এক, দুই, তিন… এভাবে ঘুরতে থাকে ক্যালেন্ডারে তারিখের ঘর, ঋতুর আবর্তে, তার সঙ্গে আমাদেরই পার্থিব ও আনুষঙ্গিক উৎসবের ভেতর বড় বড় লাল চোখ নিয়ে আসে ভয়। তুমুল সতর্কতার ভেতরেও, কোলাহল আর উল্লাসের ফোঁকর ধরে সে দিয়ে উঠে অট্টহাসি। বেপথু— আরও সুন্দর করে বললে অমানবিক আর প্রতিক্রিয়াশীল হৃদয়ের দহনে পুড়তে হয় সময়কে, সময়ের বিবেক আর সাহসী সন্তানদের। প্রায়ই নাগরিক হিসেবে উৎকণ্ঠার ভেতরে যেতে হয় আমাদের, মিথ্যে আর অভিনয়ের সঙ্গে যেতে যেতে আমাদের অনুভূতিরাও কখন যেন ভোঁতা আর ভাতো হয়ে গেছে! খেলো আবেগের কথা বলি বটে আড়ালে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করি নিজেকে, নিজেরই অন্যরকম পরিচয়কে। এরপরও সাধারণ আর লেখকে পার্থক্য থাকে, লেখক আর দ্রষ্টায় পার্থক্য থাকে। হামলাকারীরা দ্রষ্টাকে খোঁজে—যার আলোয় তাদের অন্ধকার নেভার সম্ভাবনা, তাদেরই টার্গেট করে, ঐতিহাসিক-সাম্প্রতিকতম অভিজ্ঞতা তা-ই।
আমরা জানি, যুগে যুগে কেউ একজন বা কয়েকজন দাঁড়িয়ে যান নিজগুণে, নিজের মেধা-প্রজ্ঞা আর সময়ের দাবিতে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিশ্চয়ই আমাদের এই সময়ের আলোকবর্তিকা, দিক-দেশনাকারী এবং ঋজু মেরুদণ্ডের একজন মানবিক মানুষ। শুধু পস্ট বলেই তিনি আড়ালে চলে যান না, সমানে কলমে স্বপ্ন দেখান, স্বপ্নের মানুষে ক্রমশ পরিণত করেন নিজেকে। অথচ এমন মানুষকেই রক্তাক্ত করতে বাধে না এদেশের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা বিভ্রান্ত তরুণের! পেছন থেকে চাকুতে রক্ত ঝরায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের। নিদারুন ব্যথায় তিনি কাতর, এরপরও বললেন, আই এম অলরাইট, তোমরা উত্তেজিত হয়ো না। এখানেই আমরা চিনতে সচেষ্ট হই ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মানসগঠন। তিনি যে রুচির মানুষ, যে মনের মানুষ, তা-ই যেন সচেতনতায় বটে আক্রান্ত হওয়ার পরেও বলে যান সমানতালে। হয়তো এ কারণেই তিনি টার্গেট বিপদগামীদের, তাকে পেছন থেকে হামলা করে শান্তি পায় মূর্খরা। আমাদের আটদশজন বাঙালির গড়পড়তা যে মেজাজ, যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির অনুকূলে তখন পরিবেশ, হয়তো হামলাকারীকে ধরে আচ্ছামতো পেটাবো বা নিজেই চোখের ঝাল মেটানোর যাবতীয় আয়োজন সারতো। কিন্তু ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের উত্তেজিত হয়ো না বাক্যের কাছে হার মানতে হয় সময়কে, রাষ্ট্রব্যবস্থা আর পরিপার্শ্বকে। মহানেরা এভাবেই শিক্ষা দেন, এভাবেই তারা আলোকিত করেন সময়কে।
ক্ষমা কি তবু করে দেওয়া যায় দুবৃর্ত্তকে? হামলাকারী আর কালিমা লেপনকারীকে? উত্তেজিত না হতে বারণ করা নিশ্চয়ই দুর্বলতা নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের যে উদাসীনতা, তারই পশ্চাতে বেরিয়ে আসা পুঁজকে যখন কোনো মহান এভাবেই প্রশ্নের আওতায় আনেন তখন আর নীরব থাকা যায় না। আমাদের নিকট-অতীতও খুব সুখের নয়, ইতিহাস তো আছেই। বিশেষত তরুণদের আর্তনাদে হাহাকার করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। একেবারে হৃদয়ের আত্মীয় হারানোর নীলে ভারাক্রান্ত একেকটা পোস্ট। নিন্দা, ধীক্কার আর বিচারের যে বাণী ফেসবুকে মাতম তুলছে তাকে শুধুই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কিংবা প্রাযুক্তিক সুবিধা হিসেবে গোনায় ধরে লাভ নেই— এটাই এখন বাস্তবতা, বাংলাদেশ নয় শুধু, বিশ্বেও। রাস্তায় মিছিল হচ্ছে, মানবন্ধন হচ্ছে—ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে। এমন বাস্তবতাকে সামনে রেখে আমাদের যে প্রশাসনিক দৈন্য কবুল করেই নিকটে গজানো জীবাণুপুঞ্জকে ধ্বংস করার আয়োজন করতে হবে সমূলে। যে তরুণটি ফাগুনের এমন দিনে রঙের হোলিখেলার উৎসবে মাতোয়ালা হবার কথা, যে তরুণটি তার কাজে মন দেওয়ার কথা, কবিতা লেখা কিংবা পড়ার কথা তাকেই আজ বলতে হচ্ছে— স্যার, আমরা লজ্জিত! যারা লজ্জা বয়ে আনে পরিকল্পিতভাবে, যারা লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায় প্রতিনিয়ত, যারা লজ্জাকে পৃষ্টপোষকতা দেয়— তাদের নির্মূল করার এখনই সময়। আমরা আর বলতে চাই না, দুঃখের কথা, স্যরি বললেই যে সমাধান, তা মানতে নারাজ আমাদেরই তরুণ দ্রোহী মন।
দুই.
কিছুদিন আগেই ঘুরে এসেছি ঢাকায় প্রাণের বইমেলা থেকে। চারদিকে প্রাণের আয়োজন। নতুন বইয়ের তাজা ঘ্রাণ আর লেখক-পাঠকের ব্যস্ততাকে নিজ চোখে উপভোগ করার মজাই আলাদা। অন্তহীন ভাবনা থেকে তুলে আনা একেকটি শব্দে যে উদ্বেল আর আনন্দ তা অনিন্দ্যই। মানুষের দুঃখ আর হাহাকারগুলো যদি কিনে নিতে পারতাম সুন্দর একটি বইয়ের বিনিময়ে! তবুও মানুষ কি বই পড়ে? তা না পড়ুন, কেউ কেউ পড়েন। তরুণপ্রজন্মকে বিশেষ করে, শিশু-কিশোরকে পাঠমুখি করতে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের যে প্রয়াস তাকে স্যালুট করতেই হয়। শিশুরা—যাদেরই হাতে আগামীর বাংলাদেশ, তারা লাইন ধরে কিনছে তার বই। স্বভাবতই সময় এখন বিজ্ঞানের, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাকে উন্নয়ন করতে নিজের অজান্তেই শিশুরা বেচে নিচ্ছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই। একজন মানুষ—একাই যিনি বাংলাদেশকে আধুনিকতার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি চাইলে বিভুঁয়ে আয়েশী জীবন কাটাতে পারতেন। তাকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বক্তৃতা দিতে হতো না, বইপড়া নিয়ে কথা বলতে হতো না, আদালতে সাক্ষ্য দিতে হতো না, সমাবর্তনে নীতিকথা শোনাতে হতো না। অথচ তিনি এসব কষ্ট নিজেই কবুল করে নিয়েছেন দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা ভেবে, হয়তো শরীরে তার শহীদের রক্ত বলে! আজ শহীদের সন্তানের পেছনে যে ছুরিকাঘাত হয়, তা প্রকারন্তরে বাংলাদেশের শরীরেই আঘাত।
আহা, বইমেলার রঙিন সময় শেষে যখন টিএসসির দিকে আসি নিজের অজান্তেই ভর করে ভয়। এত কোলাহল, এত অনুষ্ঠান, তারুণ্যের আড্ডা এরপরেও একজন মানুষকে এখানেই কিভাবে জলজ্যান্ত খুন করে পাষাণেরা! আমরা কি এতটাই নির্লিপ্ত আর এককেন্দ্রিক হয়ে গেছি যে, কারো বিপদেই এগিয়ে আসবো না? অভিজিৎ, ভাই আমার, ক্ষমা করো আমাদের। এর আগে ও পরে আরো নানান রক্তাভ ঘটনা আমাদের আবেগকে তাড়িত করেছে, ফেসবুকে কি ব্লগে একটু সরব করছে—কিন্তু কাজের কাজ যা, তা হয়নি। বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি দিনকে দিন আমরা বড় করে তুলছি তা-ই আজ বিশ্বজিৎ-অভিজিৎ-দীপন হয়ে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের দিকে আসে। কিন্তু ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিজের জীবনের আরাম ত্যাগ করে যে উদাহরণ এই মরাদেশে তৈরি করে তার দাম কি রাষ্ট্রযন্ত্র দিতে পারে! পারলে কেনইবা তাকে বডিগার্ড নিয়ে থাকতে হবে? এদেশের সাধারণ মানুষ সত্যিকার অর্থেই অনিরাপদ প্রতি পদে পদে। এখানে একজন আমলার জন্য, একজন মন্ত্রীর জন্য বুকফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কচি শিক্ষার্থীদের। এখানে পরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে প্রশ্নফাঁসের অপমান, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে যুক্ত হয় কোটাপ্রথার বিষবৃক্ষ। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা আর মিথ্যের প্রশ্রয় আমাদের ক্রমশ করে তুলছে রোবট আর মায়াহীন মানুষে।
জুতো চুরির মামলায় কত কিছু হচ্ছে আজকাল—হাস্যকর হলেও সত্য যার অপরাধ যত বড়, তার মুক্তি ততই দ্রুত। ঐতিহাসিক অরাজকতার যে চর্চা দিনমান জারিত আছে আমাদের সমাজে-বিশ্বাসে তা সমূলে ধমন করতে হবে। বারবার ক্ষমা চাওয়া কাপুরুষের লক্ষণ, বারবার ক্ষমা করা? ক্ষমতা আর নির্বাচনের হিসেবে সাধারণ মানুষ নেই, শিল্পীত মানুষ নেই। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের হামলাকারীর বিরুদ্ধে আজকে যে সংঘবদ্ধ কিংবা ব্যক্তিক উদ্যোগ-প্রতিবাদ তাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েই এগুতে হবে আমাদের। জাতির এমন একজন মহান সন্তানের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় হামলা হতে পারে তা জগন্যতম দৃষ্টান্ত। আমাদের বিদ্যাপীঠগুলোয় অস্ত্রের চর্চা চলে, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে বলেই একজন পিশাচ নিরাপদে দাঁড়াতে পারে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের পেছনেই! এখান থেকেই আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। কোথায় আছে বিষবাষ্প—তা রাজনীতি আর মারপ্যাচের ঊর্ধ্বে উঠেই করতে হবে। আজকে বিপুল তরুণ যেভাবে জেগে উঠেছে ভার্চুয়াল ও বাস্তবতায় সেখান থেকেই ভয় পেতে হবে অপশক্তিকে এবং ভয় পাইয়ে দিয়ে বিচারের শক্তিকে শ্রদ্ধা করানোর আয়োজন করতে হবে রাষ্ট্রকেই!
জেগে ওঠা তারুণ্যকে আমাদের শ্রদ্ধা। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল—আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন, আপনাকে আমাদের তারুণ্যের খুব বেশি দরকার, আপনি তো জানেনই, তারুণ্য মানেই সমৃদ্ধ-সৃজনশীল বাংলাদেশ!