শিশু সাহিত্যের অন্য যেকোনো শাখার তুলনায় ছড়া সাহিত্য খুব সংবেদনশীল এবং তাৎক্ষণিক অনুভূতিতে ঢেউ তুলতে সক্ষম। শিশুতোষ ছড়ার মূল প্রাণ আপাতত অর্থহীন শব্দের ব্যঞ্জনা। যে বিষয় শিশু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বুঝবে না, আকারে-ইঙ্গিতেও বোঝানো সহজ নয়; সে বিষয়ও শিশু অনুপ্রাসের মর্মে গেঁথে নিতে পারে খুব সহজে। এর জন্য অভিভাবক কি শিক্ষককে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে হয় না। অল্প কথায় শিশুমনের আবেগ অনুভূতি, বিশ্বচরাচরের নানা সংলগ্ন ও অসংলগ্ন বিষয়ে শিশুমনে যে প্রশ্ন সতত জাগরুক, তার উত্তর আপাতত সচেতন অভিভাবক মহলে থাকে না। শিশুমনের যে আকাঙ্ক্ষা, তার পরিতৃপ্তি অভিভাবকমহল হয়তো বস্তুগত কোনো বিষয়ের সাহায্যে দিতে চান; কিন্তু সে বস্তুগত বিষয় উত্তর এনে দেওয়ার পরিবর্তে শিশুমনকে বিষিয়ে তুলতে পারে। কারণ শিশুর মানসিক পরিচর্যাকারীকে অবশ্যই শিশুর মনস্তত্ত্ব বুঝতে সমর্থ হতে হবে। ব্যত্যয়ে মহাসমুদ্রের তলদেশ থেকে হয়তো সুই খুঁজে তুলে আনা সম্ভব, কিন্তু শিশুমনের নাগাল পাওয়া সুদূর পরাহত। শিশুমনের কৌতূহল মেটানোর জন্য চাই তার মনোলোভা শব্দচয়নে আকাঙ্ক্ষার বিষয়কে ফুটিয়ে তোলা। আর তা অনেকটা সম্ভব শিশুতোষ ছড়ার আশ্রয়ে।
বাংলা সাহিত্যে শিশুতোষ ছড়ার প্রসঙ্গ এলেই যে নামটি সবার আগে পাঠকমনে ভেসে ওঠে, সে নাম সম্ভবত সুকুমার রায়। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, বন্দেআলী মিয়া, রোকুনুজ্জামান দাদা ভাই, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সুকুমার বড়ুয়ার নাম স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয়। সুকুমার রায় থেকে শুরু করে আজকের তরুণতর ছড়াকারও শিশুতোষ ছড়া রচনার ক্ষেত্রে শিশুর মনস্তত্ত্বিক দিকটি সবার আগে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেন। শিশুমনের বাসনা উপলব্ধি করে, তাকে শিশুর মনতোষময় ভাষা-শৈলীতে উপস্থাপন করা ছড়াকারের মৌল দায়। সে দায় পুরণে ছড়াকার কতটা প্রতীজ্ঞাবদ্ধ, তাও বিবেচনার বিষয়। শিশুতোষ ছড়ার একটি বৈশিষ্ট্য—সেখানে উদ্ভট ও যুক্তিহীন বিষয়ের অবতারণা করা এবং সে অযৌক্তিক বিষয়কে নানা রঙে রঞ্জিত করে শিশু মনে আলোড়ন তোলাই ছিল বাংলা ছড়ার প্রাথমিক রূপকারদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। আজও তা প্রবহমান।
শিশুর মন না বোঝা গেলে তার মনোলোভা শব্দচয়ন সব সময় সম্ভব হয় না। শিশুতোষ ছড়া ও পদ্যের ক্ষেত্রে সুকুমার রায় বিষয় নির্বাচনে খামখেয়ালিপনাকে যতটা আন্তরিকতার সঙ্গে অঙ্গীভূত করেছেন, ততটা বস্তসত্যকে গুরুত্ব দেননি। তৎকালীন মানবসমাজে বিজ্ঞানের অগ্রগতির চরম প্রভাব না পড়ায় সে সময়ের শিশুমন রূপকথার অযৌক্তি ও উদ্ভট বিষয়কেই নিজেদের কল্পজগতের বিষয় বলে ধরে নিত। ফলে সে সময়ের ছড়াও মানব জীবনের নানা অসঙ্গতি মানবায়নের চেয়ে স্বপ্নায়ণের দিকে বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুমনের নানা প্রশ্নকে উপজীব্য করে বস্তুসত্য ও কল্পজগতের সমন্বয়ে সমন্বয়বাদী চেতনার আলোকে ‘ছুটি’, ‘আমাদের ছোটনদী’, ‘মাঝী’, ‘বীরপুরুষ’, ‘আষাঢ়’সহ সংখ্যাধিক ছড়া ও কিশোর কবিতায় শিশুমনের অলিগলি ঘুরে ফিরে দেখেছেন। এসব ছড়া-কবিতা-পদ্যে বিধি ও রীতির শৃঙ্খল থেকে সাময়িক মুক্তির আনন্দে হৃদয়ের উদ্বেল তরঙ্গমালাকে একটি চাঞ্চল্যের অমোঘ বন্ধনে নিবন্ধন করার লক্ষ্যে নিসর্গ থেকে শিশুর মনস্তত্ত্ব পর্যন্ত বিচরণ করেছেন।
মদনমোহন তর্কালঙ্কার একজন নীতিবাদী সাহিত্যিক। ফলে তার শিশুতোষ রচনায়ও তার নীতিবাদী প্রভাব পড়েছে। তার বিখ্যাত পদ্য ‘আমার পণ’। এপদ্যে তিনি একটি আদর্শ শিশুর প্রভাত থেকে সারাদিনের কর্মযজ্ঞের ভেতর সুস্থ ও রুচিশীল একটি পরিবেশের পক্ষে সংকল্পের কথা বুনন করেছেন।
শিশু সাহিত্যে যার অবদান প্রবাদতুল্য তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তার ‘আমি হব,’ ‘রণ সঙ্গীত’, ‘মা’, ‘সংকল্প’ ছড়া ও শিশুতোষ পদ্য এবং সঙ্গীত কেবল শিশুমনকে আন্দোলিত করে যে, তা নয়, সঙ্গে বড়দেরও বিমোহিত করে। ‘আমি হব’ ছড়ার যে পণ, তা একটি শিশুর বেড়ে ওঠার পথে অমূল্য পাথেয়। রণসঙ্গীতের যেঅংশটুকু শিশুমনকে আলোড়িত সে অংশটুকুতে শিশুমনে উদ্দীপনা জাগানোর পক্ষে মহৌষধ। ‘মা’ পদ্যে চিরকালীন মায়ের ছবি আঁকা হয়েছে। সন্তানের সুখে-দুখে মা-ই শেষ এবং একমাত্র আশ্রয়স্থল সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংকল্প শিশুমনের দুর্মর আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবতার সঙ্গে স্বপ্নের সমন্বয় ঘটিয়ে একটি অভিযাত্রীর তীব্র মনোবাসনাকে শৈল্পিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কবি।
জসীমউদ্দীন পল্লীকবি বলে খ্যাত হলেও শিশুমনকে পল্লীবাসীর চোখ দিয়ে বিচার করেননি। পরিপূর্ণ মানবমনের পরিচর্য পাওয়া যায় তার শিশুতোষ ছড়া-কবিতায়। ‘সবার সুখে’, ‘রাখাল ছেলে’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘এত হাসি কোথায় পেলে’ প্রভৃতি ছড়া ও পদ্যে শিশুমনের আবেগ অনুভূতিকে ব্যক্তিবিশেষের আবেগ অনুভূতির সীমা ছাড়িয়ে নৈর্ব্যক্তিক আবেগ ও অনুভূতিতে রূপান্তরিত করেছেন। ‘সবার সুখে’ ছড়ায় যেমন সাম্যবাদের কথা বলেছেন, ‘রাখাল ছেলে’ পদ্যে যেমন আবহমান গ্রাম বাঙলার নিসর্গরাজিকে ফুটিয়ে তুলেছেন, ‘নিমন্ত্রণ’ পদ্যে যেমন হৃদয়ের ঔদায্যের পরিচয় বিধৃত করেছেন, তেমনি ‘এত হাসি কোথায় পেলে’ ছড়ায় শিশুমনের জিজ্ঞাসার সঙ্গে প্রকৃতির প্রশ্নশীল আচরণকেও একাত্ম করে দেখেছেন।
আহসান হাবীব মূলত কবি। কিন্তু ছড়া ও শিশুতোষ কবিতায়ও সিদ্ধহস্ত। ‘ছড়া’, ‘স্বদেশ’, ‘রূপকথা’, ‘জোনাকিরা’ তার সুখ্যাত ছড়া ও শিশুতোষ কবিতা ও পদ্য। ‘ছড়া’ নামক ছড়াটি ছয়মাত্রিক, দুইপর্বের অন্ত্যমিল যুক্ত। এটি ছড়া হলেও ছড়ার একরৈখিক চেতনাকে ছাড়িয়ে বহুরৈখিক বিষয়ের সন্নিবেশ এখানে ঘটেছে। স্বদেশ মূলত বাংলাদেশের নৈসর্গিক দৃশ্যরাজির চিত্রায়ণ। জোনাকিরা শিশুমনের অদম্য কৌতুহল ও প্রশ্নের একটি মনস্তাত্ত্বিক পটভূমি ঋদ্ধ ক্যানভাস। এ ছড়ায় আহসান হাবীব শিশুমনের অলিতে গলিতে ঘুরেফিরে শিশুমনের নানা খোঁজখবরকে তুলে এনেছেন জোনাকিরা আলোর প্রতীকে।
শিশু মনের আবেগকে ভিত্তি করে লেখা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এর ‘কে’, সুনির্মল বসুর ‘সব পেয়েছির দেশে’, ‘সবার আমি ছাত্র’, কুসুম কুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’, অতুল প্রসাদ সেনের ‘বাংলা ভাষা’, রজনী কান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কায়কোবাদের ‘বঙ্গভূমি’ ও ‘বঙ্গভাষা’, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ‘কাজলা-দিদি’, গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’, কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘পারিব না’, কাজী কাদের নেওয়াজ এর ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’, ফজলুল করিম-এর ‘তুলনা’, বন্দে আলী মিয়ার ‘আমাদের গ্রাম’, ‘পাখি’, সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের ‘কোন দেশে’, ‘পাল্কীর গান’, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘কাজের লোক’, ফজলুর রহমানের ‘গ্রীষ্মের দুপুরে’, সৈয়দ আলী আহসানের ‘দেশের জন্য’, ফররুখ আহমদ-এর ‘বৃষ্টির ছড়া’, সুফিয়া কামালের ‘প্রার্থনা’, ‘হেমন্ত’, শামসুর রাহমানের ‘ট্রেন’, ‘সাইক্লোন’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমাদের এই বাংলাদেশ’, আল মাহমুদ-এর ‘ভর দুপুরে’, রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণীর ‘চাষী’, সানাউল হকের ‘মুক্তির ছড়া’, আসাদ চৌধুরীর ‘জানাজানি’, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর ‘হবে তবু শিখতে’, সুকুমার বড়–য়ার ‘মুক্তিসেনা’, প্রভৃতি ছড়া ও পদ্যের বিষয়বস্তু ও ছন্দের কারুকার্য শিশুকিশোর নয় কেবল, বয়স্কদেরও আনন্দ দানের পাশাপাশি হিতোপদেশ কিংবা বিধি নিষেধের সাধারণ জ্ঞান দানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এসব ছড়া ও পদ্যে দেশের নৈসর্গিক দৃশ্যরাজি যেমন বর্ণনা করা হয়েছে, তেমনি বর্ণনা করা হয়েছে শিশুমনের নানা প্রশ্নের সব বিচিত্র উত্তর ও সম্পূরক ও পরিপুরক প্রশ্নের। শিশুর চরিত্রগঠনে এসব ছড়া পদ্যের ভূমিকা অপরিসীম। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনার সময়, স্বদেশের প্রকৃতি, স্বাধীনতা, জ্ঞানার্জনে ক্ষেত্রে চরাচরের নানা বিষয় ও অনুষঙ্গে অবদান এসব ছড়া ও পদ্যে সাবলিলভাবে প্রকাশিত হওয়ায় এসব ছড়া শিশুমনকে খুব সহজে আলোড়িত করে। এসব ছড়া ও শিশুতোষ পদ্যের শব্দে শব্দে শিশুর মনের অলি-গলি চেনা যায়। ফলে শিশু এসব ছড়া পাঠান্তে নিজের মনের ভেতর যে প্রশ্নশীল জগৎ থাকে, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার সুযোগ পায়।