আজ বিশ্ব দর্শন দিবস। ২০০৫ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে প্রতিবছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার ‘বিশ্ব দর্শন দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১৬ নভেম্বর ‘বিশ্ব দর্শন দিবস’ পালিত হচ্ছে। তাই দর্শন নিয়ে নিজের ভাবনা জানাতে ইচ্ছে হলো।
দর্শন সম্পর্কে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমার কোনো ধারণা ছিল না। যা ছিল, তা পুরোটাই নেতিবাচক। সবাই বলতো, দর্শন বিষয় ভালো না। তাদের সঙ্গে আমিও মনে করতাম ভালো না। অনেকের ধারণা ছিল, দর্শন যারা পড়ে; তারা সবাই নাস্তিক। ধারণাটি এখনো গ্রামাঞ্চলে রয়েছে। এটা থেকে যাবে, পরিবর্তন করা খুব কঠিন। আর এমন ধারণার কারণে মিথ্যা বলেও একবার সম্মান রক্ষা করা গিয়েছিল।
একটি ঘটনা বলছি, আমার একবন্ধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলো। পরীক্ষায় তার ফল শূন্য। সে খুব চিন্তায় পড়ে যায়। মন খারাপ করে। কারণ এলাকার সবাই তাকে ভালো ছাত্র হিসেবেই জানতো। এখন কেউ যদি শুনতে পায় যে, সে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, তাহলে মান-সম্মান শেষ। কী করবে? কিছুই বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ করে তার মাথায় বুদ্ধি চলে এলো।সে ভাবলো, সবাই জিজ্ঞেস করলে বলবে দর্শনে চান্স পেয়েছে। কিন্তু ভর্তি হবে না। এটা বলার কারণ হচ্ছে-সবাই জানে, এ বিষয় পড়লে কেউ ভালো মানুষ হতে পারে না। নাস্তিক হয়ে যায়। অবশেষে সবাই তার কথাটি বিশ্বাস করলো এবং তাকে সবাই বাহ্বা দিতে লাগলো। ফলে তার সম্মান রক্ষা হলো।
আমি তখনও জানতাম না যে, দর্শন বিষয়ে আমাকেও অনার্স পড়তে হবে। যখন আমার ভর্তি পরীক্ষার সময় হলো, তখন আমিও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে শুরু করলাম। প্রথম বছর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলাম না। কারণ ভর্তি পরীক্ষাতেই ফেল করে বসি।
তার পরের বছর আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া শুরু করলাম। সে বছরও প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই অকৃতকার্য ফল আসতে থাকলো।শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস করলাম। মৌখিক পরীক্ষায় গিয়ে ‘দর্শন’বিষয় পেলাম। তখন আমার হাতে আর কোনো সুযোগ নেই। এই সুযোগ না থাকার কারণে বাধ্য হয়ে দর্শনে ভর্তি হই।
সবাইকে যখন বলতে শুরু করলাম, দর্শনে অনার্স করি। অনেকেই তা ভালোভাবে নেয়নি। একবার গ্রামের এক চাচা জিজ্ঞাসা করলেন, কোন বিষয়ে অনার্স করি। বললাম দর্শনের কথা। তিনি মুখটাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন। বললেন, সব শেষে ‘নাস্তিক’ হয়ে গেছো?
সেদিন অনেক কথাই শুনতে হয়েছিল। আমি শুধু তাকে সম্মান করে বলেছিলাম, আমরা যে বিষয় সম্পর্কে নিজেরা ভালোভাবে জানি না; সে বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা কতটা যৌক্তিক? সেদিন তার সঙ্গে আর কোনো কথা হলো না। তারপর থেকে কেউ জিজ্ঞেস করলে বাংলায় আর দর্শন বলতাম না, ইংরেজিতে ফিলোসফি বলতাম। কারণ তারা দর্শন বিষয় সম্পর্কে জানে কিন্তু ফিলোসফি বিষয় সম্পর্কে জানেন না। তাই তারা ফিলোসফি বিষয়ের কথা শুনলে খুশি হতেন।
কথাগুলো বলার কারণ হলো, আমি দর্শনের প্রথম ক্লাসেই দর্শনের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম এবং প্রথম ক্লাস থেকে দর্শন বিষয়টি ভালো লাগতে শুরু করে। এমনকি এখন পর্যন্ত যতটুকু জানতে পেরেছি; সেটা আমার জন্য অনেক। দর্শন আমাকে চিন্তা করতে শিখিয়েছে। ন্যায়-নীতি বোধ জাগ্রত করেছে। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে শিখিয়েছে। নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছে। তাই আজ আমি দর্শনের ছাত্র বলেই গর্ববোধ করি। দর্শন আমাকে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করে। তাই কোন কাজ করার আগে আমি চিন্তা করি, যে কাজটি করছি; সেটি করা ঠিক হচ্ছে কি না?
দর্শন মানবতার কথা বলে, আমাদের মানবতাবাদী হিসেবে গড়ে তোলে। আমাদের প্রত্যেকের আলাদা দর্শন রয়েছে। যেই আমি একদিন দর্শনকে ভালো বলিনি; সেই আমি এখন দর্শনের প্রেমিক। দর্শনের গুরুত্বের কারণেই ইউনেস্কো ২০০৫ সাল থেকে দিবসটি পালন করে আসছে। এ বছরও আজ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। তাই আমি বলব, দর্শন হোক মানুষের মূল চিন্তা-চেতনা।