ক.
শেকড়ের সঙ্গে দৌঁড়-ঝাঁপ, লম্ফ-ঝম্প শেষে
মেপল বীথির ঝরাপাতা মাড়িয়ে দিব্যি তারা
ঘুরে এলো পাইন বনের এ মাথা ও মাথা,
কিছু কিছু শস্যের সীমানা প্রাচীর নেই জেনে
আদিগন্ত সবুজেরা হেসে কুটিপাটি;
ধাবমান মায়াবী হরিণ দেখে
অবাক চোখে চেয়ে থাকে বুনো আপেলের দল।
[সবুজ গলিয়ে ]
কবিতার এই উদ্ধৃতিটুকু যার, তিনি একজন কবি, প্রাবন্ধিক, চমৎকার বক্তা, সফল অধ্যাপক এবং একজন সার্থক মা ও স্ত্রী। তারচেয়েও শত শতগুণ বেশি একজন প্রেমী। যিনি ভালোবেসে জয় করেছেন কবি রফিক আজাদের হৃদয়। সে ভালোবাসা আজও অম্লান-অক্ষয়। তাই প্রায় সময়ই তাকে বলি, আপনি আমার দৃষ্টিতে যত না একজন কবির সহধর্মিণী, তারও চেয়ে অনেক বেশি একজন প্রেমিকা। তিনি শুধু হাসেন। এই মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় ত্রিশ বছরেও অধিক। যে আত্মিক বন্ধনের নৌকা একদিন ভাসিয়েছিলাম আমাদের জন্মভূমি নদী-মেখলা বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তরে, বইমেলার উদাত্ত প্রাঙ্গণে, কিংবা ঝড় তোলা আড্ডায়, সে নাও এখন নোঙর ফেলেছে কানাডার টরন্টো শহরে। এখানে তাকে পেয়েছি উদ্ভাসিত আলোর প্রতিনিধি হিসাবে। তিনি এমন একজন মানুষ, যাকে অবলীলায় নির্ভর করা যায়। বলা যায় মন-প্রাণ খুলে দিগন্তের গভীর বার্তা।
হেসে সম্মতি দিতাম। আমি আর আপা বিকেলের নাস্তা ও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জীবনের নানান বিষয়-আশয় নিয়ে আলাপে মেতে উঠতাম।
হ্যাঁ, যাকে নিয়ে এই প্রারম্ভিকতা, আজ ২০ নভেম্বর, তার জন্মদিন। তিনি দিলারা হাফিজ। সবার প্রিয়জন, আপন ও অদেখা মমত্বের বন্ধন দিয়ে গড়া এক ছায়া-মায়া-ভালোবাসার নাম। ইংরেজিতে ‘ম্যাচুরিটি’ বলে একটি চমৎকার শব্দ আছে। যা কিনা আজকের দিনে জন্মগ্রহণকারী কবি দিলারা হাফিজের ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য বলে মনে করি। কারণ, অনেক সময় বিভিন্ন অভিমতে তাকে পেয়েছি চমৎকার বিশ্লেষণ ও দর্শনের নিরিখে আলোকপাত করা একজন ঋদ্ধ বক্তা হিসেবে।
খ.
যখন বয়স আমার পঁয়ষট্টি পারের নৌকায় পা রেখে
দুলছে ক্রমশ,
যখন প্রতি মুহূর্তের ঋণাত্নক মানুষ
মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষায় সময় গুনতে থাকে কণিষ্ঠার কড়ে,
তখন এতো কি সহজ সুখী সুখীভাবে
হেমন্তের হলুদ পাতার হাসিটি মুখে ধরে রাখা?
[বলা-কওয়া নেই]
নিজের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে লেখা এই কবিতার কবি, দিলারা হাফিজকে চিনি আমার কবিতা জীবনে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। পরবর্তী সময়ে বহুবার দেখা হয়েছে, নানা পরিবেশে। অধ্যাপক হিসেবে তাকে যত না দেখেছি তারচেয়ে বহুগুণ বেশি পেয়েছি একজন কবি, বন্ধু ও প্রিয়জন হিসেবে।
নব্বই দশকের শেষের দিকে প্রায় বিকেলে চলে যেতাম তার ধানমন্ডির এক নম্বর রোডের বাড়িতে। যেখানে আরও আছেন, বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম মহান কবি রফিক আজাদ। কাজেই কখনো ইচ্ছে হলেই বিকেলটা তাদের সঙ্গে কাটাতে সোজা চলে যেতাম। নানা বিষয়ে আড্ডা হতো। আপা হাতের কাজ গুছিয়ে বসে যেতেন। জীবনের নানা সময়ে তাদের অনেক প্রতিকূলতা গেছে, কিন্তু কখনোই সেসব বুঝতে দেননি। আমার মতো সেদিনের একজন বয়ঃকনিষ্ঠ কবিতাকর্মীকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন আন্তরিক মেলবন্ধনে। আড্ডার এক ফাকে রফিক ভাই আস্তে ধীরে রেডি হয়ে রওয়ানা দিতেন সোনালি শিশিরের উদ্দেশে। যাওয়ার সময় খুব মোলায়েম কণ্ঠে বলে যেতেন, তোমরা গল্প করো, আমি একটু ঘুরে আসি। হেসে সম্মতি দিতাম। আমি আর আপা বিকেলের নাস্তা ও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জীবনের নানান বিষয়-আশয় নিয়ে আলাপে মেতে উঠতাম।
এছাড়া, জাতীয় কবিতা পরিষদের জন্মলগ্ন থেকে কবি রফিক আজাদের সঙ্গে পেয়েছি কবি দিলারা হাফিজকেও। সবসময়ও তিনি আন্তরিক সমর্থন দিয়ে কবিতা পরিষদে সঙ্গে থেকেছেন এবং এখনো আছেন।
গ.
কানাডায় স্থায়ী হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর দেখা হয়নি। মাঝে জানলাম, তাদের বড় ছেলে অভিন্ন টরন্টোতে পড়তে এসেছে। শুনে খুব ভালো লাগলো। যাক এবার হয়তো কবি দম্পতির সঙ্গে দেখা হবে। অতপর দেখা হয়েছে দুজনের সঙ্গে। ২০০৮ সালে রফিক ভাই ও দিলারা আপা এসেছেন টরন্টোতে। আমাকে খুঁজছেন মনে মনে। কোথাও না পেয়ে অবশেষে দুই-একজনকে জিজ্ঞেস করে আমার মোবাইল নাম্বার জোগাড় করলেন। আপার ফোন পেয়ে আমি এত খুশি হই যে, দেখা করার জন্য একটি দিনও ঠিক করে ফেলি। সেকথা বন্ধু-দম্পতি মিশুক মুনীর ও মঞ্জুলী কাজীকে জানালাম, ওরা আগ্রহ সহকারে ওদের গ্রে-স্টোনের ওয়াক ড্রাইভেরর কন্ডোতে কবি রফিক আজাদ ও দিলারা হাফিজকে আন্তরিক আমন্ত্রণ জানালো। অনেকদিন পর ওখানে দেখা হলো কবি-দম্পতির সঙ্গে। আমাকে পেয়ে মিষ্টি বকার সঙ্গে অনেক আদরও জানালেন দুজন। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত পানাহার ও আড্ডায় মত্ত হয়ে, ফিরতি সময়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। রন্ধন-পটু মিশুক সেদিন অনেক মজার মজার আইটেম নিজের হাতে রান্না করে আপ্যায়ন করেছিল। মঞ্জুলী ও মিশুকের সেই অনাবিল আন্তরিকতার কথা এখনো স্মরণ করি। ২০১১ সালে মিশুকের অকস্মাৎ চলে যাওয়া আমাদের হৃদয়ে প্রবল এক ক্ষত ও চিরস্থায়ী যন্ত্রণা রেখে গেছে।
এদিকে, ঢাকায় গেলে বইমেলায় দেখা হয় রফিক ভাই ও দিলারা আপার সঙ্গে। ভালোলাগায় ভরে ওঠে সাক্ষাতের মুহূর্তগুলো। টরন্টোতে আসা-যাওয়ায় জড়িয়ে থাকতে থাকতে একদিন কবি দিলারা হাফিজের জীবনের ধ্রুবতারা কবি রফিক আজাদও চলে গেলেন, দিনটি ২০১৬ সালের ১২ মার্চ। খবরটা জানার পর থেকে দিলারা আপার কথা ঘুরেফিরে মনে হয়েছে। রফিক ভাইকে ছাড়া কী করে থাকছেন তিনি! সে বছর আমার গল-ব্লাডারে অস্ত্রোপচারের কারণে দেশে যেতে পারিনি। তাই টরন্টোতে বসে যখন রফিক ভাইয়ের প্রয়াণের খবরটা জানলাম, কত দিনের কত কথা, কত যে স্মৃতি সেলুলয়েডের ফিতের মতো চোখের সামনে ভেসে যেতে থাকে—সেসব আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো।
কে যে কার প্রতিবিম্ব, জানি না। তবে কবি দিলারা হাফিজের কবিতার সরল রৈখিক উচ্চারণ একথাই বলে যায়, কবিতা তার ব্যক্তিগত সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
কর্মজীবনে আনুষ্ঠানিক অবসর গ্রহণের পর, দিলারা আপা নিয়মিত টরন্টোতে আসেন কয়েক মাসের জন্য, তাকে পেয়ে খুব খুশি হলাম, এ-যেন এক অমূল্য প্রাপ্তি। শুরু হলো আমাদের হাজারো স্মৃতিরোমন্থন। প্রায়ই আড্ডা দিতে চলে যাই কবি-পুত্র অভিন্নের ডাউন-টাউনের আইসবোট টেরেস-এর কন্ডোতে। সেখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিএন টাওয়ার দেখি, দেশ ও আপনজনের গল্প করি, মাঝে মাঝে টিমহর্টন্স কফি শপে চলে যাই। সেখানে কফি ও ক্রোসানের সঙ্গে চলে আমাদের ঝুম আড্ডা। প্রায় গল্পের কেন্দ্র–বিন্দু রফিক আজাদ। কখনো কখনো সেসব আড্ডায় স্মৃতি কাতরতার গুঞ্জরনে কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে, সবার চোখ এড়িয়ে ঝরে পড়ে কয়েক ফোঁটা তরল মুক্তোদানা। বয়সের সব দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলারা হাফিজ যেন হয়ে ওঠেন আমার বন্ধু, কখনো মাতৃসমা বোন, আবার কখনো বা সাহিত্যযাত্রার সহযাত্রী। আমাদের দীর্ঘ দিনের পরিচয়ের এই তো উপহার-স্মৃতি, ভালোবাসা ও মমতার হাত ধরে নিঃস্বার্থ হেঁটে যাওয়া।
ঘ.
এবার একটু কবিতার কথায় আসি। কবিতা, এমন এক মোহময় শব্দ যার কানায় কানায় ভরে আছে এক একজন কবির বানভাসি জীবনের সব যাপন। সেই যাপিত জীবনের বাঁকে বাঁকে কত অজানারে জানতে পেলাম, কত অচেনারে দেখলাম চেনা মানুষের প্রতিবিম্বে। ঠিক সে-পথেই পরিচয় কবি দিলারা হাফিজের সঙ্গে। কবিতার জন্য আজন্ম তৃষ্ণা তাকে সেই ছাত্র-জীবন থেকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। জীবনের নানা সময়ে কবিতার সঙ্গেই তাকে পেয়েছি, দেখেছি। কবিতার তাড়নায় জীবনকে দাঁড় করিয়েছেন সমান্তরাল প্রতিবিম্বের মতো। কে যে কার প্রতিবিম্ব, জানি না। তবে কবি দিলারা হাফিজের কবিতার সরল রৈখিক উচ্চারণ একথাই বলে যায়, কবিতা তার ব্যক্তিগত সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
আমার যেটুকু সাধ্য-উস্কে দিই শিল্পের আগুন,
আমার আদরে বাড়ে—প্রাণপনে বয়স্ক বালক!
প্রেমিক ও পুত্র যেন দু’টি কক্ষ একটি বাড়ির:
মাতা ও দয়িতা দ্রুত দুই কক্ষে যাতায়াত করি!
বস্তুর জগত থেকে কালিঝুলি মেখে ফিরে এলে
আমি তাকে সান্ত্বনার ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে-মুছে নিই…
আমাকে জড়িয়ে বাড়ে, প্রতিদিন, বয়স্ক বালক।
[বয়স্ক বালক]
রফিক ভাই, সন্তান অভিন্ন, অব্যয়কে নিয়ে ব্যস্ত সাংসারিক জীবনেও কবিতা থেকে দূরে থাকেননি। তার কবিতার সহজ প্রাণময় প্রণোদনা পাঠককে বুঝিয়ে দেয় কবি-মনের অন্তর্নিহিত কথাটি। ‘বয়স্ক বালক’ কবিতাটিও সেই স্বচ্ছতার সন্ধিক্ষণে আমাদের জানিয়ে দিয়ে যায়, কবি রফিক আজাদের প্রতি তার ভালোবাসার দায়িত্ব এবং সন্তানদের প্রতি অকৃত্রিম মাতৃত্ব-বোধ যেন পাশাপাশি পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে।
শেষবার আমি সত্য উচ্চারণ করেছি
খনার কর্তিত জিহবায়
তোমরা কী আমাকে এখন চেনো আর,
অনেক আগেই আমি ছেড়ে গেছি
তোমাদের বিস্ময়-ভার…
বলা ভালো ছাড়িয়ে গেছি আমি
পরস্পরের দ্রোহের সংসার
কে পায় আমাকে আজ?
[খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান]
একজন সমাজমনস্ক কবি হিসেবে, বিশেষ করে নারীর কলমে এই পঙ্ক্তিগুলো পাঠককে ভাবায়। নারীজন্মের চিরায়ত বঞ্চনা ও তার প্রতি ধিক্কার জানাতে তিনি কলম ধরেন সাহসী হাতে।
বহু ঝড় জলোচ্ছ্বাস আর অগ্নি মাড়িয়ে
আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি একা;
সম্পূর্ণ একলা
নৈঃসঙ্গ্য ছাড়া কোনো বন্ধু ছিলো না আমার
করতলে হাত রেখে
গোপন কোনো বেদনা জানাতে পারি অকপটে
এরকম কোনো বন্ধু কখনো ছিলো না
অতিক্রান্ত এই দীর্ঘ যাত্রায়;
… … … …
আমি জানি, আমি আরো জানি
আমি জানি আমাকে ছাড়া
এই পৃথিবী এগোবে না এক পা….
আমি সেই সৃষ্টিশীল নারী;
বহু ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর অগ্নি মাড়িয়ে
আজ আমি এখানে দাঁড়িয়েছি একা—
সম্পূর্ণ এ-ক-লা……।
[আমি]
একথা স্পষ্ট যে, আর দশ কবির মতো তিনিও আমার আমিকে খুঁজে ফেরার আজন্ম তৃষ্ণায় কাতর হয়েছেন, হয়েছেন দীপ্র-দাহের প্রতীক। সৃষ্টিশীল লেখকের যাত্রা, সম্পূর্ণ একার যাত্রা। এখানে কেউ তার সঙ্গী হয় না। সেকথা তিনি জানেন। আর এই জানাটাই তার সাহিত্য অনুসন্ধানের রথযাত্রার প্ররণা হয়ে কাজ করছে।
এ-পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক গ্রন্থ। কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, গবেষণা, শিশুতোষ ও সম্পাদনাসহ প্রায় পনেরোটি। লাভ করেছেন কবিতার জন্যে লা ফর্তিনা সম্মাননা (১৯৮৩) এবং বাংলাদেশ ও নেপাল ফ্রেন্ডেশিপ সম্মাননা (২০১২)।
ঙ.
ব্যক্তিগতভাবে আমি তার নানাবিধ বিষয়ে লেখা গদ্য ও বক্তব্য পরিবেশনের একজন নিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠছি ক্রমশ। অনেকেই প্রবন্ধ লেখেন, অনেকেই কথা বলেন, কিন্তু সবার লেখা বা কথা মন ছোঁয় না। সকলের কব্জির জোড় এরকম সাবলীল হয় না, কবি ও প্রাবন্ধিক দিলারা হাফিজের কলমে যা ফুটে ওঠে। তিনি কঠিনতর বিষয়বস্তুকেও জলের মতো সহজ আন্তরিকতায় পাখা মেলে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেন। আবার এর সঙ্গে প্রয়োজনে যোগ করেন মিষ্টি ও সুস্বাদু রসবোধ। এই জায়গায় তিনি আমার অতিপ্রিয় একজন সৃষ্টিশীল গদ্যকার।
তাই কবি দিলারা হাফিজের জন্মদিনে ঐকান্তিক শুভকামনা জানাই, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, দীর্ঘজীবী হউন। শুভ জন্মদিন।
এর পেছনে একটি ছোট্ট গল্প আছে। ফেসবুকে প্রায় প্রতিদিনই পড়ছি আপার দেয়া নতুন নতুন পোস্ট। সেসব পোস্টগুলো আমাকে দারুণ আলোড়িত করছে। ভাষাটা খুব সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত। এতদিন কবিতার দিলারা হাফিজকে জানতাম, এবার নতুন করে জানতে শুরু করলাম গদ্যকার দিলারা হাফিজকে। তিনি দুহাত খুলে লিখে যাচ্ছেন। প্রায়দিন কথা হয়, আলাপ হয় সেসব নিয়ে। একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম, নিয়মিত গদ্য লেখার জন্য। বললাম, আপা আপনি সিরিয়াসলি গদ্য লিখুন, আপনার হাতে গদ্য খুব ভালো খোলে। তিনি কথা রাখলেন। আজ তাই সেকারণেই পাচ্ছি, নানা তথ্যমূলক জানা অজানা বিষয় ভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের গদ্য। কঠিন কোনো বিষয়বস্তুও তার হাতে রসময় ব্যঞ্জনা তৈরি করে অতি সাবলীলতায়। তিনি ক্রমশ ছড়িয়ে দেন এক অজানা মোহ-মাধুর্যের বিস্তার। দুহাত খুলে লিখে যাচ্ছেন প্রবন্ধ, ভ্রমণ, কবিতার আলোক-স্পর্শী দিকবলয়। যেহেতু কবির হাতের গদ্য, তাই সেখানে সবটুকু মশলার পরিমিতি সংযোজনা পাঠকের মনকে সিক্ত ও পিয়াসী করে তুলতে পারে নিমেষে।
রফিক ভাই চলে যাবার পর, তার উদ্দেশে দিলারা আপা ‘কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছেন। যেখানে দেশের অনেক গুণী ও জ্ঞানীজনেরা রয়েছেন। প্রতি বছর রফিক ভাইয়ের জন্মদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় প্রায় সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠান। দেশে থাকলে ওই দিনটিতে পৌঁছে যাই ধানমন্ডির এক নম্বর রোডের বাড়িতে। এবার ২০২০ সালে সকাল ১১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম, আপার সঙ্গে রফিক ভাইয়ের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেলাম। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে আমার মা-বাবাও শুয়ে আছেন। সেদিন আপা ও পুত্র অভিন্নের সঙ্গে একত্রে মা-আব্বার কবরও জেয়ারত করলাম। বিকেলে অসংখ্য গুণীজন সমাবেশে স্মরণ, কবিতা, বক্তব্য শুনেছি, অংশ গ্রহণ করেছি। প্রতি বছর কবি রফিক আজাদের জন্মদিন পালনের এই অপূর্ব অনুষ্ঠানটি বলতে গেলে একক প্রয়াসেই করে যাচ্ছেন কবি দিলারা হাফিজ। মাঝে মাঝে মনে হয়, রফিক ভাই দিলারা আপার আজন্মের প্রেমিক হয়েই আছেন। এই অমলিন ভালোবাসাকে আজও প্রকাশিত হয় রফিক আজাদের জন্মদিনে। সত্যি এই ভালোবাসা বিরল।
একটি কষ্ট রয়েই যাচ্ছে, কবি দিলারা হাফিজ এখন টরন্টোতে, অথচ করোনাকালীন সময়ে চারদিক প্রতিবন্ধকতায় ভরা। তাই একই শহরে বসবাস করেও, দেশ থেকে ফিরে আসার পর আজ পর্যন্ত একবারও দেখা হয়নি তার সঙ্গে। কভিড-১৯ বুঝি এভাবেই দূরে সরিয়ে রাখছে প্রিয়জনদের থেকে। তা রাখলেও শুভকামনা জানাতে তো বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না। তাই কবি দিলারা হাফিজের জন্মদিনে ঐকান্তিক শুভকামনা জানাই, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, দীর্ঘজীবী হউন। শুভ জন্মদিন।