শোষণ (শুষে নেওয়া) শব্দটার অস্তিত্ব সর্ববিস্তারী। কোনো কিছু থেকে গ্রহণযোগ্য উপাত্ত নিঙ্ড়ানোই হলো শোষণ। এই শোষণ প্রক্রিয়ায় কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে তার থেকে যেটুকু ব্যবহারযোগ্য উপাত্ত আছে, তা জোঁকের মতো শুষে নিয়ে অন্যপক্ষ ভুক্তভোগী ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে ক্রমাগত নিঃশেষ করে দেয় স্বর্ণলতার মতো।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত শব্দগুলোর মধ্যে এই শোষণ শব্দটি অবিনশ্বর বলা চলে। কারণ এই প্রক্রিয়ার কোনো শেষ নেই। সৃষ্টির শুরু থেকে এই প্রক্রিয়াটি ক্রিয়াশীল। এটি রূপ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ কুমিরের মতো নিজের আয়ু বাড়ায়। এ শব্দটির ক্ষেত্রে মজার ব্যাপার এই, যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যের শোষণের শিকার হয়, সে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীও কোনো-না কোনোভাবে অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে শোষণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কোনো শোষণ বাহ্যিকভাবে শোষণের তকমা পায় আর কোনোটা চির স্বাভাবিক অবয়ব নিয়ে জিহ্বা বিষাক্ত করে চলে নির্বিঘ্নে। সেই অনুযায়ী কোনো শোষণের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধ বাদ হয় আর কোনোটির বিরুদ্ধে হয় না। মোটের ওপর বলা চলে আমরা সবাই কোনো-না কোনো শোষণ চক্রের মধ্যে দিয়ে আবর্তিত হই, কারও দ্বারা শোষিত হই এবং কাউকে শোষণ করি।পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র; সর্বোপরি গোটা বিশ্বে কোনো ব্যক্তিই এই চক্রের বাইরের নয়।
অপাজেয় এই শোষণ প্রক্রিয়া স্থান, কাল, পাত্র, পরিস্থিতি প্রেক্ষাপট ইত্যাদি ভেদে নিজের রূপ বদল করে, সেই অর্থে গিরগিটির মতো এটি নিজের রূপ পরিগ্রহ করে বলা যায়। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি জীবন বা গোষ্ঠী জীবন হাত বদলের মতো শোষকচক্রের হাতে হাতে আজীবন ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ এক শোষকের এক রকম শোষণের হাত থেকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্য শোষকের ভিন্ন শোষণের কবলে পর্যবসিত হয়।
রাষ্ট্রীয়ভাবে দুই শত বছর বাঙালি জাতি ঔপনিবেশিক শোষণের কবলে পর্যবসিত ছিল। সেই শোষণ প্রক্রিয়া সবার কাছে দৃশ্যমান ছিল। আর তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শোষণ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসার প্রচেষ্টা দানা বাঁধার সুযোগ পেয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, ব্রিটিশরা অন্য জাতি বলে ভারতীয়দের ওপর শোষণ করছে। ভারতীয়রা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেলেই শোষণ প্রক্রিয়া থেকে থেকে মুক্ত হতে পারবে। এই ধারণা যে ভুল, তা প্রমাণিত হতে দেরি হয়নি খুব একটা। এরপর ভাবা হলো, ভারতবর্ষে সংখ্যাঘরিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলমানদের শোষণ করছে। কেননা মুসলমান সংখ্যায় কম ছিল। তাই মুসলমানদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য হলো ভারতভাগ। কিন্তু মুসলমানরা যে নিজ ধর্মের লোকের কাছে নিরাপদ, সেই ধারণাও ভুল প্রমাণিত হলো। রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তিতে তারপর ভাবা হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা নিশ্চত হলে সবাই স্বাধীন হবে। হলোও বাংলা ভূমি স্বাধীন। কিন্তু তারপর শোষণ প্রক্রিয়া ধারণ করলো অন্যান্য রূপ। রাষ্ট্রীয়ভাবে সে রূপ ব্যক্তির অবস্থান ভেদে বিভিন্ন। লাল নীল কমলা আবার বেগুনি। সেই থেকে এই পর্যন্ত চলছে শোষণের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র অবলম্বন করে করা কূটকৌশলী রূপের খেমটা নাচ। এটি জোর দিয়ে বলা যায় এই জন্য যে, একজনের শাসন অন্য জনের কাছে শোষণ।
কখনো দুঃখী নায়ক আর কখনো ভিলেন। কারো জন্য নায়িকা আবার কারো ক্ষেত্রে অভিনেত্রী। পটভেদে আবার দর্শক, সময়ভেদে দর্শনার্থী
এবার আসা যাক ব্যক্তিগত শোষণের কিছু তৈলচিত্রের রঙের ব্যবহার সম্পর্কিত আলোচনায়। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে দাসপ্রথা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত একটা ব্যবস্থা। যেখানে মানুষই মানুষকে ক্রয় করে গোলামে পরিণত করতো। এটি অবশ্য কোথাও কোথাও রাজনৈতিকভাবেও প্রচলিত ছিল। তবে এখনকার কথা একটু ভিন্ন বিষয়ক। দাস তো তাও কৃত, কিন্তু অবিকৃত আমাদের প্রত্যকেরই যে দাসবৃত্তি করার ও করানোর বিষয়ে অভিজ্ঞতা অনেক সেটা তো জানা কথা। যারা জানেন তারা তো প্রত্যক্ষদর্শী। আর যারা জানেন না তারাও প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এই শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা কেউ জেনে আর কেউ অসচেতনভাবে প্রবেশাধিকার পাওয়ার আগেই কখন কিভাবে জড়িয়ে পড়ি, তা আমরাই জানি না। মূলত আমরা শোষিত হয়ে সেই শোষণজনিত গ্লানিটুকু অন্য কিছু বা অন্য কারও ওপর প্রবাহিত করতে চাই। এটি সম্পূর্ণ অবচেতন মনের চেতন কমকাণ্ডের অংশ। এই প্রক্রিয়ায় মানুষ নির্বিচারে মানুষকে শোষণ করে যাচ্ছে কখনো ন্যায্য পাওনা না দিয়ে, সম্মান ও স্বীকৃতি না দিয়ে, অধিকার ও অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়ে। এভাবে মনের অজান্তে অথবা খুব সচেতন ভাবে অধীনস্তের নিরুপায় হওয়ার সুযোগ দিয়ে সকল ভাবে আমরা আমাদের অধীনস্থের সৌন্দর্য, সম্ভাবনাকে হত্যা করি। গরিবকে চমৎকার কূট-কৌশলে গরিব বানিয়ে রাখি যেন আমরা মধ্যবিত্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারি। আবার মধ্যবিত্ত হয়ে পড়ে থাকি উচ্চবিত্ত একই কূট কৌশলের শিকার হয়ে। সবই জানি, কিছুই মানি না।
এরপর বলা যাক অর্থনৈতিক শোষণ ব্যবস্থার কথা, যার স্বরূপ সবারই চেনা। তাই পরিচিত প্রসঙ্গে না গিয়ে চলে যাচ্ছি সেই গৃহকর্তীর প্রসঙ্গে যে কিনা স্বামীর পরিশ্রমের তুলনায় স্বল্প পারিশ্রমিক পাওয়ায় মর্মাহত, পুঁজিবাদী অসম বাজার ব্যবস্থা যার সংসারকে ক্রমশই সংকীর্ণ করে দিচ্ছে। তার বিষয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো এই যে, তিনি শোষণ চক্রের একদিকে শোষিত হয়ে ক্রন্দনরত, আরেক দিকে শোষকের রূপে তারই গৃহকর্মীর জীবনে সংকট তৈরি করে চলেছেন অনবরত। যে শোষণ প্রক্রিয়া’র বিরুদ্ধে তার আমরণ অনশণ, তিনি নিজেই সেই একই অপরাধে কাঠগড়ার আসামি হিসেবে দণ্ডায়মান অন্য কারও চোখে। দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, নিম্নবর্গের শোষণের কান্না চোখের দরবারে আসার আগেই ধুলো এসে চোখ ডলে যায়। ঝাপসা ঠেকে সবকিছু। বাকিটা সবারই জানা।
এবার যদি আসি নারী-পুরুষ কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ বিষয়ক আলোচনায়, তবে এখানে শোষণের রূপ সময় বদলের অপেক্ষায় ঝিমুনি খায়। যে প্রান্তিক পুরুষ ভদ্রলোকের শিক্ষার গরমে উতপ্ত বাক্য ব্যয়ে লাঞ্ছিত ও অপমানিত তারও জায়গা আছে শোষকের রাজ্যে রাজা হবার, যেখানে রাজ্য জুড়ে জড়োসড়ো স্ত্রী-সন্তান তার রাত দুপুরের গোলাম। এই কারণে সে রাজ্যের দাসীর কথা ভেবে দুঃখ পাওয়ার তেমন কিছুই নেই। কেননা তার ঘটে সময়ের ফেরে তার পুত্রবধূ রয়েছে, আর পূত্রবধূর ঘটে পীড়িত বিধবা ননদিনী। আর ননদিনীর মুখে রয়েছে বিষবাক্য তার প্রতিবেশী অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়েটার জন্য, স্বামীর সাথে যার কেবলি নির্লজ্জপনা। সুতরাং এরা কেউই খুব একটা বেচারী নয়। কোনো না কোনো ভাবে শোষণচক্রের কর্ণধার সে হবেই, আগে বা পরে,কথায় বা কাজে। আর তৃতীয়লিঙ্গ তো যে বিষে গলা জ্বলে সে বিষই নিঃশ্বাসে নির্গমন করে ত্রাসের বসতি স্থাপন করে এ যাত্রায় পার হতে চায় ঘৃনায়, অপমানে আর অগ্রহণযোগ্যতায়।
সময়, অবস্থান, পরিস্থিতিভেদে এখানে সবাই একই নাটকের নট-নটী। কখনো দুঃখী নায়ক আর কখনো ভিলেন। কারো জন্য নায়িকা আবার কারো ক্ষেত্রে অভিনেত্রী। পটভেদে আবার দর্শক, সময়ভেদে দর্শনার্থী। শোষণ চক্রে এখানে সবাই শিকার, সবাই শিকারি।
আরও পড়ুন: সময়ের অভিরুচি ॥ শারমিন সুলতানা তন্বী