শুভ জন্মদিন কবি শামীম আজাদ
কবিতার পথকে রাঙাও আরো অচেনা-মন রঙে।
বিলাও তোমার আবির যত শামীম আজাদের ঢঙে।
শামীম আজাদকে কেন জানি ভালোবাসি, বড় ভালোবাসি।
আজ তার জন্মদিন।
ভাবলাম, এতদিন তাকে এত যে ভালোবেসেছি,
সেকথা তো প্রকাশ্যে বলা হয়নি আজো।
কাজেই তার জন্মদিনের মতো বিশেষ এই দিনটিতেই বলি না হয়, সেই মধুর কথাটি।
তোমায় খুব ‘ভালোবাসি’ শামীম আপা।
কেন, বলো তো?
সুন্দরী, মমতাময়ী, প্রিয়দর্শিনী বলে?
হতে পারে,
তোমার কবিতার জন্যে?
হতে পারে,
নাকি, নানা স্বাদের গদ্য, গল্প, রান্না, স্টোরি টেলার মিলে যে তুমি—হতে পারে…তাও।
দীর্ঘকাল প্রবাসে থেকেও দেশপ্রেমের জন্যে তোমার হৃদয় খোঁড়া বেদনা, তিমিরবিনাশী গান আমার ভালো লাগে। প্রতিমুহূর্তে স্বদেশ সমুদ্রের ঢেউ এঁকে যাচ্ছ আপন মনে। বিজয় ফুলের জন্যে তোমার প্রেম, উদ্বেগ ও আনন্দ, মানুষ ও বন্ধুর প্রতি তোমার অন্তহীন ভালোবাসা…
সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তোমার রণমূর্তি—নারী ও মানবতা ধর্ষণের বিরুদ্ধে নিরন্তর ক্ষমতালিপ্সুর অসির বিরুদ্ধে তুমি যুদ্ধ করে যাচ্ছ মসি দিয়ে—জানো তো, প্রতিবাদের এই যুদ্ধটির সৌন্দর্য কিন্তু একদম আলাদা, অন্যরকম আকাশ-তরবারির খেলা!
দিনশেষে বাংলা ভাষাই তোমার আমার ভালোবাসার সেতুবন্ধন। অন্য অর্থে প্রতিরোধের, প্রতিবাদের মোক্ষম ক্ষমতার ধারালো অস্ত্রও বটে। নয় কি? আর, আর—এসব কিছু মিলেই তুমি অনন্য ও অসাধারণ, প্রাজ্ঞ ও ধীমতি। এসব আন্তর অনুভূতির আলোটুকু যথাক্রমে—একজন মানুষকে স্বমহিমায় সতত ভাস্বর করে তোলে। অজান্তেই কেউ কেউ সারস্বত সমাজের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। ভাবো তো শামীম আপা, সেসব যাত্রাপথের ধুলিমলিন স্মৃতিও আজ কত উজ্জ্বল আর সোনার মতো অমূল্য!
কবি ও কবিতা অসীম এবং স্বাধীন বলেই কি চিলির এক বিজ্ঞানী কবি নিকানর পাররা লিখেছিলেন ‘লিখ, যা তোমার খুশি / কেবল তা যেন শাদা কাগজের চাইতে উৎকৃষ্ট হয়।’ শাদা কাগজের চেয়ে উৎকৃষ্ট হতে গেলেই তো তাকে কবিতা হতে হবে।
আশির দশকে আমাদের সেই কাব্যযাত্রা ছিল ভাষাশিল্পের অনাবিল এক সত্যকে উন্মোচনের নেশায়। দর্শনীর বিনিময়ে প্রথম পদাবলির মঞ্চে কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে আমাদের ঘণিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব…ভালোবাসা। তারপর জীবন ও জীবিকার অনিবার্য টানে তুমি ছিটকে পড়লে প্রবাসে, আমি স্বদেশের শত কর্মেই যেন নানা মূর্তির সরস্বতি।
সংসারে সন্যাসী একজন কবিকে হৃদয়ে লালন করেছি নীলাচল জ্ঞানে, রাধিকা স্বপ্ন-প্রেমের গৌরাঙ্গ স্বরূপে। তুমি তখন অনেক দূরে, তবু দু’জন দু’জনার হৃদস্পন্দন স্পর্শ করতে পেরেছি, অনুভব করেছি তুমি আছ আমাদের পাশেই। আত্মার গভীর তলদেশ থেকে তার ডাক শুনেছি। আমাদের দু’জনেরই কবিতা-অস্ত্রবিদ্যার গুরু ছিলেন একজনই। তিনি কবিতার সেনাপতি, দ্রোণাচার্যের মতোই গুরু অবশ্য। মুক্তিযাদ্ধা-কবি রফিক আজাদ।
দিগন্ত প্রসারী কাব্য-জ্ঞানের এক অনন্য পুরোধা পুরুষ—তাকেই মেনেছি গুরু, আমরা দু’জনে তারই ভক্ত ও শিষ্য ছিলাম একলব্য জ্ঞানে।
তুমি কিন্তু তা বলেছও তোমার অনেক লেখায়। আমি আজই এই প্রথম স্পষ্ট করে বলছি যে, আমাদের সম্পর্কটি প্রথমে গুরু-শিষ্যের বাতাবরণে মেলেছিলো পাখা। অতপর প্রণয়ের গূঢ় ঊর্ণাজালে তা জড়িয়ে পড়েছিল দিনান্তের কচি কলাপাতা সন্ধ্যাটির মতো। আমাদের এই দুর্গম, বন্ধুর, প্রতিঘাতময় অলকাপুরীর পথপরিক্রমায় তুমি ছিলে দ্যুতিময় পূর্বমেঘ। আজ নিশ্চয় সত্তরে দাড়িয়ে তোমারও মনে হচ্ছে—সেও তো ছিল প্রাচীন কাল এক।
প্রাচীন গিরি-নদী পর্বতের মতোই—শিপ্রা, বেত্রবতী উজ্জ্বয়িনী পেরিয়ে আমাদের দু’জনের দুটি হাত বাড়ানো ছিল পরস্পরের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার প্রতি। ফেসবুকের কল্যাণে এখন আমরা প্রত্যেকের লেখা নিয়মিত পড়ছি, জানতেও পারছি বিভিন্ন কার্যক্রম। তোমার প্রতিটি লেখাই এত পরিণত আর বুদ্ধিদীপ্ত যে, পাঠে অনুক্ষণ অনুপ্রাণিত হই। ভাষার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব আগের চেয়ে অনেক গভীর, প্রগাঢ় ও ব্যাঞ্জনাময়। কবিতার চিত্রকল্প রচনায়ও ওস্তাদ হয়ে উঠেছ। উপমা অনুপ্রাস তো বলাই বাহুল্য। বিষয় বৈচিত্র্যেও বস্তুবাদীদের ছাড়িয়ে গেছ।
তোমাকে বোধ হয় মাঝে মধ্যে আমরা চিনতেও ভুল করি।
এ তুমি শুরুতে যেমন ছিলে, আজ আর তেমন নও গো!
এ তুমি অন্য তুমি।
স্বকীয় কণ্ঠে কথা বলা শামীম আজাদ।
নারী না হয়ে নর হলে খ্যাতির ঘোড়া কবেই তোমার পিছু নিতো। সে কথা আমি তুমি সকলেই জানি।
আর কবো কি?
এদেশে সঠিক মূল্যায়ণ ক’জনের ক্ষেত্রেই বা সঠিক?
আর একটা কথা বলি, শোনো।
প্রকৃত পুরস্কার তো প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না, যা দিতে পারে পাঠকের হৃদয়। আমি ও তোমার একজন পাঠক। তোমার কবিতা পড়তে ভালো লাগে, পাঠে আনন্দ পাই। কবিকে জানবার আনন্দ, ভাষার আনন্দ, সর্বোপরি মনের আনন্দ। তাবৎ শিল্পবিচারের মাপকাঠি হলো—পাঠে তা পাঠককে আনন্দ দেয় কি না। অর্থাৎ তুমি যা লিখছ, পাঠক হিসেবে—তা পাঠ করে আমি আনন্দ পাচ্ছি কি না। সহৃদয়হৃদয়সংবাদী সকল পাঠকের বিবেচনায় কবিতা তো সেই অমৃতলোক, যেখানে লুকিয়ে থাকে অলৌকিক আনন্দ-ভার।
কবিকে খুঁজে পাওয়ার একমাত্র জায়গা হচ্ছে তার কবিতা। কবি হলো দু’চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে সম্পূর্ণ অজানার উদ্দেশে পর্বতশিখর থেকে লাফ দেওয়া একজন মানুষ। কবি, জানে না কোথায় পতিত হবে। লাফ দেওয়া আর ভূপাতিত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টাই কবি জীবন। আর এজন্যেই কবিতা তোমার জীবনের ধ্রুবতারা হতে পেরেছে।
কবি ও কবিতা অসীম এবং স্বাধীন বলেই কি চিলির এক বিজ্ঞানী কবি নিকানর পাররা লিখেছিলেন ‘লিখ, যা তোমার খুশি / কেবল তা যেন শাদা কাগজের চাইতে উৎকৃষ্ট হয়।’ শাদা কাগজের চেয়ে উৎকৃষ্ট হতে গেলেই তো তাকে কবিতা হতে হবে।
এই কবিতাই লিখছ তুমি শামীম আপা। আর এজন্যেই তোমাকে এত ভালোবাসি। সমাজ যেমন কবিকে চিনতে চায় না, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে আপন মানুষেরাও কী বোঝে? কবিকে চেনে কি তার পরিবার?
তাকেই তুমি কত অনায়াসে বিষয় থেকে নির্বিশেষের সিংহ দরোজায় পৌঁছে দিয়েছ চমৎকার শব্দ-বন্ধের গাঁথুনিতে। কবিতা করে তুলেছো সেই অবাঙমানসগোচর। এ যেন চর্যাপদের কাল অতিক্রম করে তুমি উত্তর আধুনিক সময়ের ট্রেনে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে এলে আমাদের।
না, একদমই চেনে না। পরিবারের কাছে মুখ্য হলো সামাজিক দায়িত্ব কে কতটুকু পালন করেছে—কার কত অর্থবিত্ত আছে, সমাজে তাদেরই দড় চিরকাল। এছাড়া সমাজের মাপকাঠি অনুযায়ী জীবন যাপন করেছো কি না—সেটাই বিবেচ্য সমাজ এবং পরিবারের সদস্যদের।
রফিক আজাদকে প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতেন যে, কলকাতার দেশ পত্রিকায় কারও কবিতা প্রকাশ পেলে—যেকোনো হিন্দু পরিবারে তার কদর ও সম্মান বেড়ে যায় কয়েক গুণ। অথচ আমাদের বাঙালি মুসলমান সমাজ কেয়ারই করে না। পরিবার তো পরিবারই—প্রতিভার মূল্যায়ণ দূরে থাক, স্বীকৃতিটুকুও মেলে না তাদের কাছ থেকে।
কেউ গর্বিত হয় না এই ভেবে যে, একজন কবি, একজন অসাধারণ মানবিক, স্পর্শ কাতর মানুষ—আমাদের পরিবারেরই সদস্য। অথচ আমার মতো এইটুকু প্রতিভাধর কবি যদি কোনো উন্নত দেশে জন্মাতো—জীবনটা তাদের অন্য রকম সম্মানের ও আনন্দে কাটতো। তৃতীয় বিশ্বে বাংলা ভাষার হতদরিদ্র একজন কবির বেদনা যে, কত গভীর, অসম্মানের আর অপমানের তা বলাই বাহুল্য। কবি বিশেষে জেল-জরিমানা, অবহেলা, অপমান তো কবিদেরই ললাটের তিলক।
তোমার জন্মদিনে, আমার ভালো লাগা অনেক কবিতার মধ্যে থেকে আজন্ম কবি হৃদয়ের সেই পরম বেদনা-উৎসারিত কবিতাটি স্মরণ করছি আজ আমি।
পরম্পরা সংবাদ ॥ শামীম আজাদ
সেই মহিলার ধরনটা ছিল প্রাচীন
তাঁর মায়ের কাছ থেকে শেখা
ধারালো ধাতব হাতা ব্যবহার করতেন,
কাঁসার হাড়ি ও হাতার সব কথা শুনতে পেতাম।
পরে অবশ্য তিনি তা রূপান্তরিত করেন
নারকেল মালায় ও মুলিবাঁশের হাতায়
তাতে বাটা ও কাটা পেঁয়াজ একদম মিশে যেতো,
আমরা শুধু তাঁর চোখের জল দেখতাম।
তার স্বামীর ধরন ছিল বিশেষ বিমূর্ত
সবই আবছা, অন্ধকার ও প্রহেলিকাময়।
একদিন তিনি সত্যিই আবছা হয়ে গেলে
ছোট মেয়েটি কেঁদেছিলো ভোর পর্যন্ত।
তাঁর প্রহেলিকা হওয়ার ধরনটা
ভর করলো আমার ওপর
আর আবছা হবার ব্যাপারটা
নিয়ে নিলো আমার ছোট বোন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে
আমার স্টাইলই হয়ে গেলো তীব্র তস্কর
অক্ষর আর অকারণ ব্যথা
সেই থেকে রান্না হতে লাগলো উৎকৃষ্ট কবিতা।
ব্যাপারটা এখন এত অন্যরকম হয়ে গেছে যে
আমার পরিবার আর আমাকে বোঝে না, চেনেও না।।
সত্যি তো, এই পরিবার কবিকে বোঝে না, চেনেও না।
এ রকম পরিবারের সদস্য, যে কবিতার লেখক, লিখছে, সে তো প্রহেলিকাময়, তার জন্যে সম্মানিত বোধ করে না কেউ। তার জন্যে বাড়তি কোনো আদর-যত্ন-অনুপ্রেরণা তো নেই-ই। বরং অনেকেই বিরক্ত থাকে এই ভেবে যে, যত অকাজের কাজ! ওসব দিয়ে কী হয়?
এসব নিত্য-অনিত্যের বাস্তবিক পটভূমি তোমার হাতে কবিতার চিরায়ত বিষয় হয়ে উঠেছে। তাকেই তুমি কত অনায়াসে বিষয় থেকে নির্বিশেষের সিংহ দরোজায় পৌঁছে দিয়েছ চমৎকার শব্দ-বন্ধের গাঁথুনিতে। কবিতা করে তুলেছো সেই অবাঙমানসগোচর। এ যেন চর্যাপদের কাল অতিক্রম করে তুমি উত্তর আধুনিক সময়ের ট্রেনে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে এলে আমাদের।
সাধু, সাধু, সাধু…
আমি বিমুগ্ধ, আমার মুগ্ধতাটুকু ভালোবাসার মোড়কে বেঁধে পাঠালাম তোমাকে, নিও।
জন্মদিনের একরাশ রক্তিম শুভেচ্ছা আবারও, তোমাকে।
ইতি
দিলারা হাফিজ
আরও পড়ুন: বাংলা উপন্যাসে নদী: জীবনের উপকথা ॥ রকিবুল হাসান