বয়ঃসন্ধির সময় শরীর ও মনের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। তা শুধু ডাক্তার না, একজন শিক্ষিত সচেতন মানুষ মাত্রই জানে। কবিগুরু লিখেছেন, ‘বারো-র বাড়’। মানে বারোতে পা দিলে সবকিছু অন্যরকম।
হরমোনাল পরিবর্তন, শারীরিক পরিবর্তন তার মনোজগৎও পরিবর্তন করে। শরীর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মনোজগতে সবকিছু অস্থির, অন্যরকম, অচেনা, অস্বস্তিকর লাগে। সে নিজেও বুঝতে পারে না, তাই এতে অভ্যস্তও হতে পারে না। অনেক অজানা জিজ্ঞাসা তার মনে আসে, যার উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। সে হয়ে ওঠে আবেগপ্রবণ। শরীর এত দ্রুত বদলাতে থাকে যে, তাল সামলানো কঠিন হয়। প্রায়ই পারা যায় না। এ সময় ভালোবাসা, স্নেহ, ঘৃণা, রাগ, ভয় ও দুশ্চিন্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে। এসব আবেগ কখনো কখনো সংঘাতে রূপ নেয়।
পদশৃঙ্খল এই সময় থেকেই হওয়ার আশঙ্কা শুরু। তাই গোড়াতেই আগাছামুক্ত, কীটমুক্ত করে ফসলের মতো সন্তানকে বিশেষ যত্ন করতে হবে। এ নিয়ে সংকোচ বা গোপনীয়তা তার ভিন্ন উপায়ে কুশিক্ষা বা অশিক্ষা লাভের পথই খুলে দেয়। স্কুলে এসব শিক্ষা অনেক দেশে চালু হলেও আমাদের পরিবারে বা স্কুলে, কোথাও শিক্ষা নেই। এ সময়ে নারী-পুরুষের প্রতি সহজাত আকর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আবেগ ও এর নিয়ন্ত্রণ শেখানো খুব দরকার।
এ সময় রাস্তায় মেয়েদের তো ভালো লাগে। এটা হলো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। কিন্তু মেয়েদের তো শ্রদ্ধাও করতে হবে। জানা থাকতে হবে মেয়ে বন্ধু, ছেলে বন্ধু; সব মানুষকে প্রথমে শ্রদ্ধা করতে হবে। সুন্দর মেয়ে দেখলেই প্রেম করে বন্ধুদের দেখিয়ে দেবে, এর মতো মূর্খতা আর কিছুই যে নেই, এটা নিজেকেই নিজে বোকা বানানো ছাড়া কিছুই নয়।
এ সময় সাধারণতে লুকিয়ে চুরি করে নিষিদ্ধ কিছু দেখে বিকৃত ধারণা লাভ করে। ফ্যান্টাসি করতে গিয়ে, বাহাদুরি করতে গিয়ে বিপদে পড়ে। ছেলেরা অনেক বেশি করে। মেয়েরা কম। তাই এই সময়ে দরকার সঠিক বিষয়ে জানা। যেন নিজেও ভুল না করে বসে বা অন্য কারও ভুল থামাতে পারে। আবার না বুঝেই কারও ভুলের শিকার না হয়ে বসে। এই অতি স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরাও করে থাকে। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক আর প্রাপ্তমনস্কে অনেক ফারাক।
আমাদের দেশের শিশুদের কথাগুলো বাবা-মায়েরা ঠিকমতো মনোযোগ দিয়ে শোনে না। অনেক মা আছেন, ঘরে বসে থাকলেও বাচ্চাদের সঙ্গে স্কুলে যান না। প্রাইভেটে যান না। কোনো খোঁজ খবরও নেন না।
শুধু পড়াশোনাই জীবন নয়, এর বাইরেও তাদের অনেক বড় জীবন আছে। নানা দিকে তাদের পদচারণা আছে। ভুল আছে, শুদ্ধ আছে, যার প্রভাব তাদের পড়াশোনা আর ভবিষ্যৎ জীবনের ওপর পড়তে পারে। এ সময়ে ছেলেমেয়েরা নানা রকম সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। কোনো কোনো সময় পরিবারের সদস্যদের বকা ও নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। হঠাৎ করে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মা-বাবার আদেশ-উপদেশকেও অনেক সময় গ্রাহ্য করতে চায় না। ফ্যাশন সচেতন হয়ে ওঠে। আবার হঠাৎ করে রেগে যায়।
কারণ পরিবার থেকেই ভালো-মন্দের তফাৎ বা নৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক ধারণা পেয়ে থাকি আমরা। তাই ছোট সময় থেকেই ছেলে-মেয়েকে নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে।
এই বয়সটাতে ছেলে-মেয়েরা বাবা-মায়ের চাইতে বন্ধু-বান্ধবদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। অনেকেই বাবা-মায়ের বাধা মেনে নিতে পারে না। এ বিষয়গুলো বাবা-মায়ের পক্ষেও মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু বাবা-মায়ের ধৈর্য হারালে চলবে না। সন্তানের আচরণের প্রতিও সম্মান দেখাতে হবে।
আমাদের দেশে কোনো বিষয়ে মায়ের ব্যক্তিগত পছন্দ স্বাধীনতা নেই। মায়েরা সবসময়ই নানান বিপন্নতায় ভোগেন। বলার স্বাধীনতা নেই। তারা চাকরি ও সংসারের কাজের মধ্যে সুন্দর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলেও নিজেরা তত সুখী নন। এর প্রভাব প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সন্তানের মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত সৃষ্টি করে। আবার সন্তানের দেখাশোনা করার ক্ষেত্রে বাবার ভূমিকা এখানে নগণ্য। বাবাদেরও যে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো দরকার, তা একেবারেই দেখা যায় না। এটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, সুখী বাবা-মা মানেই সুখী বাচ্চাকাচ্চা।
বয়ঃসন্ধিতে থাকা ছেলে-মেয়েরা ভীষণ কৌতূহলপ্রবণ হওয়ায় অনেক সময় তাদের বিপথগামী হওয়ার, মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়া, অযাচিত ঝুঁকি নেওয়া বা অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বয়ঃসন্ধির সময়ে করণীয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করতে হবে। আমাদের আগামী প্রজন্ম যেভাবে অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে, তাদের আলোর মুখ দেখাতেই হবে। এই ব্যাপারে পরিবারের পর বিদ্যালয় সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ শিক্ষার্থীরা দিনের অনেকটা সময় বিদ্যালয়েই কাটায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ বছর এবং ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়টাকে কৈশোর বলে। এর যেকোনো সময়ে বয়ঃসন্ধিকাল আসতে পারে। এটা মূলত কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী পর্যায়।
অনেক সময় ১৯ বছর পরও বয়ঃসন্ধি মর্যাদা ব্যাপ্তি থাকতে পারে। যা বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনের ওপর নির্ভর করে।
মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেদের চেয়ে কিছুটা আগে শুরু হয়। মূলত ১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে যেকোনো সময় তা হতে পারে। অন্যদিকে, ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকাল আসে ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে। বয়ঃসন্ধির এই সময়টা ছেলে-মেয়ে উভয়ের প্রজননক্ষমতা বিকাশ হতে থাকে বলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ হয়।
অস্থির সময় পার করছি আমরা। আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র পরিবার থেকেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পুত্র সন্তানদের বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষা দিতে হবে। একটি সন্তান যে পারিবারিক আবহে বড় হয়, তার প্রভাব পড়ে তার চরিত্রে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে প্রতিটি পরিবার। কারণ পরিবার থেকেই ভালো-মন্দের তফাৎ বা নৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক ধারণা পেয়ে থাকি আমরা। তাই ছোট সময় থেকেই ছেলে-মেয়েকে নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে।