বাংলা সাহিত্য জগতে এক অপার বিস্ময়ের নাম হুমায়ূন আহমেদ। তিনি প্রয়াত হয়েছেন দশ বছর হলে। আজও তার বই একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। তা বিক্রির তালিকায় ভালো অবস্থানে থাকে। আশির দশক থেকে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তাকে কেউ টপকাতে পারেননি। আজও তা অক্ষুণ্ন রয়েছে। তার সমসাময়িক ও অগ্রজ-অনুজ বহু লেখক আছেন কিন্তু তার ধারে-কাছেও যেতে পারেননি জনপ্রিয়তায়। ঠিক সেই কারণেই একজন হুমায়ূন আহমেদের প্রচণ্ড অভাববোধ করে বাংলা সাহিত্য। আগামী কত বছরে সেই খরা কাটবে তা বলা যায় না।
পাঠকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তার সৃষ্টির মাধ্যমে। সৃষ্টি হলো একটি সেতু ও লেখকের আয়না; যা তাকে পাঠকের কাছে প্রকাশিত করে। তা হোক নেতিবাচক বা ইতিবাচক। সাহিত্যকর্ম কেন সৃষ্টি হয়, এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো পাঠকের জন্য। পাঠক পাঠ করে আনন্দ পায়। আত্মার ক্ষুধা মেটায়।
একটা কথা মেনে নিতে হয়, যে লেখকের লেখা পাঠকের অন্তরে স্থান করে নেয়, তিনিই লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তাও পান। পাঠক মজে থাকে লেখকের লেখার জাদুতে। হুমায়ূন আহমেদ এখনো প্রাসঙ্গিক। তার মতে করে কেউ হিমু বা মিসির আলীর মতো চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেননি, আজও।
বেঁচে থাকতে হুমায়ূনআহমেদের সামনে পেছনে নামি-দামি প্রকাশকদের ভিড় থাকতো, একটা বই পাওয়ার আশায়। একথা স্বীকার করছি এই বিপুল লেখা লিখতে গিয়ে লেখার চাপে অনেক লেখাই হালকা হয়েছে। সাহিত্যের মানদণ্ডেও তা ভারী নয়। কিন্তু এই চাপটা তাকে নিতে হয়েছে। কারণ বাজারে তার বইয়ের আকাশসমান চাহিদা। পাঠকের বিপুল চাপ। আজ কি পাঠকের চাপ রয়েছে? কোনো লেখকের বই বইমেলায় এলেই পাঠক সিরিয়াল দিয়ে সেই বই কিনছে? না। উল্টো বাংলা সাহিত্য পাঠক হারাচ্ছে; এমনটাই সবার ধারণা। কেউ গল্পের বই আজকাল পড়তে চায় না।
যেমন কেউ হুমায়ূন আহমেদের হিমু সেজে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, ঠিক এসব কারণেই যুগের পর যুগ হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে প্রাসঙ্গিক থাকবেন বলে বিশ্বাস।
সময় ক্রমশই হুমায়ূন আহমেদকে হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। হয়তো কিছুটা অনুকূল পরিবেশও পেয়েছিলেন। তবে সৃষ্টির বৈচিত্র্যতায় হুমায়ূন আহমেদের তুলনায় তার সমসাময়িক কেবল হুমায়ূন আহমেদই ছিলেন। তার কর্মের বহুমুখিতা ও সংস্পর্শী চিন্তাচেতনা যা পাঠকে বা তার নাটক-সিনেমার দর্শককে পাগলের মতো টেনেছে। পাঠক মাত্রই বৈচিত্র্য চায়। লেখকের কাজই হলো লেখায় বৈচিত্র্য তৈরি করা। ঠিক এই কাজটি হুমায়ূন আহমেদ করতে পেরেছিলেন।
যারা বই থেকে সরে যাচ্ছিলেন, তাদের আবার পাঠে ফিরিয়েছেন। দর্শককে টিভির পর্দায় টেনেছেন। বাকের ভাইকে জীবন্ত করেছেন। তার ফাঁসি ঠেকানোর দাবিতে মিছিল পর্যন্ত হয়েছে। এক অকল্পনীয় ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে সে সময়। পাঠক-দর্শক তখন মিলে মিশে একাকার। যে হুমায়ূন আহমেদের পাঠক, সে-ই আবার তার নাটক-সিনেমার দর্শক। গানগুলোকে চিরাচরিত রূপ থেকে বের করে একটি আলাদা ধাঁচে তৈরি করেছেন। সে কারণেই তার সিনেমার গানগুলো দর্শকের হৃদয় কেড়েছে। এটা হলো কৌশল। একই জিনিস পড়তে বা দেখতে বা শুনতে শুনতে যখন সকাই ক্লান্ত ,তখন হুমায়ূন আহমেদ ভিন্নতা এনেছেন। এখানেই তিনি সবার থেকে আলাদা।
কাজের প্রতি একাগ্রতা তাকে হুমায়ূনআহমেদ করে তুলেছে। তার গল্পে-উপন্যাসের চরিত্রগুলো বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত চরিত্র হয়ে উঠেরেছ। সেই চরিত্রগুলোই তাকে বাংলা সাহিত্যে আজীবন প্রাসঙ্গিক করে রাখবে।
১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়, তখনই বোঝা গিয়েছিল কথাসাহিত্যের বিশাল জগতে তিনি অল্প সময়ের জন্য আসেননি, তিনি এসেছেন রাজত্ব করতে। তার পাঠক শ্রেণী ছিল আলাদা। যারা গোগ্রাসে তার লেখা পড়তো। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাত্রা অসাধারণ দক্ষতায় তুলে এনেছেন। অবশ্য তার সমালোচক শ্রেণীরও অভাব ছিল না। সমালোচনা তার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তিনি তার লেখার ধরন নিজের মতো ঠিক রেখেছেন। সে সমালোচনা তাকে আরও উঁচুতে পৌঁছে দিয়েছে। হুমায়ুন আহমেদের লজিক ও আ্যান্টিলজিক চরিত্র হিমু ও মিসির আলী; দুটিই আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। এ চরিত্র নিয়েই দেশে বহু আলোচনা হয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টাও করা হয়েছে। অনেক সময় চরিত্র দুটির স্রষ্টাকেই এই চরিত্রের সত্যিকারের মানুষ বলে মনে হয়েছে।
উপন্যাস বা ছোটগল্পের চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে কল্পনা করেও অনেক পাঠক তৃপ্তি পান। যেমন কেউ হুমায়ূন আহমেদের হিমু সেজে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, ঠিক এসব কারণেই যুগের পর যুগ হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে প্রাসঙ্গিক থাকবেন বলে বিশ্বাস।