খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষ ভ্রমণ করতে এসে চৈনিক বৌদ্ধশ্রমণ ও পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ‘কুমিল্লা রাজ্যে’ এসেছিলেন। এই আগমনের বর্ণনা ৬৪৬ সালে তিনি লিপিবদ্ধ করেন। শতাধিক রাজ্য ভ্রমণের বহুমূল্য প্রাচীন ভ্রমণলিপিটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫৭ সালে ফরাসি ভাষায়। অনুবাদ করেন চীন-বিশেষজ্ঞ স্তানিসলাস জুলিয়েন। তারও ছাব্বিশ বছর পর ১৮৮৪ সালে ইংরাজিতে অনুবাদ করেন স্যামুয়েল বিল (১৮২৫-১৮৮৯)। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও দূরত্বের যথার্থ বর্ণনার কারণে বইটি মধ্যযুগের দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস উদ্ঘাটনে বিশ্বস্ত প্রদীপের মতো কাজ করে।
এই ভ্রমণলিপি থেকে মানচিত্রের পাঠোদ্ধার করেন প্রখ্যাত ফরাসি ভূগোলবিদ লুইস ভিভিয়েন দ্য সেন্ট-মার্টিন (১৮০২-৯৭)। প্রায় একই সময় উনিশ শতকে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপে কাজ করতে বাংলায় আসেন আরেক ব্রিটিশ সামরিক প্রকৌশলী আলেক্সান্ডার কানিংহাম (১৮১৪-১৮৯৩)। এক পর্যায়ে তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাস ও প্রত্নত্ত্ব নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পুরাকীর্তি অনুসন্ধানে তার নিজস্ব আগ্রহের কারণে ১৮৬১ সালে সরকার তাকে ভারতবর্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনার দায়িত্ব দেন। মূলত কানিংহামের হাত ধরেই ব্রিটিশ বাংলায় রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের সূচনা ঘটে। টানা ১০ বছর বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন ও ধ্বংসাবশেষে জরিপ চালানোর পর কানিংহাম ইংল্যান্ড ফিরে যান।
১৮৭১ সালে কানিংহামের জগদ্বিখ্যাত বই Ancient Geography of India প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত তিনি ওই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। বইটিতে ভারতে বৌদ্ধ যুগ সম্পর্কে নানা ঐতিহাসিক তথ্য সন্নিবেশন করেন তিনি। বহিঃবিশ্বে হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণলিপির প্রথম অনুবাদ ফরাসিতে হওয়ায় (স্তানিসলাস জুলিয়েন, ১৮৫৭) তৎকালীন ফ্রান্সের অনেক গবেষক ওই লিপির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেন। সাংয়ের বর্ণনা অনুসরণ করে ভূগোলবিদ ভিভিয়েন প্রাচীন ভারতের মানচিত্রে ‘কুমিল্লা’ নামের রাজ্যটির অবস্থান চিহ্নিত করেন। এই চিহ্নায়ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও সময়ের হিসাবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য। সাংয়ের বর্ণনায় পাই, তিনি সান-মো-টা-চা (san-mo-ta-cha বা সমতট) রাজ্য থেকে উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে শিলি-চা-তা-লো (Shili-cha-ta-lo বা সিলেট) প্রবেশ করেন। সেখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকের রাজ্য ‘কুমিল্লা’ আসেন। পরিভ্রমণকালীন সংলগ্ন আরও কয়েকটি রাজ্যের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। নিজ ভাষার ধ্বনিরূপ অনুসারে ভিনদেশি সাং রাজ্যগুলোর নাম লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ভ্রমণলিপিতে তিনি যে ‘কুমিল্লা রাজ্যে’র নাম উল্লেখ করেছিলেন, ফরাসি ভাষান্তরে যা Kia-mo-lang-kia বা কিয়া-মো-লাং-কিংয়া নামে পাওয়া যায়। পরের মুখে মরিচের স্বাদ যেমন হয়! বেশির ভাগ ঐতিহাসিক একে তৎকালের রাজভাষা সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত ‘কমলাঙ্ক’ বা Kamalanka বলে মত দিয়েছেন। নামের মিল ও স্থানিক বিবরণের তুলনা করে নামটি আজকের ‘কুমিল্লা’ বলেই মনে করি। তৎকালীন ‘কমলাঙ্ক’ নামটিও প্রাকৃতজনদের মুখে বিবর্তনসূত্রে সরলীকৃত উচ্চারণে আজকের ‘কুমিল্লা’ রূপ পায়। ‘কুমিল্লা’ নামটি মোঘল বা ইংরেজ শাসনামলেও সুপ্ত অবস্থায় ছিল না। এসব বিবেচনায় বলতে পারি, সংস্কৃত ‘কমলাঙ্ক’ শব্দটির অপভ্রংশ কুমিল্লা হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, তাহলো প্রাচীন সমতট রাজ্যের অবস্থান নিয়ে অধিক বিতর্ক আছে। হিউয়েন সাং পুণ্ড্রবর্ধন (মহাস্থনগড়, বগুড়া) থেকে একটি মস্ত নদী (যমুনা) পার হয়ে প্রায় ৪০০ কি.মি. (৯০০লি.) দূরবর্তী কামরূপ রাজ্যে প্রবেশ করেন। বর্তমান ভারতের মেঘালয়ের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় (আসামের গোয়াহাটি) কামরূপের অবস্থান, সেখানকার বিহার ও বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার কথা সাং বলেননি। এই কামরূপের পূর্ব দিক পর্বতঘেরা ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের বন্য হাতির বিচরণের কথা সাং উল্লেখ করেছেন। কামরূপের দক্ষিণ দিকে আরো ৪০০ কি.মি. ভ্রমণ করে সাং সাগর পাড়ের ‘সমতট’ রাজ্যে পৌঁছান। পুণ্ড্রবর্ধনের অদূরে থাকা যে সম্রাট অশোকের ‘বৌদ্ধস্তূপ’-এর কথা সাং বলেছিলেন, সমতটে এসেও তিনি অদূরের একই ‘বৌদ্ধ-স্তূপে’র কথা বলেছেন। ‘সমতট’ থেকে পরে তিনি উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ‘সিলেট রাজ্যে’ পরিভ্রমণ করেন। পথ ও মানচিত্র হিসাব করলে আমি সমতটের অবস্থান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে পাই। অতীশ দীপঙ্করসূত্রে বিক্রমপুর নিয়ে সাধারণের মধ্যে আগ্রহ থাকলেও মাত্র ছয় বছর আগে (২০১০) এখানে স্থানীয় একটি সংগঠনের মাধ্যমে পুরাকীর্তির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পরের বছর সরকারিভাবেও কিছু খননের পর বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়। এসব বিবেচনায়,আজকের বিক্রমপুরকেই সমতট রাজ্যের কেন্দ্র বলা যায়।
দুঃখজনক হলো, বিদেশের ঠাকুর ছাড়া আমরা আমাদের নিজস্বতা খুঁজে পাই না! আমরা কথা ও আবেগ নির্ভর বক্তৃতাবাজি করে সবকিছু প্রমাণ করে দিতে চাই। বিক্রমপুরে অতিসম্প্রতি এই পুরাকীর্তি আবিষ্কৃত হলেও ঐতিহাসিক পাঠের যোগসূত্র আমরা অদ্যাবধি খুঁজিনি।
প্রত্নত্ত্ববিদ কানিংহাম তার বইতে (পৃ. ৫০৩) লিখেছেন, Shili-cha-ta-lo, which was situated in a valley near the great sea, This name is probably intended for Sri-Kshatra, or Sri-Kshetra, which M. Vivien de Saint-Martin has identified with Sri-hata, or Silhat, to the north-east of the Gangetic Delta. This town is situated in the valley of the Megna river, and although it is at a considerable distance from the sea, it seems most probable that it is the place intended by the pilgrim. The second country is Kia-mo-lang-kia, which was situated beyond the first, to the east, and near a great bay. This place may, I think, be identified with the district of Komilla, in Tipera (বাংলার দিওয়ানিসূত্রে ব্রিটিশরা এসে জেলা সদরের নাম কুমিল্লা অপরিবর্তিত রেখেই পাহাড়ি ত্রিপুরার মহারাজার জমিদারিকে ত্রিপুরা নামে অভিহিত করে। -লেখক), to the east of the Megna river, and at the head of the Bay of Bengal. ‘
মনে রাখতে হবে, ওপরের কথাগুলো যখন লেখা হচ্ছে, তখনো শালবন বিহারের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়নি। ফরাসি ভূগোলবিদ ভিভিয়ান ও ইংরাজ প্রত্নত্ত্ববিদ কানিংহামের ঐকান্তিক চেষ্টায় হিউয়েন সাংয়ের লিপি ও মানচিত্রের পাঠোদ্ধারের আরো সত্তর বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সেনাছাউনি স্থাপনের জন্য লালমাই পাহাড়ের একটি ঢিবি পরিষ্কার করার সময় আজকের শালবন বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়। যুদ্ধোত্তর ব্রিটিশরা চলে গেলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার খননকার্য চালিয়ে প্রাচীন ‘কুমিল্লা রাজ্যে’ র অত্যাশ্চার্য সব নিদর্শন উদ্ধার করে। বাংলার ইতিহাসে যোগ হয় এক নতুন সভ্যতার কথা। গোমতি পারের ছোট্ট ময়নামতি গ্রামের নাম সংযুক্ত করে পুরাকীর্তিটি তখন চিহ্নিত করা হয়। খননের ফলে নবলব্ধ ঐতিহাসিক এই পুরাকীর্তি নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ব্যাপকভাবে তখন ময়নামতি নামটি বিভিন্ন লেখালেখিতে ব্যবহার হতে থাকে। গবেষকরা হিউয়েন সাংয়ের বর্ণনা অনুসরণ করে অনাবিষ্কৃত ‘সমতট’ কে শালবন বিহারের সঙ্গে মিলিয়ে নেন এবং আমরা সেই বর্ণনা পড়ে আত্মতৃপ্ত থাকি। নতুন তথ্যে গবেষকরা মত পাল্টান, আমরা পাল্টাই না।
হাজার বছর আগে হিউয়েন সাং যে ‘কুমিল্লা’ রাজ্যের উল্লেখ করে গেছেন, ঐতিহাসিক নিদর্শনের বস্তুনিষ্ঠ বিচারে শালবন বিহার আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়ে যাই সেই কুমিল্লা রাজ্যের কেন্দ্রটি; যা আজকের কুমিল্লা সদর উপজেলায় অবস্থিত। কুমিল্লা নামটি তাই হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে। এই নামটি আড়াল করা হলে এই ঐতিহ্যকে আড়াল করা হবে। আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে তাই আমার মতো নগণ্যকেও পাঠ ও পর্যবেক্ষণের এই সূত্র খুঁজে নিতে হয়েছে।
ঐতিহ্য অন্বেষণে ও ধারণে বাঙালির অবদান কই? দুঃখজনক হলেও সত্য, গৌরবের ইতিহাসকে আড়াল করতে বাংলা জনপদের অনেককেই আজ তৎপর হতে দেখি। ইতিহাসের পাঠন্মোচনের কারণেই একথা মানতে হবে, ঐতিহাসিক ‘কুমিল্লা রাজ্য’আর আজকের কুমিল্লা একসূত্রে গাঁথা। অন্য নামে কুমিল্লাকে আড়াল করলে আত্মপরিচয়কেই আড়াল করা হবে।