মানুষ সুন্দরের পূজারি। সুন্দরের প্রতি আজন্ম দুর্বলতা সবার। ফুল, পাখি, নদী, জল, প্রকৃতি, আকাশ, মেঘ—সবই তো সুন্দর। তবু নারীর চোখে পুরুষ সুন্দর; পুরুষের চোখে নারী। আর সেই নারীকে ‘সুন্দরী’ বলে আখ্যা দিতে পুরুষের যত কলাকৌশল। লোকমুখে প্রচারিত ‘ছলনার ভাণ্ডার’ নারী হলেও পুরুষের শক্ত কৌশলের কাছে সে ছলনা ম্লান হয়ে যায় নিমিষেই। কেননা প্রাচীনকাল থেকেই নারীকে সুকৌশলে ভোগের সামগ্রী করতে সমাজের প্রভাবশালী পুরুষের নানাবিধ বাহানার ইতিহাস সুবিদিত। রাজদরবার থেকে শুরু করে বস্তির ঘুপচি ঘরেও সে বাহানা অটুট। নারীকে কুক্ষিগত করাই যেন পুরুষতন্ত্রের সারা জীবনের সাধনা।
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিও এর ব্যতিক্রম নয়। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, চিত্রকর্ম, সিনেমা, নাটকে নারীর সৌন্দর্যকেই যেন উপলক্ষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। পুরুষের সৌন্দর্য অর্থ-বিত্তে আর নারীর সৌন্দর্য শরীরে খোঁজার প্রবণতা নতুন কিছু নয়। সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ এলেই কেমন যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে নারীর শরীর। অথচ সুন্দরের সন্ধান খুব সহজ কাজ নয়। এই কঠিন কাজটি মূলত সাধনার বিষয়। অথচ এই সুন্দরের সন্ধানকেও আমরা সহজ করে নিতে আয়োজন করি বিভিন্ন প্রতিযোগিতার। নির্ধারিত কিছু বিচারকের সামনে পুতুলের মতো হেলে-দুলে, কোমর নাচিয়ে, বুক উঁচিয়ে হেঁটে যাওয়া নারীকে ‘সেরা সুন্দরী’র খেতাব দিয়ে থাকি।
এ প্রক্রিয়ায় নারীর উচ্চতা, বুক, কোমর, নিতম্বের মাপে খুঁজে ফিরি সৌন্দর্য। তার চোখের মায়ায়, মুখের হাসিতে জাগ্রত হয় পুরুষের বাসনার সাপ। আমরা তাদের মাপি গজফিতা দিয়ে। ইচ্ছে হলে মুকুট পরিয়ে দেই; আবার ইচ্ছে হলেও অযুহাত তুলে কেড়েও নেই। সবই তো পুরুষতন্ত্রের পাতানো ফাঁদ। এত নারীকে দেখার, নারীকে পাওয়ার সুক্ষ্ণ হিসাব। আর সে ফাঁদেই পা দেয় কিছু নারী। বিশ্বময় আলোচিত হতে উদগ্র বাসনা লালন করে বুকে। তাতে কখনো কখনো তাদের বুক ভাঙে, ভাঙে সংসার ও জীবনের সুখ।
১৯৫১ সালে যুক্তরাজ্যের এরিক মোর্লে ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতা শুরু করেন। এ আয়োজনে তখন যেই উদ্দেশ্য থাক না কেন, এখনকার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আগের মতো আর নেই। কেননা সম্প্রতি বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা’র আসর বসেছে। এ আসরে প্রতিযোগিতার নামে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। সেই ঘোলা জলে মাছ শিকার করেছেন অনেকেই। আয়োজক পুরুষ মুকুট দিয়েও আবার কেড়ে নিয়েছেন। নাটকীয় ঘটনার অবতারণা করে আলোচনায় এসেছেন। তথ্য গোপন করে ব্যক্তিত্ব হারিয়েছেন। জয়ী হয়েও পরাজয়ের কলঙ্ক নিয়ে আত্মহত্যার গুজব ছড়িয়েছেন। কী সেলুকাস এই আয়োজন! একাধারে হাস্যকর এবং বিভ্রান্তিকর।
যতটা না আলোচনা-সমালোচনা পুরস্কার ঘোষণার পর। প্রতিযোগিতার শুরুটা মোটেই তেমন আলোচিত ছিল না। আর সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন জান্নাতুন নাঈম এভ্রিল। পুরো আয়োজনটাকেই সবশেষে হাস্যকর, উন্মাদের অঙ্গভঙ্গি, অপরিপক্ব বলে মনে হয়েছে। কারণ আমি এভ্রিলকে দোষারোপ করতে পারি না। এর জন্য দায়ী পুরো বিচারপ্রক্রিয়া। আয়োজকদের অপরিপক্বতা, দূরদর্শিতার অভাব, বিবেকহীন সিদ্ধান্ত এই প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
শুরুতেই প্রথম বিতর্ক বিজয়ীর নাম ঘোষণা নিয়ে। উপস্থাপিকা শিনা চৌহান ঘোষণা করলেন একজনের নাম। অথচ আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার স্বপন চৌধুরী মঞ্চে উঠে দুঃখ প্রকাশ করে ঘোষণা করলেন অন্য জনের নাম। বিতর্কের শুরু সেখানেই। বিচারকরাও অসন্তোষ প্রকাশ করেন এমন ঘোষণায়। তাদের দাবি, বিচারকদের রায়ে নির্বাচিত প্রতিযোগীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তাহলে বিচারকের প্রয়োজন ছিল কেন? এরপর জল ঘোলা হতে থাকলো। সংশোধিত ঘোষণার সুন্দরী এভ্রিলের নাড়ি-নক্ষত্র খুঁজতে উঠে পড়ে লাগলো গণমাধ্যম। এভ্রিলের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। কারণ প্রাথমিক নিয়মানুযায়ী, প্রতিযোগীকে অবশ্যই অবিবাহিত হতে হবে, সন্তান থাকা যাবে না। কেননা ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার শুরুর আগে আবেদনপত্রের শর্তগুলো ছিল—বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণে আগ্রহী মেয়েকে অবশ্যই বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী নাগরিক হতে হবে, অবিবাহিত হতে হবে, সন্তান থাকা যাবে না এবং বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ২৭-এর মধ্যে।
তাই বলা যায়, এভ্রিলের একবার বিয়ে হয়েছিল। তিনি সংসার করুক বা না করুক—বিয়ের মালা তো গলায় পরেছিলেন। ফলে তার আবেদনের প্রাথমিক যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সে কারণেই চারিদিকে সমালোচনার ঝড় উঠলে আয়োজকরা পরবর্তী সময়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পুনরায় ফল ঘোষণা করেন। তারা বলেন, মিস ওয়ার্ল্ডের মূল প্রতিযোগিতার নির্দেশনা অনুযায়ী ডিভোর্সি, সিঙ্গেল মাদাররা অংশ নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে এভ্রিলের অংশগ্রহণ অবৈধ নয়। কারণ তার বিয়ে হলেও তিনি এখন সিঙ্গেল।
গত বুধবার রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৭’ আয়োজক অন্তর শোবিজের পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়। সেখানে বলা হয়, এভ্রিল সেটা স্বীকার করেই অংশ নিতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি তথ্য গোপন করেছেন তাই শাস্তিস্বরূপ তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। মূল আয়োজনকারীরা চান না একজন মিথ্যাবাদী একটি দেশের প্রতিনিধি হয়ে আসুক। তখন এভ্রিলের নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে বলা হয়, বিচারকদের রায়েই নির্বাচিত হয়েছিলেন জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল। কিন্তু ভুল করে জান্নাতুল সুমাইয়া হিমির নাম ঘোষণা করেন উপস্থাপক শিনা চৌহান।
অবশেষে এভ্রিল বা হিমিকে টপকে এবার মিস ওয়ার্ল্ড জেসিয়া ইসলাম। কোথাকার জল কোথায় গড়ালো—তা হয়তো বুঝতে অসুবিধা হয় না। সবশেষে কেন উঠে আসে জেসিয়া ইসলামের নাম? অথচ ‘ভুলক্রমে ঘোষিত’ হিমির নাম এ যাত্রায় উচ্চারিতই হলো না। এরপর এ-ও শোনা যায় যে, মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের দ্বিতীয় রানারআপ রুকাইয়া জাহান চমকও বিবাহিত! শর্তই যদি থাকে তবে তথ্য গোপন করে একাধিকজন কিভাবে আবেদন করে এবং ফাইনাল রাউন্ড পর্যন্ত চলে আসে? আয়োজকরা কেন খোঁজ নেননি আগে? যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘আমরা জেনেছি চমক বিবাহিত। সেজন্য তাকে যৌথভাবে তৃতীয় করা হয়েছে। না হলে তাকে আমরা দ্বিতীয় করতাম। এর আগে চমক বলেছে, ছেলেটি নাকি তার প্রেমিক। কিন্তু আমরা অনুসন্ধানে বের করেছি, সে-ই চমকের স্বামী। স্বামীর সঙ্গে তিনি রাজধানীর উত্তরায় থাকেন।’
এদিকে গত বুধবার রাত থেকেই গুজব ছড়ায়, ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’র শিরোপা হারানোর লজ্জা নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এভ্রিল। খুব অল্প সময়েই এই গুজবটি ভাইরাল হয়ে যায়। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ছবিসহ স্ট্যাটাস দিয়ে ছড়ানো হয় এই সুন্দরীর মৃত্যু খবর। তবে বৃহস্পতিবার সকালে বিষয়টির সত্যতা জানার চেষ্টা করতে গেলে খবরটি সম্পূর্ণই মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয়। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সঙ্গে কথা বলেছেন এভ্রিল। তিনি বলেছেন, ‘কিছু মানুষ কোনো এক কারণে আমার পিছু লেগেই আছে। তারা যেন আর আমাকে জীবিতই দেখতে চান না। না হলে কারও মৃত্যুর মিথ্যে খবরও কি কেউ এভাবে ছড়াতে পারে! আমি আজকের এই ঘটনাটির মুখোমুখি না হলে জানতামই না, মানুষের এত বিচিত্র ভয়ঙ্কর রূপ থাকতে পারে।’
নাটকের ধারাবাহিকতা বড়ই চমৎকার। একের পর এক নারীকে নিয়ে প্রহসনের খেলা খেলছে পুরুষতন্ত্র। দুনিয়াজুড়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার শারীরিক মাপের রীতি তো পুরুষেরই তৈরি করা। অথচ নারীরা তা ঘূণাক্ষরেও টের পায় না! বিশ্ব সুন্দরী নির্বাচনের ইতিহাস নতুন কিছু নয়। তবে এক আসরে এত নাটক বোধ হয় এ বছরই প্রথম। তাই এবারের আসরটিকে আমি নারীর অবমাননার সূতিকাগার বলতেই পারি। ওদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের মিস ওয়ার্ল্ড রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে গিয়ে নিজ দেশের সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে কথা বলায় আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়েছেন। সেটা না হয় ভিন্ন কথা। কিন্তু এভ্রিল বা হিমি বাদ পড়েছেন কেন? তারা বাদ পড়েছেন পুরুষতন্ত্রের খামখেয়ালির কারণে। সুশীল সমাজের কেউ কেউ এভ্রিলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের লেখায় উঠে এসেছে অদম্য এভ্রিলের জয়গান। কলামিস্ট জব্বার হোসেন সুন্দরী প্রতিযোগিতাকে নারীদের কর্পোরেট যৌনদাসী বানানোর প্রক্রিয়া বলে আখ্যা দিয়েছেন। কলামিস্ট সাবিনা শারমিন বলেছেন, ‘যে প্রতিযোগিতায় একজন নারীর শরীরের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করা হয়, আমি মনে করি সে ধরনের প্রতিযোগিতায় জিতে যাওয়া মানে একজন নারীর মানুষ হিসেবে হেরে যাওয়া। নারী ক্ষমতায়নের নামে নারীর শরীরকে কটাক্ষ করারই নামান্তর।’
লেখক ও সাংবাদিক তুষার আব্দুল্লাহ বলেছেন, ‘ভোগের দুনিয়া শুধু নারীকেই ভোগ্যপণ্য বানিয়ে তৃপ্ত হয়নি। এই দুনিয়ায় পুরুষও ভোগের পণ্য। পুরুষতান্ত্রিকতা সেই সত্যটি বারবার আড়াল করতে চেয়েছে। প্রতিরোধ হিসেবে ভোগের পণ্য হিসেবে নারীর দিকে চেয়ে থাকছে অপলক। নারী প্রতিবাদ করলে তার দিকে কুৎসা, ঘৃণার প্রস্তর ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরুষ কিংবা নারী উভয়েরই একটি উপলব্ধিতে পৌঁছতে হবে—ভোগের সুপারশপে উভয়েই সাজানো আছে পাশাপাশি। দামেও খুব একটা বেশকম হয় না। তবে কেন শুধু ঠোকাঠুকি? আজকাল অনেক পণ্যের মোড়কেই তার উৎপাদন ইতিহাস আড়াল করে রেখে শুধু মোড়কিত হওয়ার আদ্যোপান্ত দেওয়া হয়। মানুষ পণ্যের আলমারিতে থেকে এই অভ্যাসের বাইরে থাকবে কী করে? সুতরাং স্মরণে থাকা দরকার—এভ্রিল, আমার-আপনার চেয়ে বিচ্ছিন্ন কেউ নয়।’
সবশেষে কথা হচ্ছে—এভ্রিল, হিমি, জেসিয়ার মধ্যে কে জিতেছেন, কে হেরেছেন? সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে হেরেছে নারী। জিতেছে পুরুষতন্ত্র। যুগ যুগ ধরে এই পুরুষতন্ত্রই নারীকে পণ্য বানিয়ে রেখেছে। রাজদরবারের বাইজি থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের এই প্রতিযোগী নারী—সবাই একইসূত্রে গাঁথা। নারীকে সম্মান জানাতে প্রতিযোগিতার প্রয়োজন হয় না। বরং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অবমাননাই মুখ্য হয়ে ওঠে। নারী এগিয়ে যাক তার মেধা, বুদ্ধি, জ্ঞান আর প্রজ্ঞার মাধ্যমে। শারীরিক সৌষ্ঠব নয়; বুদ্ধিমত্তাই হোক নারীকে সম্মানের পরিমাপক।