যে কথাগুলো বলতে চাই বা যে কথাগুলো লিখতে চাই, তা দেখলে অনেকেই আঁতকে উঠবেন। আবার কেউ-কেউ ক্ষোভে দুঃখে হয়তো গালিও দিতে পারেন। তবে এক শ্রেণী কিন্তু ঠিকই থাকবে, তা আমি হলফ করেই বলতে পারি। যারা এই লেখা পড়ে ঠোঁটের কোণে যুদ্ধজয়ী হাসি ফুটিয়ে বলবেন, অবশেষে বোধোদয়।
প্রায়ই কেউ-কেউ বলে থাকেন বাংলাদেশে নাকি যত কাক আছে, তার চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি। এর কারণ নাকি বাঙালির আবেগবিহ্বল মন। সেদিন কে যেন আমাকে ব্যঙ্গ করে শুনিয়েছিলেন—
কাব্য পচেছে কুষ্ঠ রোগেতে
কবিতা হয়েছে বাসি
আমার দেশে কাকের চাইতে
কবির সংখ্যা বেশি।
জানি, ওপরের লাইনগুলো পড়ে এখনই কেউ-কেউ ভ্রূ কুঁচকাতে শুরু করেছেন। আমি নিজেকে কবি বলে দাবি করছি না। কিন্তু কী করব, পরিচিত মহলে ওরকম একটা রটনা যে আছে! তবে ঘটনা যে একেবারেই কিছু নেই, তাও ঠিক অস্বীকার করতে পারছি না। তাই লোকজন সুযোগ পেলেই একহাত শুনিয়ে দেয়। যাই হোক, যে-ই ছড়াটা শুনিয়ে থাকুক কথাটা কিন্তু খুব একটা ভুল নয়। এমন একটি বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি জীবনে একবারের জন্যও দুলাইন কবিতা লেখেননি। জরিপ করলে হয়তো দেখা যাবে, দেশের প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে ৬ জনই কবি। অর্থাৎ কোনো না কোনো সময় তারা কবিতা লিখেছেন বা রচনা করেছেন। প্রশ্ন আসতে পারে, কবিতা লেখা আর রচনার মধ্যে কী পার্থক্য? আমার মনে হয় কাব্যভাব আসলে স্বল্পক্ষণের স্বল্প কথার মতো। তাই যেসব কবিতা ছোট হোক অথবা মোটামুটি সাইজের হোক পড়তে গেলে স্বল্প সময়ের রিলিফ পাওয়া যায় তাকে বলে কবিতা লেখা। আরেক ধরনের কবিতা আছে যেটা দীর্ঘ সূত্রিতার। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর তার ভাব এবং পড়তে গেলে পড়ার চাপে একেবারে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে হয়, সেটা আসলে কবিতা রচনা। যাই হোক, কেমন যেন ভয় করছে আনন্দের জন্য এই লেখাটা পড়ে না জানি আবার সুধীমহল হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েন।
এবার আসল প্রসঙ্গে আসি। কবিতার মতো আমি কবিদেরও দুভাবে ভেবে নিয়েছি। একটি স্বভাব কবি ও অন্যটি অভাব কবি। আমার মতে স্বভাব কবিদের বৈশিষ্ট হলো নিত্যনৈমেত্তিক বিভিন্ন কথাতেও যারা কবিতা তৈরি করে ফেলতে পারেন। যেমন কেউ একজন বলেছেন, একটা কবিতা লিখে দাও তো। অমনি হুট করে যারা কবিতা লিখে ফেলতে পারেন। তবে, কেন যেন মনে হয়, বাংলাদেশে অভাব কবির সংখ্যাই বেশি। কেউ-কেউ হয়তো উদাহরণ চাইতে পারেন। উদাহরণটা না হয় নেই-ই দিলাম। তবে একটা কথা বাঙালি কবিদের সম্পর্কে খুব প্রচলিত আছে যে, তাদের কবিতা রচনার শুরু হয় মূলত প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হওয়া ও প্রেমে পড়া থেকেই। এই কথা কতটুকু খাঁটি, তা জানি না। তবে পরিচিত কয়েকজনকে এমনই দেখেছি। আমার মতে, অভাব কবিরা হলো তাই। তারা মনে হয়, স্বেচ্ছায় ঠিক কবিতা লিখেন না। কবিতা তাদের দিয়ে নিজেকে জোর করে লিখিয়ে নেয়। অভাব কবিদের সব ধরনের কবিতা আসলে তাদের ভেতরগত টানাপড়েনের বহিঃপ্রকাশ। সে যাই হোক, অভাব কবি ও স্বভাব কবিদের নিয়ে এত আলোচনার অর্থ হচ্ছে, আসলে কুচকুচে পালকের ওই পাখিটি যার নাম কাক। কোনও এক অদ্ভুত কারণে এই পাখিটিকে আমার কেন যেন খুবই ভালো লাগে। এবার নিশ্চই পাঠককুলের চোখ বড়বড়ো হয়ে উঠছে? সত্যি আমাদের সমাজে উচ্ছ্বিষ্ট ভোজী বা গায়ের রঙ কালো বলেই কিনা জানি না কাককে সবাই অপচ্ছন্দ করে।
অন্যদিকে, একই রঙের কোকিল শুধু কণ্ঠের জোরে আবার সবার কাছে জনপ্রিয়। তবে, কাক আমার কাছে ভালো লাগে। কে জানে, গায়ের রঙটা নিজের মত বলেই হয়তো। এখন কথা হলো, কাক আসলে কোনও ধরনের কবিদের প্রিয় হতে পারে, অভাব নাকি স্বভাব কবিদের! স্বভাব কবিরা কাককে নিয়ে কখনো কিছু লিখেছে কি না, আমার জানা নেই। তবে মনে হয় লেখেননি। আর লিখলেও সেটা নেতিবাচক অর্থে হয়তো। এছাড়া, আশ্চর্যের বিষয় আমাদের দেশে কাক নিয়ে যে ছড়াকারে প্রবচন আছে, সেটাও কিন্তু নেতিবাচক অর্থে। যেমন—‘কাক করে কা কা/ আমার ঘর খাঁ খাঁ’ কিংবা ‘গাছে বেল পাকিলে, তবে কাকের কী’ ইত্যাদি। তবে বহু খুঁজে একটা ইতিবাচক প্রবচন ঠিকই বের করেছি। সেটা হলো ‘কাকচক্ষু জল’। প্রবচনটা মনে হলেই চোখের সামনে একটা স্বচ্ছ টলটলে দিঘির স্মৃতি ভেসে ওঠে। তার সান বাঁধানো ঘাটে ভর দুপুর বেলা একটা কাক নিঃসঙ্গ বসে কা-কা করছে, দৃশ্যটা মনে হয় খুব খারাপ হবে না। বিখ্যাত কবিদের মধ্যে কেউ কি কাক বিষয়ে কোনো কবিতা লিখেছেন? কবিগুরু কি কাকের সৌন্দর্য দেখেননি! কেউ যদি জানেন, তবে মনে করিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। একজন মনে হয় ঠিকই দেখেছিলেন বাংলায় কাকের আসল রূপ। তিনি জীবনানন্দ দাশ। এই নির্জনপ্রিয় কবির তিনটি পাখির মধ্যে অবশ্য কাকের নাম নেই। তবে তিনি কাককে অন্তত তার দু অক্ষরের নাম থেকে মুক্তি দিয়ে আরেকটু মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। কবিতায় তিনি দেখেছেন—‘সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে’। কোনো উপন্যাস বা গল্প লেখা হয়েছে কাককে নিয়ে? একজন শধু লিখেছেন জানি, হুমায়ুন আহমেদ। তার এ কি কাণ্ড এবং কাকারু নামে দুটো গল্প আছে কাকবিষয়ক। তবে সাহিত্য বোদ্ধারা হয়তো এ দুটোকে শিশুতোষ এবং হালকা উপাধি দিয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। শুধু কাকের কদর বুঝেছিলেন বোধ হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। তার দুর্ভিক্ষের চিত্রকর্মে মানুষের পাশাপাশি কাক এসেছে সমানভাবে। সেটা ইতিবাচক না কি নেতিবাচক ভূমিকায়, তার আলোচনায় যাব না। তবে যে যাই বলুক, পাখিটার কাক নামটা কিন্তু খুব একটা খারাপ লাগে না আমার কাছে। কাক নামটা উচ্চারণ করতে কোথায় যেন একটা আনন্দ আছে।
সুন্দর দুই বর্ণের উচ্চারণ। এছাড়া ইংলিশ ক্রো শব্দটার কথাই ভাবুন, সেটাও কি সুন্দর সংক্ষিপ্ত! এত কথা লেখার মানে হলো, কাক নিয়ে ভাবতে ইদানিং কেন যেন ভালো লাগছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, কাক আমাদের এত কাছের একটি পাখি তবু মানুষ কাককে কেন ভয় পায়? কেন অশুভ বলে চিন্তা করে! সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি একটা কাকের ছোট্ট ছানা পড়ে আছে আমার উঠানে। ছানাটা মৃদুস্বরে কা-কা করলেও কেউ ভ্রূক্ষেপ করছে না। হয়তো কোনো গাছের ডাল থেকে পড়ে গেছে। ছানাটাকে ঘিরে কারেন্টের তারে জমেছে আরও গোটা বিশেক কাক। তারা প্রচণ্ড শব্দে কা-কা করে নিজেদের মধ্যে কোনো বার্তা আদান-প্রদান করছে। আমি কাকের বাচ্চাটাকে ধরে একটা দেয়ালের ওপর তুলে দিলাম। ভাবলাম হয়তো বাচ্চাটাকে ওরা এবার নিয়ে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রায় ৮ ঘণ্টা পরও এসে দেখি বাচ্চাটা ওই দেয়ালেই বসে আছে। তবে ওকে ছেড়ে গেছে ওর সব অন্য কাক বন্ধুরা। কাক সব ধরনের জিনিস খায় জানি। কিন্তু একটা ছানা কাক কী খায়, তা তো জানা নেই। আমি ঘর থেকে কিছু ভাত এনে ছানাটাকে দিলাম। সময়টা এর পরের দিন। আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ছানাটা ওই দেয়ালের ওপরেই বসে আছে। আমি সামনে যেতেই কেমন যেন করুন স্বরে কা-কা করল। আমি আবার কিছু ভাত ওটাকে খেতে দিলাম। পরে অবশ্য কাকের বাচ্চাটাকে আর দেখিনি। হয়তো সে ফিরে গেছে ওর উড়ন্ত ভুবনে। কিন্তু সেদিন কাকটার চোখের দৃষ্টিটা হঠাৎ কেন যেন মনে পড়ল গতকাল রাতে। আমি স্বভাব কবি নই। মাঝে মাঝে অভাবে পড়ে কবিতার মতো কিছু একটা লিখতে চেষ্টা করি। সেটা যতটা না কবিতা হয়ে ওঠে, তারও চয়ে প্রলাপই হয় বেশি। কিন্তু রাতে কাকের ওই চোখের কথা ভাবতে ভাবতে আমি এক অভাব কবি যেন স্বভাব কবিতে রূপান্তরিত হলাম। আমার চোখের সামনে স্বপ্ন দৃশ্যের মতো ভেসে উঠল একটা নির্জন সান বাঁধানো পুকুর ঘাট। তার জলে ভাসছে কচুরি পানা। প্রখর রোদ্দুরে আমি বসে আছি সেই পুকুর ঘাটে। পাশের সিড়িতে একটা কাক তাকিয়ে আছে জলের দিকে। কারণ জলটা যে কাকচক্ষু জল। রূপান্তরিত ওই স্বভাব কবি হয়ে লিখে ফেলেছিলাম কয়েকটা লাইন—
নির্জন দুপুরে একটা কাক এসে আমার দাওয়ায়
রোদে পুড়ে খুটে খায় কবিতার খুদ
আমি যতই বলি, যাও পাখি—
ওটা তার কা-কা কণ্ঠে বলে
আমি তোমায় ভালোবাসি……