১.
জীবনানন্দ দাশের নাম শোনামাত্র আমপাঠকের মনে কবিতার যে রকম ভাব জেগে ওঠে ( নিসর্গসমর্পিত, বিষণ্ন, কোমল, প্রচ্ছন্ন সাঙ্গীতিক ও অলসমন্থর কিন্তু অনুভবগাঢ় বিহ্বল ভাষার কবিতার ভাব) তার শেষ দিককার কবিতাগুলো স্বভাবে ঠিক তেমন নয়। পরিহাসপ্রবণ (কিন্তু মোটেই উপহাসপ্রবণ নয়) আর ধারালো এই পর্যায়ের কবিতাগুলো। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের শেষ দিক থেকে দ্বিতীয় কবিতা ‘সুবিনয় মুস্তফী’ সেই সময়ের কবিতাগুলোর একটি – হয়ত তীব্রতমটিই। সম্প্রতি কবিতাটি পাঠ করতে গিয়ে মাথার ভেতরে কিছু অগোছালো ভাবনার অস্পষ্ট বুদ্বুদ তৈরি হয়েছে। বুদ্বুদগুলোকে অক্ষরবন্দি করে রাখাটাকে দোষণীয় মনে হয়নি বলে এই লেখাটা।
বাংলাদেশের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের নোটবইগুলোতে যেরকম প্যারাফ্রেজ থাকে (যথা রামজি লাল ও সুদীপ সেনের নোটবইগুলো) কবিতা নাটক বা কখনো গল্পের। আমি নোটবই পড়ে বেড়ে ওঠা লোক। প্রথমত, সেরকম কবিতাটির প্যারাফ্রেজ তৈরি করা যাক।
প্যারাফ্রেজ
একইসঙ্গে বিড়াল ও বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর হাসানোর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল সুবিনয় মুস্তফী নামের যে ভূয়োদর্শীর। হেমন্তের রাতে তাকে মনে পড়ে কবির। ইঁদুরকে খেতে খেতে সাদা বিড়ালের ব্যবহার, অথবা টুকরো হতে হতে সেই ‘ভারিক্কে’ ইঁদুর, বৈকুণ্ঠ ও নরক থেকে তারা উভয়ে (বেড়াল ও ইঁদুর) কতখানি দূরে রয়েছে সেটাই ভুলে যেত। ভুলে গিয়ে আধো আলো আধো অন্ধকারে ‘হেঁচকা’ (মাটি কিভাবে ‘হেঁচকা’ হয় আমরা বোঝার চেষ্টা করব ) মাটির পৃথিবীতে আরও কিছুদিন বেঁচে কিছুটা আমেজ পেয়ে নিতে খুব সস্তায় কিছুটা সুবিধা করে দিতে যেত। তবু বেদম হাসিতে বিড়ালের পেটে খিল ধরে যেত। আর ইঁদুরটা সেই খিল কেটে কেটে হেসে খুন হয়ে যেত।
কী বলতে চান জীবনানন্দ? কবিতার প্রতিটি শব্দই তো পাঠকের চেনা। তবু যেন স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যায় না। কবিতা তো ঠিক বোঝার বিষয় নয়! অনুভবের বিষয়। জানি এই কথাটা পাঠকের ঠোঁটের কাছে হয়ত চলে এসেছে। কিন্তু সেই অনুভবেরও কিছু উৎসমুখ থাকা দরকার। ‘হাট্টিমা টিম টিম/ তারা মাঠে পাড়ে ডিম/ তাদের খাড়া দুটো শিং/ তারা হাট্টিমা টিমটিম’—এই অ্যাবসার্ডিটিরও কিন্তু কনোটেশন আছে। নিরর্থকতারও একপ্রকার ‘যুক্তি’ থাকে। অর্থের এক ধরনের ইঙ্গিত থাকে। কবিতাটি কী ইশারা দিচ্ছে আমাদের? ইঁদুরের আগে বিশেষণ হিসেবে ‘ভারিক্কে’ শব্দটা দেখে আমরা অনুমান করতে পারি, এই ইঁদুর হয়ত মানুষেরই রূপক। কেননা ভারিক্কে শব্দটা ইঁদুরের মতো প্রাণীর সঙ্গে বেমানান।
‘মহাপৃথিবী’তে একই ধাঁচের আরেকটি কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ, যেটি আবার কাব্যগ্রন্থের অন্তিম কবিতাও। অনুপম ত্রিবেদী। কবিতাটি ‘সুবিনয় মুস্তফী’কে বুঝতে কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারে। ‘অনুপম ত্রিবেদী’ও শুরু হয়েছে একই স্টাইলে, ‘এখন এই শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে’ বলে। সেখানেও সুতীব্র পরিহাসপ্রবণতা উঁকি দেয়, তার প্রমাণ এই লাইনগুলো:
…হেগেল ও মার্কস: তার ডান আর বাম কান ধরে
দুই দিকে টেনে নিয়ে যেতেছিল; এমন সময়
দু-পকেটে হাত রেখে ভ্রুকুটিল চোখে নিরাময়
জ্ঞানের চেয়েও তার ভালো লেগে গেল মাটি মানুষের প্রেম;…
এই মাটি মানুষের প্রেমই শিল্পীকে মহৎ করে তোলে।
২.
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্পের কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে আবছা আবছা, সম্ভবত ‘অন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বাজবে কখন’ নামে। সেই গল্পে একটা ইঁদুর, বেশ অদ্ভুত আত্মঘাতী একটা ইঁদুর, মরার জন্য পথের ধারে শুয়ে থাকা বিড়ালের কাছে গিয়ে নিজেকে খেয়ে ফেলার অনুরোধ জানায়। আরও অদ্ভুত, বিড়ালটা ইঁদুরটাকে উদাসীনতার সঙ্গে জানায় তার খিদে নেই। ফলে সে এখন কষ্ট করে ইঁদুরটাকে খেতে পারবে না। এই ব’লে বিড়ালটা হাই তোলে। কিন্তু গল্পের ইঁদুরটি বড় নাছোড়বান্দা। সে বলে, আচ্ছা তোমার কষ্ট করতে হবে না বরং তুমি হা করো আমি তোমার মুখের ভেতর ঢুকে পড়ি। তুমি শুধু আমায় গিলে ফেলবে। কিন্তু বেড়াল তবু ভক্ষণে অনিচ্ছুক। শেষ পর্যন্ত সেই ইঁদুর ও বিড়ালের মধ্যে রফা হয় যে, ইঁদুরটি শুয়ে থাকুক বিড়ালের মুখের মধ্যে, অদূরের অন্ধদের স্কুল ছুটি হলে অন্ধ ছেলেমেয়েরা অগোছালো পদক্ষেপে হয়ত লেজ মাড়িয়ে দেবে আর তখনই রেগে গিয়ে বিড়ালটা ইঁদুরটাকে খেয়ে ফেলবে। তো, গল্পকার গল্পের শেষ দিকে পাঠকদের জানান যে, সেই বিড়ালের মুখস্থিত ইঁদুর ও ইঁদুরকে মুখের ভেতর নিয়ে বসে থাকা বিড়াল অপেক্ষা করতে থাকে, অন্ধ স্কুলে ঘণ্টা কখন বাজবে।
দুঃস্বপ্নের মতো সব গল্প লিখে বিশ্বসাহিত্যকে চিরদিনের জন্য যিনি বদলে দিয়ে গেছেন, ভয়াবহ দুঃস্বপ্নপ্রতিম অবস্থা বা ঘটনার একটা প্রতিশব্দই ( কাফকায়েস্ক) যার নাম ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে, সেই কাফকার একটা অনুগল্প আমার কাঁচা তর্জমায় পেশ করছি।
‘ইঁদুরটা বলল, হায়! দুনিয়াটা দিনকে দিন হ্রস্বতর হয়ে যাচ্ছে। শুরুতে এটা এত বড় ছিল যে, আমি ভয় পেতাম, আমি ছুটতাম আর ছুটতাম; ডানে ও বামে বহুদূরের দেয়ালগুলো দেখে ভালো লাগত কিন্তু ইদানিং দেয়ালগুলো এত দ্রুত সংকুচিত হয়ে গেছে যে, আমি অন্তিম ঘরটাতে চলে এসেছি। ঘরের এক কোণে ফাঁদ পাতা আছে যা আমাকে পেরিয়ে যেতেই হবে। ‘তোমার শুধু দরকার দিকটা বদলানো’ বলে সেই বিড়াল ইঁদুরটাকে খেয়ে ফেলল।
ফলত, শহীদুল জহিরের হাতে একটি অদ্ভুত রকমের পরিহাসপ্রবণ গল্প ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ লিখিত হলে আশ্চর্য হই না। সেই গল্পের শেষ দিকে গল্পকার জানান, ‘এই খেলার শেষ নাই, খেলোয়াড়ের শেষ আছে; খেলোয়াড় খেলা ছেড়ে যায়, কিন্তু খেইল জারি থাকে।‘
খেলা যেহেতু জারি থাকে অর্থাৎ চলতেই থাকে, সমাজ সচেতন কোনো শিল্পীই সেগুলো এড়িয়ে যেতে পারেন না। যতই আপাত-উদ্ভট দূর কল্পলোক হোক না কেন, তাদের সাহিত্যভূবন, বাস্তবের ‘বদহাওয়া’ এসে সেখানে লাগবেই। সে কারণেই কাফকার মেটামরফোসিসে গ্রেগর সামসা বিকট পতঙ্গ হয়ে গেলেও, সেইভুবনের দৃশ্যমাণ ক্ষমতাপ্রপঞ্চগুলোর বিষাক্ত শলাকা আমাদের এসে বিদ্ধ করতে থাকে। যেন ঠারে ঠারে বলে যায়, এসব তোমাদের যাপিত জীবনেরই, সমাজেরই প্রতিবিম্ব। সমাজের উৎকট অশ্লীল বৈষম্যে দিনাতিপাত করা ইঁদুরের চেহারাকে কোনো মহৎ শিল্পীই উপেক্ষা করতে পারে না। হয়ত পারে না বলেই একজন কাউন্ট হয়েও লিও টলস্টয়ের হাতে, ‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’ এমন মহিমান্বিত শিল্পরূপ লাভ করে। দগদগে ঘা-এর মতো ভ্যানগঘের ‘আলু খাদকে’র ( পটেটো ইটারস) মুখ, চৈতন্যে সন্ত্রাস জাগানিয়া এডভার্ড মুঙ্গের ‘চিৎকার’ (স্ক্রিম) আমাদের বিহ্বল করে রাখে। সত্যান্বেষাই হয়ত এইসমস্ত শিল্পীকে মহান করে তোলে। ফলত, এশিরিয়া ব্যাবিলন থেকে শুরু করে বিদর্ভ শ্রাবস্তী পরিভ্রমণের পরেও ধ্যানমগ্ন কবিরও মনে পড়ে যায়, সুবিনয় মুস্তফী নামের আশ্চর্য যুবার কথা। ‘কলার জন্য কলা’ বলে যারা চেঁচিয়ে যান দিনরাত, তারা খাদ্য আর খাদক হয়ে ইঁদুর ও বিড়ালের মতো মানুষের এই জীবন্মৃত থাকা, মরে বাঁচা, মরতে মরতে বাঁচা, বাঁচতে বাঁচতে মরাকে বালুতে মুখ গুঁজে উটপাখির মতো যতই উপেক্ষা করতে চান না কেন, ওসব তাদের নিজেদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করার নামান্তর। আর নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার চেয়ে পরিহাসময় আর কী হতে পারে? সমস্ত শিল্পসৃজনই কি নিজের অস্তিত্বের স্বাধীন আর উন্নতশির ঘোষণারই অন্যনাম নয়?
তুমুল বিপণনমত্ততার এই সময়ে, তুমুল ভোগোন্মত্ততার এই কালে, যখন মানুষের সামনে দুটি পথ কেবল—হয় বিড়াল (খাদক ), নাহয় ইঁদুর (খাদ্য) হও, সেই ভুয়োদর্শী যুবা, যার একসঙ্গে বিড়াল ও বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর হাসানোর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল, সুবিনয় মুস্তফীর কথা সমাজসচেতন যেকোনো শিল্পীর শুধু হেমন্তের রাতে নয়, গ্রীষ্ম থেকে বসন্ত সকল ঋতুতেই মনে পড়ার কথা। সে যেন রূপকথার কোনো বিরল ম্যাজিশিয়ন, ভোজভাজির মতো বিড়াল আর বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর হাসাতে যার জুড়ি মেলা ভার।
হে প্রণম্য পাঠক, আসুন, অল্প সময় নিয়ে, ইঁদুরের মতো ঊর্ধ্বমুখী দৌড়ে একটুখানি বিরাম টেনে, ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ক্ষণিক তাকানোর মতো করে, মহান কবির প্রতি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা রেখে আরেকবার কবিতাটি পাঠ করি:
সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে।
একসাথে বিড়াল ও বিড়ালের-মুখে-ধরা-ইঁদুর হাসাতে
এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার।
ইঁদুরকে খেতে-খেতে শাদা বিড়ালের ব্যবহার,
অথবা টুকরো হ’তে-হ’তে সেই ভারিক্কে ইঁদুর,
বৈকুণ্ঠ ও নরকের থেকে তা’রা দুই জনে কতোখানি দূর
ভুলে গিয়ে আধো আলো অন্ধকারে হেঁচকা মাটির পৃথিবীতে
আরো কিছুদিন বেঁচে কিছুটা আমেজ পেয়ে নিতে
কিছুটা সুবিধা ক’রে দিতে যেতো–মাটির দরের মতো রেটে;
তবুও বেদম হেসে খিল ধ’রে যেতো ব’লে বিড়ালের পেটে
ইঁদুর ‘হুর্রে’ ব’লে হেসে খুন হ’তো সেই খিল কেটে-কেটে।