কবিতা গভীর অনুভবের বিষয়, শৃঙ্খলমুক্তির আহ্বান। শব্দ, চিত্রকল্প, প্রকরণ, আঙ্গিক বিশ্লেষণ করে কবিতাকে যাচাই করা যুক্তিহীন। বিজ্ঞান, দর্শন ও অর্থনীতির মতো বোঝার বিষয় কবিতা নয়। এটি রস ও আবেগ প্রকাশের প্রপঞ্চ। হাসান হাফিজ- একজন কবি, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সব পরিচয় ছাপিয়ে, তিনি মূলত একজন কবি। এ সময়ের মেধাবী কবি।
কবিতায় ছন্দের স্পন্দন সৃষ্টিতে এই কবি খুব যত্নবান। তিনি বিশ্বাস করেন- সংখ্যাগরিষ্ঠ কবিরা কখনো প্রসিদ্ধ কবিতার জনক হতে পারে না। হাসান হাফিজ, কবিতা চর্চায় বেশ আত্মসচেতন। কবিতাকেন্দ্রিক সমস্ত তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলে তিনি নিজস্ব ধারা ও আঙ্গিক চর্চায় মগ্ন। কবিতা নিয়ে তিনি নিবিড় অভিলাষে যেন একা জেগে আছেন। সংবেদনশীল কারুকাজ, মার্জিত চিত্রপ্রণালি বা লোকঐতিহ্য যত্ন করে কবিতার বিষয় করেছেন। যে কারণে একদিকে ঘটেছে প্রচলিত ধারার ভাঙ্চুর, অন্যদিকে সৃষ্টিকল্পের প্রত্যাবর্তন।
হাসান হাফিজের জন্ম ১৫ অক্টোবর ১৯৫৫, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার এলাহিনগর গ্রামে। তাঁর লেখা প্রথম ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে, যখন ছিলেন স্কুলছাত্র।
এ পর্যন্ত তাঁর বই বেরিয়েছে ১২০টির বেশি। এরমধ্যে মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৪০।
সাংবাদিকতা পেশায় রয়েছেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। এই সময়ে কাজ করেছেন অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা, দৈনিক জনকণ্ঠ, কলকাতার সাহিত্য দেশ (এখন পাক্ষিক), বৈশাখী টেলিভিশন ও আমার দেশ-এ।
কবি, প্রাবন্ধিক গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ঝোড়ো আকাশে নয়, নীলাকাশে বিদ্যুতের এ মুড়ো ছুটে যাওয়াই কবিতা। অর্থাৎ পরম্পরা। অর্থাৎ ধারাবাহিকতা। ধারাবাহিকতার মধ্যে নতুনের উন্মেষ। হাসান হাফিজ তাঁর কবিতার পর কবিতায় অনির্ণেয় অন্য কোনো মানে খুঁজে চলেছেন। এটাই কবিতার কাজ। কবির কাজ।’
হাসান হাফিজের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে: ‘এখন যৌবন যার’ ‘ভালোবাসা, তার ভাষা,’ ‘অবাধ্য অর্জুন’, ‘তুমি বধূ অবিবাহের’, ‘হয়তো কিছু হবে’, ‘হাসান হাফিজের প্রেমের কবিতা’ দূরে পাহাড়ের ঘুম, সকল ডুবুরি নয় সমান সন্ধিৎসু, তৃষ্ণার তানপুরা, ‘ভালোবাসার অগ্নিচমুক,’ ‘হৃদয় বড়ো কাঁদছে’, ‘না ওড়ে না পোড়ে প্রেম’, ‘যে মধুমদ তোমার ফুলে’, ‘বিভ্রমের বিষলতা’, ‘স্তবগান সুন্দরের’ ইত্যাদি।
তাঁর কবিতা থেকে উদ্ধৃতি-
আজ সারারাত্রি থাকো
আমার সঙ্গিনী হয়ে
তুমি স্বপ্ন, মানুষের আকৃতি স্বভাব
তোমার অস্তিত্ব মাঝে
কেন খুঁজে দেখতে যাই
তুমি তো দুর্জ্ঞেয় জানি
তারপরও বুঝে দেখতে চাই।
(তাচ্ছিল্য ও হেলাফেলা কেন)
প্রথমে কবিতার অর্থ নয়, বন্ধনহীন আবেগ পাঠককে উৎফুল্ল করবে।
রাত্রি ও সঙ্গিনীর স্কেচে ছন্দস্নাত পঙ্ক্তিগুলোর ধারাবাহিকতায় ‘তাচ্ছিল্য ও হেলাফেলা কেন’ শিরোনামে কবিতা সার্থক হয়ে উঠেছে। কবি এখানে তারুণ্যস্নাত আবেগকে পুঁজি করে দরদি উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন। বিশেষভাবে মনন ও কল্পনার দেয়ালে রোমাঞ্চ রঙে-ঢঙে মেলে ধরার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
লিখতে লিখতে তোমাকে ফুরিয়ে ফেলি।
নিঃশেষ ছাইয়ের পুঞ্জ ফুঁড়ে তুমি বারবারই
আবির্ভূত, জীবন আশ্চর্য ঢেউ, তুমি কি ফিনিক্স?
তোমার বিভ্রম কিংবা পথভ্রান্তি বলে কিছু নেই?
এতোটা গোলকধাঁধা মরীচিকা ভ্রম ভেঙে
কী করে নির্দিষ্ট খামে নিপুণ প্রবেশ করে।
(আশকারা পেয়েছে বলে)
তীক্ষ্ম অথচ আবেগমথিত আহ্বান। সবাই আশকারা পেলে পথভ্রান্ত পথে হেঁটে যেতে চায়। আশকারায় যেখানে ভাঙচুর করে, অবিশ্বাস সেখানে বংশবিস্তার করে। কবি হাসান হাফিজ রহস্যের ভেতরবৃত্তে প্রবিষ্ট হয়ে কবিতার নৈপুণ্য প্রকাশ করেছেন। এখানে তিনি পুরোপুরি সার্থক।
কবি হাসান হাফিজ কবিতায় শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগ সর্বাপেক্ষা যত্নবান। কবিতার স্তরে স্তরে জীবনের সঙ্গে স্বপ্নের রঙিন আলোকরশ্মি সমীকরণের নান্দনিক ব্যবহার পাঠকচিত্তকে মুগ্ধ করে। ভদ্র-শান্ত বিনয়ী স্বভাবের কবি হাসান হাফিজ বিশ্বাস করেন, প্রকৃত মনের মানুষ না হলে প্রকৃত কবি হওয়া যায় না। কবিদের শিষ্টাচার চর্চা আবশ্যক। আর অহঙ্কার কবির অন্বিষ্টের জন্য ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে।
হাসান হাফিজের কবিতায় নগর, নিসর্গ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রকৃতির জন্য গভীর মমতা ও যত্নের ছাপও। মানুষ-সমাজকল্যাণের পক্ষে তিনি সবসময়ই সোচ্চার। উদার। আজ ১৫ অক্টোবর, আজ তাঁর জন্মদিন। কবিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা, শুভ জন্মদিন।