নারী-পুরুষের সম্পর্ক প্রাকৃতিক; সহজাতও। প্রাগৈতিহাসিক কালের ধর্মীয় বিধি-বিধান থেকে শুরু করে একুশ শতকেও দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে পারিবারিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেটা যেমন দুজনের ব্যক্তিগত জীবনে, তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের পাশাপাশি গোটা সামাজিক জীবনেও। যদিও আমরা স্থান, দেশ ও লিঙ্গভেদে এই সম্পর্কের প্রকারভেদ দেখতে পাই। কখনো কোনো রাষ্ট্র সেই পরিবার বা সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেয়, কখনো দেয় না। এখানে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্পর্ককে ইঙ্গিত করছি, যেখানে উভয়েই উভয়ের সমকক্ষীয়। যেখানে ‘পার্টনারশিপ’ কথাটি প্রযোজ্য। আর্থিক, পেশীশক্তি কিংবা নির্দিষ্ট লিঙ্গের অধিকার বলে একপক্ষ অন্যপক্ষকে যাপিত জীবনে কর্তৃত্ব কিংবা আরও সূক্ষ্ম করে বলতে গেলে কোনো নেতিবাচক প্রভাব খাটাবে না। যাকে ফরাসি উত্তর আধুনিকতাবাদী দার্শনিক মিশেল ফুকো সংজ্ঞায়িত করে গেছেন ‘ডিসকোর্স’ বা ভাষার বলয়ের মাধ্যমে। এই বলয় যে সবসময় ভাষার মধ্যেই সীমিত থাকবে তা নয়, এই প্রভাব বা ‘পাওয়ার’ চর্চার বিষয়টি হতে পারে যেকোনো উপায়ে। যেমন হতে পারে কর্মস্থলে বিনা বাক্যব্যয়ে বিভাগীয় প্রধানের আদেশ পালন করার মাধ্যমে কিংবা নারীর পোশাকের ওপর বিধিনিষেধ, পুরুষ সঙ্গী কিংবা স্বামীর ইচ্ছা ও সুবিধানুযায়ী নারীর পেশা নির্বাচনের মাধ্যমে।
এই যে শুরুতেই যেই সম্পর্কের কথা বলে নেওয়া হয়েছে অর্থাৎ ‘পার্টনারশিপ’ সেই ধারণাটিই কিন্তু মূল ভাবার্থ থেকে সরে আসতে থাকে এতসব সূক্ষ্ম কিংবা স্থূল প্রভাব বা ‘ডমিনেন্স’র মাধ্যমে। তখন কিন্তু এই স্বামী-স্ত্রী বা কপোত-কপোতীর সম্পর্কটা আবদ্ধ হয়ে পরে ফুকোর সেই ডিসকোর্স বা প্রভাব আরোপের মধ্যে। এরপরও পুরুষতান্ত্রিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সার্বিক সমাজ স্বীকৃত এই ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখবার জন্য জেন্ডার ইনফেরিওর নারীর ‘দায়’টাই যেন বেশি। বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ শব্দচয়ন থেকে শুরু করে ভাষা, সম্বোধন প্রায় প্রতিটি সমাজই নিয়েছে খুব সাধারণভাবে। ‘ডিভোর্সি’ শব্দটা যতটা একটি পুরুষের জন্য নেতিবাচক তার থেকে শতগুণ বেশি নেতিবাচক একজন নারীর জন্য। যদিও ছ-সাত অক্ষরের এই শব্দটির মধ্যে লিঙ্গভেদে কোনো তারতম্য নেই কিন্তু। ‘একজন নারী তালাকপত্রে সই করলো! কেন সে আরেকটু চেষ্টা করলো না সংসারটি রক্ষার জন্য, এই সমাজে একজন স্বাধীন নারীর একাকী জীবন কত ভয়ঙ্কর, কে দেখে রাখবে তাকে, আবার কে বিয়ে করবে এই নষ্ট মেয়েকে কিংবা আরও ভয়ঙ্করভাবে স্বামীর নির্যাতন আর কিছুদিন সহ্যই করা যেতো, যতই হোক পুরুষ তো রাগ একটু বেশি থাকবেই!’ এই বাক্যগুলো প্রতিটি সমাজে প্রায় প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হয়তো অর্থ ও পদমর্যাদার আসীনে একটু রকমফের দেখা যায়, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজের তথাকথিত বিবেকবানরাই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে যান এসব আলোচনার প্রসঙ্গে। শেষ কথা, একটিই সম্পর্ক রক্ষার গুরুভার শুধু একজন নারীর।
তখনই এই পুরুষ শ্রেণী নারীকে দেখতে শুরু করে সন্তান উৎপাদনের ‘উপকরণ’ হিসেবে। আর এই ধারা আধুনিক এই পুঁজিবাদ সমাজে আরও প্রবল। সংসার ছাড়াও যদি কোনো প্রেমের সম্পর্কও হয়, সেখানেও গঞ্জনার ভার নারীরই বেশি।
কেন এই অলিখিত বিধান শুধু নারীর জন্যেই, ফুকোর ক্ষমতার রাজনীতি এবং এঙ্গেলসের সম্পত্তির সূত্রপাত যখন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কোনো সমস্যা খতিয়ে দেখা হয়, তখন আগেই বোঝা প্রয়োজন সেই সমাজ কাঠামো এবং সেখানে বিদ্যমান সমস্যার অন্তর্নিহিত মূল কারণগুলো। আমাদের এই প্রবন্ধের সমস্যা ও প্রশ্ন হল কেন নারী বা কোনো মেয়েকেই প্রেম, বৈবাহিক কিংবা দাম্পত্য সম্পর্ক সঠিকভাবে পরিচালনা করার দায়ভার দেওয়া হয়। এক বাক্যে এর প্রধাণ ও অন্যতম কারণ হলো, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। একটি সমাজের অন্তর্গত অনেক প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। সমাজবিজ্ঞানীরা এই সমাজকে যদি পরিপূর্ণ একটি মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে সেখানে এই বহুবিধ প্রতিষ্ঠানগুলো শরীরের একেকটি অঙ্গ হিসেবে কাজ করে। সমাজ সুষ্ঠুভাবে জিইয়ে রাখার জন্য প্রতিটি সংগঠন বা সংস্থার সঠিকভাবে প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন ভেবে কাজ করা প্রয়োজন। কিন্তু আদতে কী তাই হয়? বাস্তবতা বলে আমাদের সমাজ এবং এর প্রতিটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। পরিবার থেকে শুরু করে কী ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, গণমাধ্যম অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি। যেখানেও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে পরিসংখ্যানের বিভিন্ন মাত্রা তুলে ধরা হচ্ছে, সেখানেও সেই ক্ষমতায়িত নারীটিও অনেক ক্ষেত্রে ফুকোর পাওয়ার রাজনীতিতে প্রান্তে অবস্থান করেন। আর এই যে প্রতিটি ক্ষেত্রে, পরিবারের রীতিনীতি থেকে শুরু করে শব্দচয়ন, পোশাক এমনকি তার রঙ, শিশু বয়স থেকে খেলনার ধরন নির্ধারণ করে দেওয়া সবকিছুই আমাদের মনোজগতে খুব সূক্ষ্মভাবে এই ডিসকোর্স বা বিধিনিষেধগুলো প্রবেশ করিয়ে দেয়।
আমরা আমৃত্যু এসবের মধ্যেই মেনে চলি, হয়তো কেউ একাধারে কেউবা একটু কম। আর এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোই পোশাক পরিচ্ছদের মতোই এও নির্ধারণ করে দেয়, সংসার কিংবা একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য একজন নারীরই ভূমিকা বেশি। কারণ, তথাকথিত ‘ছেলেরা একটু রগচটা হবেই, ঘর সামলানোর দায়িত্ব তো মেয়েদেরই, প্রেম করেছ ছাড় তো তোমাকেই বেশি দিতে হবে, যতই পড়ালেখা কর স্বামী এবং সন্তান আগে’—এমনতর জ্ঞান আমরা শুনেই আসি আমাদের খুব কাছের প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকে। এই বাক্যগুলো একইসঙ্গে যেমন নারীকে বলে দেয় তাকে সহনশীল হতে হবে চরম পর্যায়েও (রামের স্ত্রী সীতা সহ্য ও সহনশীলতার পরীক্ষা দিয়েই শেষ রক্ষা পায়নি) আবার একজন ছেলে শিশুকেও বুঝিয়ে দেয় দায়ভারবিহীন ভবিষ্যতের কর্তাব্যক্তি সেই। তাই তো এখন আমরা দেখি যথেষ্ট যোগ্য ও শিক্ষিত নারীও যদি তথাকথিত বয়সের সীমা পেরিয়ে যান তাহলে তাকে যে কোন গোছের একজন পাত্রের কাছে সঁপে দিলেই পরিবার, ধর্ম এবং সমাজের কর্তব্য মিটে যায়। সেই যোগ্য নারীটিকে অপাত্রে পরেও আবার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য।
কত উপায়ে সে তার শ্বশুরপক্ষের লোকদের মনোরঞ্জন করবেন, সারাদিন করপোরেট অফিস শেষে খাবার রান্নার কাজটা তাকেই করতে হবে, কেননা এর স্বাদের ওপর সার্টিফিকেট দেবেন তার শ্বশুরপক্ষ। অথচ খাদ্য তৈরি বা দৈনিক গৃহস্থালি কাজের কিন্তু নারী-পুরুষ ভাগ নেই। বরং সভ্যতার শুরুতে নারীদের অগ্রগামিতা ছিল পুরুষের সমকক্ষ। কিন্তু জার্মান দার্শনিক এবং সমাজবিজ্ঞানী ফ্রেড্রিক এঙ্গেলসের মতে এই হিসাব পাল্টে যেতে থাকে, যখনই সম্পত্তির ধারণার সূত্রপাত হয় সমাজে। তখনই এই পুরুষ শ্রেণী নারীকে দেখতে শুরু করে সন্তান উৎপাদনের ‘উপকরণ’ হিসেবে। আর এই ধারা আধুনিক এই পুঁজিবাদ সমাজে আরও প্রবল। সংসার ছাড়াও যদি কোনো প্রেমের সম্পর্কও হয়, সেখানেও গঞ্জনার ভার নারীরই বেশি।
আর স্বাভাবিকভাবেই কর্তার আসনে পুরুষ যেখানে আসীন, সেখানে কর্তার সন্তুষ্টির জন্য নারীকে সহনশীল হতেই হবে। আর এর ক্ষুদ্রতম প্রয়োগ দেখা যায় সম্পর্কের দায়ভার মেটানোর মাধ্যমেও।
সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স’র একটি স্টাডি ও স্টুয়ার্ট হলের রেপ্রিজেন্টেশন তত্ত্ব দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার একটি কলামে ২০১০ সালে পরিচালিত একটি সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স’র একটি স্টাডির কথা তুলে ধরা হয়। সেখানে একইভাবে এই পুরুষতান্ত্রিক প্রথা, ব্যবস্থার কথাই বলা হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে পরিবার, ধর্ম, সমাজের আদব-কেতা আমাদের শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়, ‘মেয়ে তোমাকে সহনশীল হতে হবে। কেননা এটি প্রকৃতি প্রদত্ত’। এই যে প্রকৃতিকে ব্যবহার করে শব্দচয়ন বা বাক্যগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এর কিন্তু বিপরীত অজস্র প্রমাণও রয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কলামে নির্দিষ্ট করে গণমাধ্যমের উপস্থাপনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আমরা যদি একটু সূক্ষ্মভাবে দেখার চেষ্টা করি তবে দেখতে পাবো, বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমাতেই খামখেয়ালি, অগোছালো, রগচটা, শুধুই করপোরেট জগতে দায়িত্বশীল পুরুষ চরিত্রদের দেখতে পাই। আবার এরাই কিন্তু গণমাধ্যম আধেয়র নায়ক কিংবা ‘সুপারহিরো’। আর বিপরীতে খুবই পরিপাটি, দায়িত্বশীল, স্নেহের মমতা, ধৈর্যশীল, অন্যকে খুশি করার মতন চরিত্র দেখতে পাই নারীদের জন্যে।
এছাড়া, এমনতর উদাহরণ কিন্তু অনেক পাওয়া যাবে আমাদের চলচ্চিত্রগুলোয়। পার্শ্ববর্তী ভারতের বলিউড এমনকী হলিউডেও। সেখানে নায়কের পৌরুষত্ব প্রকাশ পায় অধিক নারীরদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে। কিন্তু বিপরীতে নায়িকাকে উপস্থাপন করা হবে এই নষ্ট নায়কের জন্যে ‘সতী’ হয়ে থাকার প্রতীক্ষায়।
এই যে নারীদের এমনতর উপস্থাপন একে সমাজতাত্ত্বিক স্টুয়ার্ট হল সংজ্ঞায়িত করেন ‘রেপ্রিজেন্টেশন’ তত্ত্বের আলোকে। বিভিন্ন ভাষা, চিহ্ন, ছবি, বস্তুর মাধ্যমে যখন কোনো অর্থ আরোপ করার চেষ্টা করা হয়, যেই চেষ্টাটি করে আমাদের সমাজ এবং যেটি যুগের পর যুগ টিকিয়ে রাখার একটি ক্ষমতার রাজনীতি চালানো হয় এই পুঁজিবাদী সমাজে। তাই তো আমাদের গণমাধ্যম কিংবা যেকোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান নারীকে সর্বদাই সহনশীল, ‘সতী’ হিসেবে দেখাতে পছন্দ করে। নারীবাদী ব্রিটিশ চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক লরা মালভে’ মেল গেইজ তত্ত্বের আলোকে বলা চলে সবকিছুই নির্মাণ ও পরিচালনা করা পুরুষের দৃষ্টি এবং আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী। আর স্বাভাবিকভাবেই কর্তার আসনে পুরুষ যেখানে আসীন, সেখানে কর্তার সন্তুষ্টির জন্য নারীকে সহনশীল হতেই হবে। আর এর ক্ষুদ্রতম প্রয়োগ দেখা যায় সম্পর্কের দায়ভার মেটানোর মাধ্যমেও।