শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় বালকবেলায়। তখন স্কুলে পড়ি। পড়াপাঠ্যের মধ্যে বাংলা বইটাই ভালো লাগে। অন্য বইগুলো ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করে না। বাংলা বইয়ের গল্প এবং কবিতাগুলো বার বার করে পড়া। কবিতাগুলো পড়তাম জোরে জোরে। স্কুলের পড়াপাঠ্যের মাঝে পেয়ে যাই একদিন ‘স্বাধীনতা তুমি’। ‘স্বাধীনতা তুমি/রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।/স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা’ লাইনগুলোর অর্থ তখন যে এতটুকুও বুঝিনি, এই সত্যের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে আমার ভালোলাগার উপাখ্যান।
জোরে জোরে যখন কবিতাটি পড়তাম, কবিতার যে গতিময়তা, তা টেনে নিয়ে যেত অন্য কোনো ভুবনে। কবিতাটির প্রতিটি পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে শব্দ আর ছবির যে বহুবর্ণিল আভা, তা মাতিয়ে রেখেছিল। কিছুই বুঝতাম না, ক্লাসে কবিতাটি কখনো পড়ানো হয়েছিল কি না, মনে নেই, তবে স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে স্কুলের অনুষ্ঠানে ছেলেমেয়েরা আবৃত্তি করত। মাইকে তাদের গমগমে কণ্ঠস্বর নিয়ে যেত অনেক দূরের কোনো দেশে। যেখানে সত্যিকার অর্থেই হয়তো পড়ে থাকত, ‘বাগানের ঘর, কোকিলের গান,/বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,/যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’ এভাবেই কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা।
ধীরে ধীরে বড় হয়েছি, পাঠ্যতালিকার বাইরে বইয়ের জগতের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কবিতার সঙ্গে মিতালি হয়েছে। বুঝতে শেখার পর শামসুর রাহমানের শেষ দিকের কবিতা নিয়ে বিরূপ সমালোচনা শুনেছি। সেই শুনতে শুনতেই রাজধানীতে আসা আমার কবিতার খাতা নিয়ে। দূর থেকে মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেছি, কিন্তু কখনোই সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছে যেতে চেষ্টা করিনি।
নিজের লেখাকে কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ছুটি দেন। শেষ বিদায়ের শ্রদ্ধা জানাতে যখন তার শবদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশ, তখন কাজ করতাম দৈনিক আজকের কাগজে। পত্রিকায় সহকর্মীদের সঙ্গে শহীদ মিনারের পাদদেশে সেদিনই আমার সামনে থেকে দেখা। কিন্তু কবিতার যে মুগ্ধতা তিনি আমার কিশোর মনে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই মুগ্ধতার রেশ কাটেনি।
উত্তররৈবিক বাংলা কবিতায় ত্রিশের দশকের মুগ্ধতার বাঁক পেরিয়ে শামসুর রাহমানই তৈরি করেছেন নিজস্বতা। বাংলা কবিতায় নির্মাণ করেছেন স্বাতন্ত্র্য। তাই ব্যক্তি শামসুর রাহমানের চেয়ে কবি শামসুর রাহমান মানুষের মনে উজ্জ্বল। এই উজ্জ্বলতার প্রধান কারণ তিনি ত্রিশের কবিতার বলয় থেকে মুক্ত করেছেন বাংলা কবিতাকে। নতুন পথ নির্মাণ করেছেন, তৈরি করেছেন নিজের ভাষাভঙ্গি।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র পর প্রায় অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তিনি লিখেছেন। সেই লেখায় উঠে এসেছে, নগর জীবনের দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, আনন্দ-অশ্রু, বিতৃষ্ণা-বিদ্রূপ যা তাকে দিয়েছে নাগরিক কবির অভিধা। কিন্তু নাগরিকতার বাইরেও কবিতায় প্রকৃতি ও জীবনের যে উপস্থিতি সেখানে কবি শামসুর রাহমানের সংবেদনশীল মন ছুঁয়ে গেছে তার পাঠককেও। জীবনের আনন্দ ও বিষাদ তাকে যেমন আলোড়িত করেছে, তেমনিভাবে সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক বিষয়েও তিনি সমান আলোড়িত হয়েছেন। এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতার বাইরে থেকে তিনি সৃষ্টিশীলতার পথে অনায়াসে নিয়ে এসেছেন স্বকালকে।
পাঠককে আলোড়িত করা আর মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন ত্রিরিশোত্তর বাংলা কবিতায় এক স্বতন্ত্র নাম।