারেনি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথায় তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়। এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায় আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোসনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহারে! আহারে!’ (জোসনা ও জননীর গল্প)।
জোসনা ও জননীর গল্পের এই উপসংহারিক বৈপরীত্য এক অনন্য স্মারক। গল্পের এই বৈপরীত্যের জন্য এর গভীরতা স্পর্শ করেছে শিল্পের চূড়ান্ত মহিমা। পাঠক হিসেবে যতবার এই অংশ পড়েছি ততবারই চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। মিলেন কুন্ডেরা তার দ্য আর্ট অব নভেল গ্রন্থে বলেছেন, ঔপন্যাসিক ইতিহাসবিদ নন, ভবিষ্যৎ বক্তাও নন, তিনি হলেন অস্তিত্বের পরিব্রাজক’। হুমায়ূন আহমেদের এই উপন্যাস বা লিটারারি ফিকশন যেন কুন্ডেরা কথিক অস্তিত্বের যথার্থ পরিব্রাজক।
লিটারারি ফিকশনের কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য ভাঙার এধরনের সফল প্রয়োগ তার পরবর্তী প্রায় সকল বৃহৎ সৃষ্টির মধ্যেই লক্ষণীয়। মধ্যাহ্ণ, মাতাল হাওয়া, বাদশাহ নামদার, দেয়াল প্রভৃতি ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাসে তিনি ইতিহাসের সত্যের একনিষ্ট পরিব্রাজক হয়েও সফল। উল্লেখিত লিটারারি ফিকশনগুলোর রয়েছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা। ব্যঞ্জনাটি ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ ক্ষণের উপর আলো ফেলায়, সেখান থেকে বের করে আনা বিশেষ বাঁকটি, সেই বাঁকটিকে ঘিরে থাকা অসংখ্য মানুষের গল্প বলায়। তিনি আসলে এগুলোর আশ্রয়ে গল্পই বলতে চেয়েছেন। উপলক্ষ করেছেন বিভিন্ন সময়ের। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মানুষের গল্প বলার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন ‘জোসনা ও জননীর গল্প,’ মানুষের জটিল মনস্তত্ত্বের গল্প বলার জন্য বেছে নিয়েছেন ‘কে কথা কয়’। বঙ্গভঙ্গ, দেশভাগ, দেশভাগের ক্ষত, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা, বিশ্বযুদ্ধ, গান্ধী, জিন্নাহ, রবীঠাকুর, নজরুল, সুভাষ বসু, জয়নুল, হাওড় অঞ্চলের মানুষের দুঃখ গাঁথা সর্বোপরি উনবিংশ শতাব্দীর মানুষের সুখ দুঃখের আর স্বাধীনতান্মুখতার গল্পগুলো বলার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন ‘মধ্যাহ’è। মোটাদাগে মধ্যাহ্ন উপন্যাসটি যেন স্বাধীনতার উপন্যাস। উনবিংশ শতব্দীর সূচনা দিয়ে যার শুরু দেশভাগের পূর্ববতী সময়ে যার সমাপন। একদিকে দেশভাগ অন্যদিকে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা। দাঙ্গা মেটানোর জন্য নানাবিধ চেষ্টা। রাশিয়ার জারতন্ত্রেও কথা উঠে আসে এখানে। আসে ম্যাক্সিম গোর্কির একটি নতুন উপন্যাসে হাত দেয়ার কথা। উপন্যাসটির নাম মা। সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে বসবাসকারী আইনস্টাইন একটি থিসিস লিখেছেন। সেটি পড়ে মার্কস প্ল্যাঙ্ক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। কারণ এযাবৎকালেল পদার্থবিদ্যার সকল চিন্তাভাবনার অবসান হতে যাচ্ছে। বুঝা যাচেছ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথার বলছেন না তিনি, বলছেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা, বিবেকের স্বাধীনতার কথা, চিন্তার স্বাধীনতার কথা, চর্চার স্বাধীনতার কথা। ব্যক্তি ও নারী স্বাধীনতার কথাও। এই উপন্যাসের এক চরিত্র চান বিবি ওরফে জুলেখার নগ্ন হয়ে পুকুরে সাঁতার কাটার মধ্যেও নিহিত রয়েছে মানবমনের গূঢ় স্বাধীনতার কথা। ধর্মের স্বাধীনতার কথা এসেছে আরো জোরালো ভাবে, শাণিত রূপে, প্রকাশ্যে। সকল ধর্মে সংস্কাররের অন্তঃসারশূন্যতাকে তিনি ফালি ফালি করে ব্যবচ্ছেদ করেছেন। এরপর উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লেখা ‘মাতাল হাওয়া’। ভ’মিকায় তিনি জানাচ্ছেন, মানুষ চন্দ্র জয় করে উনসত্তরে।’ কীসের ইঙ্গিত দেন তিনি এতে! উনসত্তরের নায়ক খলনায়ক সবাই এখানে এসেছে স্বমহিমায়। রয়েছে বেদনা বিধুর গল্পের প্রবাহ। তারপর ‘দেয়াল’। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পটভূমিতে লেখা উপন্যাসটি নানা কারণে বিতর্কিত। তিনি এই উপন্যাসের মাধ্যমে উস্কে দিয়েছেন কিছু বিতর্ক। উপন্যাস যখন লিটারারি ফিকশন তখন তার ইতিহাসের একক সত্যনিষ্ঠার কাছে দায় কতখানি। উপন্যাস তো উপন্যাসই, ইতিহাস থেকে যদি কিছুটা চ্যূত হয়েই যায় তাহলে ক্ষতিটাই বা কি? ইতিহাস চ্যূত হলে উপন্যাসটির ঐতিহাসিক মূল্যই বা কোথায়? আবার দুইয়ের লব্ধিকে এক করলে কি এর শিল্পমূল্য রক্ষিত হয়?
এতসব বিতর্কের জন্ম দিয়েও ‘দেয়াল’ দাঁড়িয়ে গেছে দেয়াল হয়ে। যেখানে ইতিহাসের সত্য আর গল্পের সত্য এক হয়ে যায়। যেখানে ইতিহাসের দায় আর আবেগের সত্য হাত ধরাধরি করে চলে। যেখানে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো ফুটে ওঠে তার স্বমহিমা নিয়ে।
ফিকশনের ভেতরে এরকম নন-ফিকশনাল উপকরণ, গল্পের দাবির কাছে ইতিহাসের সত্যনিষ্টতা, ভাষার সহাবস্থানের সাথে চরিত্র ও সময়ের গভীর স্পর্শ যে শিল্পকুশলতায় ফুটে উঠেছে তা হুমায়ূন আহমেদের বিশাল ক্ষমতারই প্রকাশ। কিন্তু সমালোচকদের মুখও তো খোলা। তাইতো বলতে শোনা যায় এইসব উপন্যাসের (সমালোচকের ভাষায় তথাকথিত) ভেতরে জন্ম নেয়া অসংখ্য ডালপালার পরিণতিহীনতার দায় কার। এর উত্তরে বলা যায় হুমায়ূন আহমেদ আসলে কোনো বাহবা পেতে চাননি, তিনি নন্দনতাত্তিকের সার্টিফিকেট নেবার জন্য প্রচল কাঠামোর ভেতরে তথাকথিত গল্প বা উপন্যাস লিখতেও বসেননি। তিনি আসলে মানুষের গল্প বলতে চেয়েছেন। মানুষের গল্পই বলতে চেয়েছেন। তাইতো প্রচল কাঠামোর ভেতরে তিনি অপ্রচল উপাদান ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাতে হয়তো অসংখ্য ডালপালার জন্ম হয়েছে যা সফল পরিণতি পায়নি। কিন্তু এ তো মনুষেরই গল্প। তাতে নন্দনতাত্ত্বিকরা বেকায়দায় পড়লে তাঁর যে কিছুই করার নেই। হৃদপিন্ডের তো অবয়ব আছে। নন্দনতাত্ত্বিকেরা হয়তো বা সেটাই চান। কিন্তু হৃদয়! হৃদয়ের তো অবয়ব নেই। হুমায়ূন আহমেদ সেই হৃদয়েরই কথা বলেছেন।
ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপলস্্ অব দ্য মেটাফিজিক্স অব মোরালিটি গ্রন্থে বলা হচ্ছে, সৃষ্টির রাজত্বে সবকিছুর হয় মূল্য আছে, নয়ত আছে মর্যাদা।’ বোধ করি হুমায়ূন আহমেদ সেই ক্ষণজন্মা কথাসাহিত্যিক যার সৃষ্টির যেমন রয়েছে মূল্য তেমনি রয়েছে মর্যাদা।
০৮-০৭-২০১৪