ছোটবেলায় জেলে-নৌকায় যেতে দেখতাম পাশের গ্রামের লোকদের। গভীর সমুদ্রে জাল ফেলে মাছ ধরে আনে তারা। বেশ কিছু দিনের জন্য একত্রে চলে যেত তারা। সঙ্গে খাবার-দাবার, প্রয়োজনীয় রসদ। তাদের পরিচালনার জন্য থাকতেন একজন মাঝি। তার বেতন বেশি, সুবিধা বেশি, শারীরিক কষ্ট কম, জলে নামতে হয় না ইত্যাদি। অথচ মাঝির হাতেই সুপ্রিম পাওয়ার, তার চালনাতেই চলে অন্যরা, এমনকি তিনিই বহদ্দারের একমাত্র বিশ্বস্থ প্রতিনিধি। ঝড়-তুফানে মাঝি আগলে রাখেন সহযোগীদের, প্রয়োজনে নির্দেশনা আর পরামর্শ দিয়েও। সাহিত্য সম্পাদককে মাঝিজীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়? মনে হয় তার কাজ আরও কঠিন। শক্তির কাজ যে কাউকে দিয়ে করানো যায়; বুদ্ধির কাজ, চিন্তার কাজ নয়। তাছাড়া সম্পাদকের জহুরিচোখকে আবিষ্কার করতে হয় সম্ভাবনার সূত্র। জেনারেশন গ্যাপ, রুচির ভিন্নতা, চিন্তার ফারাক ইত্যাদিতে ভারসাম্য আনতে হয় সাহিত্য সম্পাদককেই। ব্যতিক্রমী একটা আয়োজন কিংবা বিশেষ সংখ্যা মানেই যদি শুধু নির্ধারিত আর সিনিয়র লেখক হয় তাহলে অন্যায়; অগ্রজের ঋজু ভাষার পাশে কাঁপাকাঁপা তারুণ্যের উদ্ভাস ব্যালেন্সের জন্যও জরুরি। মুখচেনা রাজধানীবাসী কবি-লেখক নয়, পুরস্কারঅলা মানুষেরা নয়, সম্ভাবনাময়ী তরুণ—যারা কিনা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে, তাদের খুঁজে বের করে আনাই সাহিত্য সম্পাদকের কাজ।
ক্রিকেট বা ফুটবলে একজন প্লেয়ার শুরুর দিকে যে পজিশনে থাকে, সময়ের কারণে কিংবা তারই কারণে তাকে অন্য পশিজনে খেলাতে থাকে, তাতে তার শক্তির জায়গাটুকু আরও বিকশিত হয়। দুর্বলতা আর বিস্তারের জায়গাটুকু একজন তরুণ লিখিয়ের কাছে অচেনা, সে যেকোনো মাধ্যমেই লিখতে চায়, তার তারুণ্য বা কৌতূহল হেতু—এখানেই একজন আদর্শ সাহিত্যসম্পাদক পালন করেন কোচের ভূমিকা। খেলায় তাও জোরাজুরি চলে, কিন্তু সাহিত্যে? একজন তরুণ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা আর এষণাটুকু পেয়ে থাকে সাহিত্য সম্পাদকের দরবার থেকে। অবশ্য সাহিত্য সম্পাদককেন্দ্রিক মাজারের কথাও শোনা যায় লোকমুখে। যার কাজ স্তাবক বানানো। ইদানিং পাঠের চেয়ে বেশি প্রকাশের, নিজেকে জানার আগে জানানোর প্রবণতা প্রকট। তা তরুণদের বেশি—হোক পরিপাশ্বের কারণে কিংবা একাধিক প্রকাশমাধ্যমের জন্যে। তাদের এই স্বভাববৈশিষ্ট্যকে একজন সাহিত্য সম্পাদক পরিমিতি দান করেন। পাঠনির্দেশনার মাধ্যমে রুচিবোধ তৈরি করেন। অন্যান্য কাজে শারীরিক-স্বাস্থ্য ঠিক রাখলেও চলে কিন্তু একজন লেখককে ঠিকঠাক তৈরি করতে হয় মানসিক-স্বাস্থ্য; যা গঠনে ভূমিকা রাখেন একজন হৃদয়বান সাহিত্য সম্পাদক।
এটাও নিশ্চয়ই ঠিক, আপনি না চাইলে তিনি এগিয়ে আসবেন কেন? আগে নিজেকে বুঝতে হবে; যেহেতু লেখা যায় সাহিত্য সম্পাদক বরাবর, তাই লেখার বিষয়-আশয়, দুর্বল-সবল দিকগুলো নিয়ে আলোচনায় এগিয়ে আসতে পারেন সাহিত্য সম্পাদকই। যোগাযোগের মাধ্যম বেশ সহজ তাই হৃদ্যতা বাড়াতে আমাদের সামনে প্রতিবন্ধকতার সুযোগই নেই! একটা বিষয় আমাদের অবাক হতে হয়, বইমেলার পরিপ্রেক্ষিতে এখন হাজার হাজার বই বেরুচ্ছে, বেশির ভাগেরই প্রচ্ছদের দৈন্য, শ্রীহীন সেটাপ ও বানানবিভ্রাট চোখে পড়ার মতো। অথচ বিপুল পরিমাণ বই হচ্ছে নান্দনিক প্রচ্ছদে, দারুন সেটাপে—যা আমাদের প্রকাশনাশিল্পে মেধাবীদের পদচারণাকেই নির্দেশ করে। এই দুই শ্রেণীর গ্রন্থকারের দিকে তাকালে হয়তো দেখতে পাব, প্রথম কাতারের অনেকেই কোনোদিন কোনো ভালো সাহিত্যসম্পাদকের হাতে পড়েনি। তার মানে এই নয়, সাহিত্য সম্পাদকই আপনার বই করে দেবেন। অন্তত, একটা রুচিবোধ তৈরি করে দিচ্ছেন তারা। এমনও অনেক সাহিত্য সম্পাদক আছেন, যারা ব্যক্তিগতভাবে তরুণ লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, প্রয়োজনীয় আলাপ করেন সাহিত্য নিয়ে। পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া না থাকলে ভালো কিছু হতেই পারে না।
সাহিত্য গুরুমুখী বিদ্যা নয় নিশ্চয়ই। সাহিত্যিককে প্রতিনিয়ত পড়াশোনা আর দৃষ্টির প্রসারতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই হেতু সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে সাহিত্যিকের সম্পর্কও গুরু-শিষ্যের মতো নয়। একটা লেখা পাঠানোর পর সাহিত্য সম্পাদক তা হুবহু প্রকাশের ব্যবস্থা করবেন, না প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করবেন—এমন আওয়াজের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লেখা যদি হুবহু প্রকাশের মতো হয়, তবে প্রকাশ করবেন না কেন? ‘প্রয়োজনীয় সম্পাদনা’টুকু অবশ্যই করবেন। যেহেতু সাহিত্যিকদের কাজ শব্দ নিয়ে, অস্ত্র নিয়ে নয়; তাই একটি শব্দের প্রয়োজনীয় সম্পাদন-ক্ষমতা সাহিত্য সম্পাদক রাখেন। যিনি লেখেন, তিনি ঘোরের মধ্যেই থাকেন, কখনো বেখেয়ালে শব্দপ্রয়োগে এদিক-সেদিক হতেই পারে। বিশেষ করে কবিতা-ছড়ার ক্ষেত্রে একটি শব্দ বদলে দেওয়া মানেই পুরো কবিতা কি ছড়ার শরীরেই পরিবর্তন আনা। ছন্দ-মাত্রার ঘাটতি পূরণ করতে, কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে কিংবা মেদ ও অপ্রেয়োজনীয় অংশে কাঁচি চালানোর অধিকার সাহিত্য সম্পাদক রাখেন। এমনকি শিরোনাম বদলেও দিতে পারেন যদি তিনি তা উপযুক্ত মনে করেন।
সাহিত্য সম্পাদকের কাজই মূলত পড়া আর সম্পাদনা করা। তবে অনেক তরুণ সাহিত্য সম্পাদক হয়তো সম্পাদনা করতে চান না অনেক কিছুই ভেবে। আবার অনেকেই আছেন, তার প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে ছেড়ে কথা বলেন না। তা ব্যক্তিগত রেষারেষি নয় বরং সাহিত্যের খাতিরেই।
আমরা কী লেখার শরীর আমূল সম্পাদনার কথা বলবো? না কি শুধু তথ্যগত সম্পাদনার কথা? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলবো, লেখা প্রথমত লেখকের একান্তই নিজের, তারপর সাহিত্য সম্পাদকের হাত হয়ে পাঠকের দরবারে। লেখক ও পাঠকের মাঝখানে অবস্থান করেন সাহিত্য সম্পাদক। একটা লেখা উপস্থাপন করা মানে লেখককেই উপস্থাপন করা, সাহিত্য সম্পাদকের বিশ্বাস আর রুচিকে উপস্থাপন করা। তাই প্রকাশের আগে সাহিত্য সম্পাদক যদি ভাবেন, লেখাটি সম্পাদনা করা দরকার, তবে করবেন; প্রয়োজনে লেখা বদলিয়েও নিতে পারেন। আদর্শ সাহিত্য সম্পাদক যেকোনো কঠিন কী জটিল লেখাই লিখিয়ে নেন লেখকের কাছ থেকে। শুধু তাই নয়, প্রত্যাশিত লেখা পাওয়ার পর কঠিনমুখে বলেও দেন, তার প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার কথা, আশাহত হওয়ার কথা। তথ্যগত ভুল কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়, আজকের তথ্যবিভ্রাট আগামী দিনের বিকৃত ইতিহাস। তাই সাহিত্য সম্পাদক তথ্যবিভ্রাট দেখলেই সম্পাদনা করে নেবেন কোনো প্রকার আলাপ ছাড়াই। লেখকের সঙ্গে সাহিত্য সম্পাদক কথা বলবেন কি না, তা নির্ভর করে সম্পাদনার ধরন ও লেখার ওপর। খুব বেশি সমস্যা থাকলে, বিশেষ করে তরুণদের লেখায় তবে সাহিত্য সম্পাদক আলাপ করতে পারেন লেখকেরই আগামীর দিকে তাকিয়ে। একজন লেখক যেখানে লেখেন, যারা তার লেখা প্রকাশ করেন, তার মাধ্যমেই লেখকের বেড়ে ওঠা নির্ভর করে।
অনেক লেখকেই আছেন, যাদের বয়স অনেক, লেখার মান একেবারেই নবীন, কেন? সেটা হতে পারে সাহিত্য সম্পাদকের অদূরদর্শিতায়, লেখকের আত্মপ্রবঞ্চনায়। একজন লেখক শেষপর্যন্ত তার নামের সঙ্গে সাহিত্য সম্পাদকের পরিচয়কেও অনেক দূর টেনে নিয়ে যান। ‘কবিতা’-এ একটি লেখা ছাপালে কেন কবি-পরিচয় স্বীকৃত হয়ে যেত? আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের নাম কেন আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করি? কেউ বলেনি তাদের নাম নিতে, আমাদের ইতিহাসেই তাদের নাম খোদাই করে নিয়েছে। ইদানিং নানান জিজ্ঞাসার লেখা আসছে, নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তরুণেরা। তারও পেছনের শক্তি কিন্তু সাহিত্য সম্পাদক।
আমাদের সাম্প্রতিক গদ্য-সংকটের কারণ কী? তার দায়ও কিন্তু শেষপর্যন্ত সাহিত্য সম্পাদকের কাঁধে যাবে। তরুণদের দিয়ে সাহসী লেখা চর্চা করতে হবে, দুর্লভ-ধূলোধূসরিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের সামনে আনতে হবে তরুণদেরই নতুন কলমে, নতুন ভাবনায়। মনে রাখা উচিত কোনো অর্জনই প্রশ্নের বাইরে নয়, কোনো তত্ত্বই আলোচনার অতীত নয়; নতুনতর আলোয়, প্রাতিস্বিক বিশ্লেষণে উদ্ধুদ্ধ করার কাজটি যুগেযুগে সাহিত্য সম্পাদকই করেন। দুঃখের বিষয়, মুখচেনা আর বলয়কে রক্ষা করতে অনেক সাহিত্য সম্পাদকই ব্যস্ত থাকেন। তারাই নিক্ষিপ্ত হবেন আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা হতে পারে না—যে সব সাহিত্য সম্পাদক তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, নির্মোহ দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন, তাদের হাতেই পুষ্টি পাবে আমাদের তরুণ লেখক সম্প্রদায়।