কবিতার জন্য ভ্রমণ যে অত্যন্ত জরুরি, তা দুনিয়ার বড় বড় কবি সমালোচকই বলেছেন—স্বীকার করেছেন। ভ্রমণের মধ্য দিয়ে কবিরা আসলে পৌঁছে যান তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রতীক ও চিত্রকল্পের কাছে। এমনকি অনেক ঔপন্যাসিকও ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তারপর লিখেছেন তাদের অসামান্য গল্পগুলো।
কবি শামীম হোসেনের প্রথম কাব্য ‘বরেন্দ্র প্রান্তরে বসন্ত নামে’ (২০০৭) পড়তে গিয়ে মনে হয় এই তো কবিতা—প্রকৃতির পাঠ। ফুল-পাখি-নদী-বৃক্ষ-লতা-কালোমানুষ এসবই তো কবিতার চিরন্তন উপাদান। শেকড়ের প্রতি, উৎসভূমির প্রতি আকর্ষণ অবশ্যই শাশ্বত। নগরীর ঘরে বসেও কবিতা হয়—নাগরিক কবিতা, দার্শনিক কবিতা, অধ্যাত্ববাদী কবিতা, রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ধরনের কবিতা, বিজ্ঞানভিত্তিক কবিতা, মিথ ও ইতিহাসপ্রবণ কবিতা যখন বহু বচনের, কিন্তু তা যেন কাঠ পাথরের কবিতা, লোহালক্কড়ের কবিতা— নিরেট শুষ্ক, সময়ের চাহিদা ফুরিয়ে গেলে তার আবেদনও কিছুটা কমে যায়। আবেদন কমে না শুধু লাউলতার কবিতার— নদী ও নারীর কবিতার, কলমিলতার পদাবলির মৃত্যু নেই। আবহমানকাল ধরে মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছে প্রকৃতির রূপ। জীবনানন্দ অনেক কঠিন থিম অফ কনসাসনেসের কবিতা লিখেছেন, চিন্তার কবিতা লিখেছেন, কিন্তু মৃত্যুর পরে প্রকাশিত সহজ করে লেখা প্রকৃতির কবিতা— রূপসী বাংলা’র জন্যই খ্যাত হয়ে আছেন। এ কালেও সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সটোমার, ফরাসী কবি জ্যাঁ ওরিয়ে প্রমুখ প্রকৃতির কাব্য লিখে জগৎজোড়া পরিচিত পেয়েছেন। শামীমের কবিতায় অবশ্য নগরও আছে, তবে মুখ্য হয়ে উঠেছে বরেন্দ্র প্রকৃতি। তার কিছু উজ্জ্বল পঙ্ক্তির পাঠ নেয়া যাক—
১.
যাবেই যদি তবে কেন দিলে শস্যমাঠ
যাবেই যদি তবে কেন দিলে শ্যামল প্রান্তর
২.
আমরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে
ছাতার ব্যবহার শিখেছি’
৩.
থোক থোক শব্দে ভয়ে ভয়ে
দূর থেকে বিজলী আলোতে
ঠিক যেন সাপ মনে হলো
টর্চের আলোয় গুটি গুটি পায়ে
কাছে গিয়ে চিৎকার দিলো—
গড়ই… গড়ই।
৪.
এমন ছায়া ছায়া দিনে
বৃক্ষদের হাইওয়ে ধরে
মনোট্রেন কোন দিকে যায়
শামীমের এই মনোট্রেন— কয়েকটি কবিতাতেই যার ব্যবহার দেখা যায়, এ ভারী চিত্তাকর্ষক। আর শামীমের কাব্যে সর্বত্রই পাওয়া যায় টুকরা-টাকরা দৃশ্য, দৃশ্যকল্প যা আমাদের ছবি দেখায়— চলচ্চিত্রের মত, চিত্রকলার মত। কবিতার জন্য এ এক সম্পদ— যদি তা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়। মনোট্রেন মানে মনের ট্রেন— ‘ট্রেন’ শব্দটির মধ্যেই তো আছে এক দূরের হাতছানি অর্থাৎ মনের ভেতরেই আছে এক গতির নেশা, এক ভ্রমণের নেশা। মনের ট্রেন তাই ছুটে যায় সর্বক্ষণ। কোথা দিয়ে যায়? বৃক্ষদের হাইওয়ে ধরে। দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।
সামনে একটা লোহিত নদী আর ঘন কাশবন
তার ভেতর থেকে কী রকম একটা শব্দ টের পাচ্ছি
যেন নদীর ভেতর থেকে শব্দেরা উঠে আসছে
যেন কাশবনের উপরে কবিতারা ভাসছে
আর আমি উন্মাদের মত ডেকে যাচ্ছি নিজস্ব স্বরে।
ভাবা যায়? গ্রন্থটির প্রথম দিকে পড়তে গিয়ে মনে হয় কবিতা নির্বাচনে কি আরো কঠোর হতে পারতেন না শামীম? কিন্তু কিছুটা ভেতরে ঢুকলে সম্ভাবনাময় এক কবি আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। আর ডাকে লোহিত নদী ঘন কাশবন— অনুভূতির কবিতার মৃত্যু নেই। বেশি মিথচর্চা ও বিজ্ঞানচর্চা (বিজ্ঞানের পক্ষে যদিও) বেশি রহস্য, বেশি গূঢ় তত্ত্বকথা, বেশি জটিলতা, বেশি বেশি আড়াল, বেশি কোষ্ঠ-কাঠিন্য কবিতাকে প্রকৃত অনুভূতির জায়গা থেকে সরিয়ে দেয় কিনা, প্রত্যক্ষ থেকে অপ্রত্যক্ষে নিয়ে যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। বিশেষত যখন অনেক মিথচর্চাকামীরাই ইদানীং একাডেমিক কবি রূপে ব্যর্থ হয়ে পড়ছেন, লেখা ছেড়ে দিচ্ছেন, তখন শামীম মনে হয় সরাসরি কথাবার্তায় অনুভূতি জাগাতে সমর্থ হচ্ছেন। তার ভাষা এক ধরনের ঝরঝরে গদ্যনির্ভর কঠিন শব্দনির্ভর নয় বরং সুন্দর বাক্যনির্ভর। পুরনো প্রচলিত প্রাচীনগন্ধি বহু ব্যবহারে জীর্ণ ছন্দ থেকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন এবং কবিতার সর্বাধুনিক ফর্মটিই তার হাত দিয়ে চর্চিত হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কবিতা ক্রমশ দৈনন্দিন মুখের ভাষার কাছে আসবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। গদ্যেও যখন সেটাই ঘটেছে বিশেষত সাহিত্যের সংগ্রামটাই তো দেখছি কাঠিন্য বর্জন ও কথ্য ভাষার কাছাকাছি যাওয়া, তখন বলতেই হয় কবি শামীম হোসেন ঠিক কাজটাই করে চলেছেন। তবে তাকে হয়তো আরো কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হবে, ভাষার ক্ষেত্রে হয়তো আরো পরিমার্জন করতে হবে। তাই এ তরুণতুর্কীর দিন পড়ে আছে সামনে, সম্ভাবনা জাগিয়েছেন— ফলে দায়িত্ব বেড়ে গেছে তার। প্রচুর পাঠ ও ভ্রমণ দ্বারাই হয়তো কবিতার সেই অধরাকে ধরা একদিন সম্ভব হয়ে উঠবে।
(রচনাকাল: এপ্রিল ২০০৭)