সাহিত্য সম্পাদক একজন গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তি। লেখকের মতো তিনিও সময়ের সার্থক প্রতিনিধি। লেখকের যেমন কিছু দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা থাকে, থাকে সময়ের দাবি; তেমনি সম্পাদকেরও থাকে। সম্পাদক অনেকটা আয়নার মতো—লেখকের স্বচ্ছ আদল প্রতিফলিত হয় যাঁর চোখে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি লেখাকে সম্পাদনা করতে গিয়ে দ্বিতীয় স্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন একজন সম্পাদক। তাই সম্পাদনা করতে হলে তাঁর অবশ্যই সম্পাদনার বিষয়ে পরিপক্ব ও পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা অনিবার্য। না হলে শিল্প ও শিল্পী উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক্ষেত্রে সম্পাদককে নির্ভীক হতে হবে। ভুলকে ভুল ও সঠিককে সঠিক বলার মতো সৎ সাহস থাকতে হবে। কোনো কোনো সম্পাদক তরুণ লেখকের ভালো লেখাকেও ছাপাতে চান না।
অনেকেই ভাবেন পত্রিকা মানেই গণ্যমান্য লেখকদের লেখাতে ঠাসা। যেন তাঁরা পণ করেই নিয়েছেন জনপ্রিয় লেখকদের লেখা তাঁর পত্রিকার প্রথম সারিতে থাকতে হবে, হোক সেটা খাদ্য কিংবা অখাদ্য। বাংলাদেশ এবং ভারতের অনেক ভালো ভালো পত্রিকাতেও এই অসমতা লক্ষ্য করা যায়। যা এককথায় সাহিত্যকে গলা টিপে হত্যার নামান্তর। সম্পাদকের উচিত ভালো লেখাকে যথাযোগ্য মূল্যায়ন করা। লেখক নয়; লেখার শিল্পমানকেই সবার ওপরে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। লেখা যদি শিল্পগুণে উত্তীর্ণ ও সমৃদ্ধ হয়, তাহলে সেটাকে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা যায়, হোক সে নবীন কিংবা প্রবীণ লেখক। বয়স ও জনপ্রিয়তার বিচারে সাহিত্যের মানদণ্ড কখনোই বিবেচিত হতে পারে না।
সাহিত্যে সম্পাদনা একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। তাই লেখক ও সম্পাদক একে অন্যের পরিপূরক। কারণ, একটি লেখা সম্পাদকের হাতে দিলেই লেখকের কাজ শেষ, কিন্তু লেখাটিকে দৃষ্টিনন্দন ও শিল্পিত করে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সম্পাদকের ভূমিকা অপরিসীম। সম্পাদকের কাজ একটি লেখা মনোযোগ সহকারে পাঠ করা, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সম্পাদনা করা। তবে সব বিষয়ে একজন সম্পাদকের জ্ঞান না ও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সাহিত্য সম্পাদকের প্রধান কাজ হচ্ছে প্রতিনিয়ত পড়াশোনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজেকে শানিত করা, পরিশীলিত করা। যথেষ্ট সাহিত্যজ্ঞান না থাকলে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা কঠিন এবং ঠিকও নয়। কেননা ভালো জহুরি হলে তবেই না জহর চেনা যাবে। আর লেখার ভেতর দিয়েই একজন সম্পাদক নতুন লেখক আবিষ্কার করতে পারেন। যেমন পরামর্শ ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বিকাশের সুযোগ দিয়ে ভালো মানের লেখা সংগ্রহ এবং লেখককে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। তাই সম্পাদকের থাকতে হবে প্রচুর ধৈর্য।
ধৈর্যের কথা আসছে এ জন্য যে, সিনিয়র-জুনিয়র, ছোট-বড়, উচ্চশিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত লেখকের নানা ধরনের লেখা সম্পাদকের হাতে আসতেই পারে। সেসব লেখাকে তুচ্ছ না করে বরং রুচিশীল ও পাঠযোগ্য করে তোলার দায়ভার রয়েছে সম্পাদকের। তাই সম্পাদককে হতে হয় দৃঢ় ও সুস্থির। কারণ একজন অভিজ্ঞ সম্পাদকের সম্পাদনায় ফুটে ওঠে রুচি, আদর্শ ও শৈল্পিক মনন। তাই সাহিত্য সম্পাদক যোগ্যতা সম্পন্ন ও ধৈর্যশীল হওয়া খুব জরুরি।
সম্পাদকের পরবর্তী কাজ হলো—ভালো লেখাকে মূল্যায়ন ও যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করা। কারণ লেখকের পাশাপাশি সম্পাদকের সমান দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা রয়েছে একটি বই কিংবা লেখাকে পাঠোপযোগী করে তোলার। সেক্ষেত্রে বানান সংশোধন, বাক্যের গঠনগত ভুল, ছোটখাটো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, শব্দের অপপ্রয়োগ, মার্জিত ও সংশোধন তথা ব্যাকরণ সংশ্লিষ্ট ভুলগুলো লেখকের অগোচরেই ঠিক করতে পারেন সম্পাদক। তবে শব্দের অর্থ, ছন্দ বা মাত্রা ঠিক করা, কবিতা ও গদ্যের কনটেন্ট পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে হলে অবশ্যই লেখকের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে করা উচিত। সম্পাদক কখনোই লেখার বিষয়বস্তুকে পরিবর্তন করার অধিকার রাখেন না। তবে লেখাকে গ্রহণযোগ্য করতে যেটুকু সংশোধন প্রয়োজন, তা অবশ্যই করবেন। দেখা যায়, বেশিরভাগ লেখকই নিজের লেখায় কোনো ধরনের পরিবর্তন পছন্দ করেন না। এটা সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। এক্ষেত্রে মানসম্মত ও নির্ভুল লেখা হুবহু প্রকাশ করা যায় সংশোধন ছাড়াই। ভালো লেখা পরিবর্তন ছাড়া ছাপাবেন, খারাপ লেখা বাদ দেবেন। সামান্য কিছু সংশোধন কাম্য থাকলে সেটা করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা সম্পাদকের রয়েছে।
তবে লেখাকে এমনভাবে পরিবর্তন করা উচিত নয়, যাতে লেখাটা মৌলিক বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে যায়। আবার কোনো লেখককে নিরুৎসাহিত করাও ঠিক নয়। তরুণ লেখকদের লেখায় যদি ভুল থাকে, সেক্ষেত্রে সম্পাদকের উচিত, প্রথমে তাকে লেখাটা সংশোধন করতে বলা বা কোন জায়গায় সমস্যা অথবা কোথায় সংশোধন কাম্য, সেটা ধরিয়ে দেওয়া। লেখকের সংশোধন করার পর যদি ঠিক থাকে, তবে সেটা হুবহু ছাপিয়ে দেবেন আর যদি সংশোধন করার পরও কিছু অসামঞ্জস্য থেকে যায়, সে ক্ষেত্রে সম্পাদক নিজের মতো করেই সংশোধন করে নেবেন। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের ক্ষেত্রেও একই কাজ। তবে যদি কোনো লেখক ইগো দেখিয়ে লেখা সংশোধনে আপত্তি প্রকাশ করেন, সে ক্ষেত্রে তার লেখা না ছাপানোই উচিত।
অনেক সময় দেখা যায় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের দুর্বল লেখাও সম্পাদক ছাপিয়ে দেন ভয়ে। কারণ, সেই লেখক রাগ করে হয়তো তার পত্রিকায় লেখা পাঠানো বন্ধ করে দেবেন। অনেকে আবার বড় লেখকদের নাম ভাঙিয়েও চলেন (তৈল মর্দন করা যাঁদের স্বভাব)। তারা চিন্তা করেন পত্রিকায় অমুক, অমুক লেখকের নাম থাকলেই ভালো ব্যবসা হবে। কিন্তু লেখার ভেতরে কী আছে, সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করেন না। তবে এটাও সত্যি যে, বড় মাপের লেখকের সব লেখাই শক্তিশালী হয় না, কিছু দুর্বল লেখা বা লেখায় ভুলও থাকে। সম্পাদকের উচিত, সেটাকে সংশোধন করতে প্রথমে লেখককেই উদ্বুদ্ধ করা। তিনি রাজি না হলে বা কোনোক্রমেই যদি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার সময়-সুযোগ না থাকে, তবে নিজেই ঠিক করা শ্রেয়।
সম্পাদক সর্বদা ব্যস্ত থাকেন। তাই কাজের ভিড়ে সব সময় হয়তো লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় না। যদিও বর্তমান সময়ে যোগাযোগ করাটা খুব সহজ। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যোগাযোগ ছাড়াই তিনি প্রয়োজনে লেখার ওপর কলম চালাতে পারেন। কেননা সম্পাদকের অধিকার রয়েছে লেখকের অনুমতি ছাড়াই ভুল সংশোধন করার। সেক্ষেত্রে যদি সম্পাদককে কিছুটা নিষ্ঠুর হতে হয়, তবে তিনি শিল্পের প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হতেও কার্পণ্যবোধ করবেন না। আবার না জানিয়ে কিছু পরিবর্তন করার মানেও অনেক সময় লেখককে অসম্মান করার শামিল। তাই সম্পাদকের যেমন উচিত নয় নিজেকে সবজান্তা মনে করে সব লেখাকে সম্পাদনা করা, তেমনি লেখকেরও নিজেকে সবজান্তা মনে করা ঠিক নয়। সম্পাদক নিজের অভিমত ব্যক্ত করে লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা উচিত। কারণ সম্পাদক মানেই একজন রূপদক্ষ শিল্পী। যিনি শিল্পের বাড়িঘর চেনেন এবং শিল্পের যথাযোগ্য মেরামত করতেও জানেন। এক কথায় একজন সম্পাদক অভিভাবক হিসেবে বিবেচিত হন, যেহেতু তার হাত ধরেই উঠে আসেন বহু লেখক। তিনি লেখকদের লেখা ছাপিয়ে অনুপ্রাণিত করেন এবং লেখক তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। সম্পাদকের একটু উৎসাহ পেলেই অনেক প্রতিভা উঠে আসা সম্ভব। আবার সম্পাদকের নিরুৎসাহের কারণে ও অসংখ্য লেখকের প্রতিভা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই সম্পাদকের উচিত লেখকদের উৎসাহ দেওয়া, অনুপ্রাণিত করা। যেন তারা শিল্প সৃষ্টিতে আগ্রহী হন এবং তাদের ভেতর নতুন নতুন সৃষ্টির তাড়না জাগে।
বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকেই বহু সাহিত্য সম্পাদক লেখকদের বিকাশে ও লালনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন। এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। তাদের মধ্যে যোগ্য সম্পাদকের উদাহরণ হিসেবে সব্যসাচী লেখক ও গুণী সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর কথা উল্লেখ করা যায়। তার সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার (যদিও প্রথম দু’বছর পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছিলেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র) মাধ্যমে তৎকালীন সময়ে অনেক কবি উঠে এসেছেন, যারা বাংলা সাহিত্যে নিজেদের অনন্য প্রতিভার মাধ্যমে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। এখনও রেখে চলেছেন। অবিভিক্ত ভারতে তখনকার সময়ে কবিদের একটু স্বস্তিতে শ্বাস ফেলে বাঁচার এবং আশ্রয় নেওয়ার জায়গা ছিল ‘কবিতা’ পত্রিকা। এই পত্রিকা থেকেই অসংখ্য বিখ্যাত লেখক উঠে এসেছেন। যারা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং সাহিত্যে রাজত্ব করেছেন শক্তিশালীভাবে। ‘কবিতা’ পত্রিকার পঁচিশ বছরের জীবনকালে মোট ৩৪৫জন লেখক এতে অবদান রেখে গেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অজিত দত্ত, প্রতিভা বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, পরিমল রায়, নরেশ গুহ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অমিয় চক্রবর্তী, কামাক্ষী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আবু সয়ীদ আইয়ুব, হুমায়ুন কবির, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আনোয়ার পাশা, আল মাহমুদ, মোফাজ্জাল হায়দার চৌধুরী, আলাউদ্দীন আল আজাদ, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বর্তমানে আমাদের দেশে যোগ্য সম্পাদকের বড় অভাব। যে হারে লেখক বাড়ছে সে তুলনায় অভিজ্ঞ সম্পাদক একেবারে হাতে গোনা। প্রায় সময় সম্পাদনা ছাড়া লেখা বা বই প্রকাশিত হওয়ায় পাঠকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার কোনো কোনো শব্দের অর্থ না বুঝলে কেটেছেঁটে নিজের মতো করে বসিয়ে দেওয়ার কারণেও লেখার মান হালকা হয়ে যায়। ফলে লেখকের অতৃপ্তি থেকেই যায়। তাই সম্পাদকের ধৈর্য ও অভিজ্ঞতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় মফস্বলের লেখকদের লেখাকে মূল্যায়ন করা হয় না, বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। বিষয়টি পীড়াদায়ক। আমরা জানি লেখকদের প্রতিটি লেখা নিজের কাছে সন্তান তুল্য। দশমাস দশদিন একটি সন্তানকে মা যেমন গর্ভে ধারণ করেন তেমনি একটি লেখা যত্ন, ভালোবাসা ও ত্যাগের বিনিময়ে তৈরি করেন লেখক। কম্পোজ করতে বা লিখতে গেলে নিজের অজান্তে অনেক ভুল হয়। বানানসহ ছোটখাটো ভুল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু ভুল মানুষ মাত্রই।
আগে সন্তান জন্ম হতো ধাত্রীর হাতে। বর্তমানে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মানুষ ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছেন সুস্থ, সুন্দর সন্তান ও মায়ের স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা ভেবে। তদ্রূপ শুধু বানান সংশোধন নয়; একটি লেখাকে পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি, সুন্দর, মার্জিত ও রুচিশীল করতে সম্পাদকের বিকল্প নেই। তাই সম্পাদকের প্রতি লেখকের নির্ভরশীলতা ও আস্থার জায়গাটি তৈরি করতে হবে। লেখক তার চিন্তা, চেতনা, ভাবনার বহিঃপ্রকাশ করেন একটি লেখার মাধ্যমে। যদিও সব লেখকের লেখার মান কিংবা বিষয়বস্তু এক নয়, কিন্তু লেখাটি স্বাচ্ছন্দ্যে পড়ার বিষয়টি মাথায় রাখেন সম্পাদক। তাই সম্পাদক সম্পাদনা করতে পারেন এই মানসিকতাটুকু নিয়েই সম্পাদকের কাছে লেখা পাঠানো উচিত। আমি মনে করি লেখা ছাপার আগে বা বই প্রকাশের আগে সম্পাদনা অপরিহার্য এবং সম্পাদনার কোনো বিকল্প নেই। আমার সঙ্গে সবাই একমত না-ও হতে পারেন, এটাই স্বাভাবিক।
লেখক ও সম্পাদকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই—কোন জাতি, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এমন লেখা যেমন লেখা ঠিক নয়, তেমনি তা প্রকাশ করাও উচিত নয়।