আমাদের দেশ নদী মাতৃক দেশ। এদেশের নদীতে নৌকায় করে ভেসে চলে মাঝি-মাল্লারা। তাদের কণ্ঠে বাজে নানা রকম গান। এ গান গেয়ে তারা হৃদয়ে শান্তি খুঁজে পায়। মানুষ শুধু আনন্দেই গান করে না, কষ্টে, বিপদে, হাহাকারেও গান করে। গানে কী এমন শক্তি আছে যে, মানুষের হৃদয়ে সে আনন্দ জোগায়? রেখাপাত করে। কী আছে এতে? এ গান কেমন করে আসল? কেমন করে মানুষ একে আয়ত্ত করল? আজ আমরা যে গান শুনি, সে গান আপনা আপনি আসেনি। আর আমরা আজ যে গান করি, প্রথমে এ গান এ রকম ছিল না। আমরা বাঙালি। আমাদের গানও বাংলা। এ বাংলা গান ধারণা করা হয় যে গীত হতে এসেছে। আগের দিনে মানুষেরা সুন্নতে খাতনা, বিয়ে ছাড়াও নানা অনুষ্ঠানে গীত গাইতো। এখন প্রশ্ন হতে পারে গীতটা কী? গীত হলো কতোগুলো কথার সমষ্টি। এগুলো খুব দারুণভাবে ছন্দবদ্ধ করে সুরের সাথে গাওয়া হতো। এ গীতে গ্রামের সবাই দক্ষ ছিল না। এ গীতে কিছু কিছু মহিলা/পুরুষ দক্ষ ছিল। যখন কোনো বাড়িতে অনুষ্ঠান হতো, তখন নারী-পুরষ মিলে গীত গাইতো। বিয়ের সময় পাত্র-পাত্রীকে স্নান করানোর সময় এ গীত গাওয়া হতো।
কালের ধারাবহিকতায় এসেছে আজকের আধুনিক গান। আমাদের দেশে বারোমাসে তের পূজাপার্বণ। আমাদের কৃষ্টি-কালচারের বিশাল স্থানজুড়ে আছে গান। এ গান আমাদের হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য। বাংলা গানের উদ্ভব সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো—
১.ঠিক কবে থেকে বাংলা গানের প্রচলন তার সঠিক ইতিহাস না থাকলেও বাংলাদেশের প্রাচীন সঙ্গীতের পরিচয় পাওয়া যায় পালবংশের রাজত্বকালে। অষ্টম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করে পাল বংশ। এ সময় পালা গান বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং লোকমুখে এর দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। রাগ ও প্রবন্ধ শ্রেণীর সঙ্গীত এ সময়কার অন্যতম সংযোজন। এ ছাড়াও বহুকাল ধরে বাংলা গানের আদি ভিত করা হয় স্তোত্রকে। দেব-বেদীর মণ্ডপে ঠাকুর সুর করে যে মন্ত্র আউড়ায় তাকেই স্তোত্র বলে। পাল বংশীয় সময়ে দেব-দেবীর পূজা অর্চনা বেশি ছিল বলে অধিকাংশ গানই মন্দিরের চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। একাদশ শতাব্দীতে চালুকরা বাংলাদেশ অভিযানে আসে। সেন রাজাদের পূর্ব পুরুষরাই হেলা চালুক্য। এক সময় বাংলাদেশের শাসন সেন রাজাদের হাতে চালে যায়। সেনদের অনুরাগ ছিল সংস্কৃতির চর্চার প্রতি। কিন্তু ভাষাগত সমস্যা এ দেশের মানুষকে সেই সঙ্গীত থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। বাংলাদেশের শেষ হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব রচিত গীত গোবিন্দ একটি প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ। গীত গোবিন্দে অন্তর্ভুক্ত গানগুলোকে বলা হয় প্রবন্ধ শ্রেণীর সঙ্গীত। দশম শতাব্দী থেকে প্রবন্ধ সঙ্গীতের সঙ্গে চর্যাপদ বা চর্যা প্রবন্ধের প্রচলন ছিল। জয়দেবের গান থেকে বাংলাদেশে প্রবন্ধ সঙ্গীত বিস্তার লাভ করে। চর্যাকে তাই বাংলাদেশের প্রাচীনতম সঙ্গীত বলে মনে করা হয়। চর্য এক ধরনের যোগী সম্প্রদায়ের গীত। চর্যায় রাগের উল্লেখ আছে। এ কারণে চর্যা গীতে রাগের প্রভাব লক্ষনীয়। ১২০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির আগমন ঘটে এবং মুসলিম নতুন ধারার সূচনা ঘটে এ সময় থেকে। যে সঙ্গীত আগে ছিল শুধু দেব-দেবীর আরাধনায় নিয়োজিত সে সঙ্গীত মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে সহজ সরল ও সাবলীল রূপ ধারণ করল। ছড়িয়ে পড়ল প্রতিটি আনাচে-কানাচে যা আগে ছিল অকল্পনীয়। কারণ তখন কিছু ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মুসলমানদের কাছে সঙ্গীতের রূপ ছিল বাস্তবধর্মী এবং জাগতিক আনন্দের উৎস। মূলত এখান থেকেই সঙ্গীতের নবযুগ সূচিত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে দুই ধরনের সঙ্গীতের প্রচলন রয়েছে। (১) মার্গ সঙ্গীত, (২) দেশি সঙ্গীত। মূলত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতই মার্গ সঙ্গীতের অনুসারী। বাংলা সঙ্গীত প্রধানত দেশী সঙ্গীতের আদর্শেই রচিত। [সূত্র: গানগুলি মোর ইউটিউবে- তৌফিক অপু]
গানগুলো আগে আজকের মতো লিখিত ছিলনা। এটা মানুসের মুখে মুখে অনেক দিন ধরে চলে আসছে। এসব গান ছিল বাংলঅর চাষী, মূর্খ, কুমার, কামার, তাঁতীর গান। এ গান অতি প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে গীত হচ্ছে। সংগ্রহের অভাবে অনেক গান হারিয়েও গেছে। এসব গানকে বলা হয় লোক সঙ্গীত। মূলত এ লোক সঙ্গীতই বাংলা গাওনের প্রাচীন ঠিকানা বা ভিত্তি। এর ধারাবাহিকতায় আজকের আধুনিক গান। এ লোক সঙ্গীতের এক প্রাচীন ধারা আলকাপ গান। এ গানের প্রাচীন উৎস হিসেবে ধরা হয় চাঁপায়নবানবগঞ্জকে। এ আলকাপ শব্দের অর্থ হলো ঢং, কৌতুক। অর্থাৎ হাস্যরসাত্মক মূলক গান। এ গানগুলো রচনা করেছে এদেশের অবহেলীত, নিগৃহীত মানুষ। যারা প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত হয়। এ সব গরিব কামার, কুমোর, কুষক, তাঁতী, মেহনতী মানুষেই তৈরি করেছে এ গান। এ গানে আছে তাদের প্রত্যহিক জীবনের হাসি কান্নার কথা, ভালোবাসা আর বেদনার কথা। এ গানের আবেদন যেন শেষ হবার নয়। এ অলিকাপ গানই ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ গানকে কখনো ডাকা হয় লেটো গান, গাম্ভীরা, বাউল, জারি, সারি, গাজির গান, ভাওয়াইয়া, কবিগান, ভাবগান, বিচারগান, টপ্পা, কীর্তন, ভজন ইত্যাদি নামে। এ গান সংগ্রহের জন্য আজও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ গানগুলো আজও আমাদের প্রত্নঅঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যেমন ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, আমরা বায়ুর সাগরে ডুব থেকে যেমন বুঝতে পারি না আমরা বায়ুর সাগরে ডুবে আছি। তেমনই পাড়া গায়ে থেকে আমাদের মনেই হয় না কত বড় সাহিত্য ও সাহিত্য উপকরণ ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশে। এ গ্রাম্য পর্যায় থেকেই সৃষ্টি হয়েছে লোক সঙ্গীত বা গ্রাম্য গান, এ গ্রাম্য গান এভাবে চলতে চলতে মানুষের চিন্তা চেতনা কিছুটা বিকশিত হলো। তাদের চেতনায় ধরা দিলো নতুন কিছু সংযোজন করতে হবে গানের সঙ্গে। তখন তারা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করল। এ বাদ্যযন্ত্রের সংস্পর্শে এসে গান আরও সুমধুর হয়ে উঠল। গান মানুষের কাছে নতুন এক বার্তা নিয়ে আসল। যন্ত্র আবিস্কারের আগে মানুষ খালি গলায় গান গাইত এবং হাতের কাছে যা থাকতো তাতেই শব্দ করে গানের সঙ্গে মিতালি করার চেষ্টা করত। সে সময় থেকে বাদ্য যন্ত্রের ধারণা সৃষ্টি হলো। তার পর থেকে কালের ধারাবাহিকতায় তারা গানের সংস্পর্শে নিয়ে আসল ঢোল, তবলা, একতারা, দো তারা, ডুগি, হারমনিয়াম ইত্যাদি। মধ্যযুগের পর পারই মোগল সাম্রাজ্যের সময বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। হারমনিয়াম-তবলা ব্যবহার মোগল শাসনামলে উল্লেখ রয়েছে। সম্রাট আকবরের নবরত্নের সদস্য মিয়া তানসেনের তানপুরা ব্যবহার সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। কথিত আছে, মিয়া তানসেন মেঘ মল্লার রাগ পরিবেশন করে বৃষ্টি নামাতে সক্ষম হয়েছিলেন আবার ভৈরবী গান পরিবেশন করে রাতের বেলায়ই ভোরের আবহ সৃষ্টি করেছেন। সঙ্গীতের প্রতি কতটা নিবেদিত হলে এটা সম্ভব। সঙ্গীত চর্চা এবং বাদ্য যন্দ্রের ব্যাপক প্রসার ঘটে এসময় থেকেই। [সূত্র: ঐ]
এভাবে পরিবর্তন হতে হতে এক সময় বাংলা গানের দারা পরিবর্তিত হলো দুর্বার গতিতে। এ সময় পঞ্চকবির গানে ঝংকারিত হলো বাংলার গানের ভূবন। নতুন ধারার সুচিত হলো। তারা পরিবর্তিত করলেন কিছু ঢং আবার যোগ করলেন কিছু নিয়মনীতি। তাদের আগমনে নতুন ভাব জেগে ওঠে। এ পঞ্চ কবি হলেন রবী ঠাকুর, রজনীকান্ত, ডি.এল রায়, অতুল প্রসাদ ও কাজী নজরুল। আমাদের লোক সঙ্গীদের অনেক সংখ্যা সংগ্রহের অভাবে হারিয়ে গেছে। ধ্বংস হয়েছে আমাদের আদি সাহিত্য। যে সাহিত্য আজ কোনো এক গহীন সাগরের জলে হাবুডুবু খাচ্ছে আর নিম্নের দিকে ধাপিত হচ্ছে। আমাদের যা দিয়েছে তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেয়, কিন্তু যা আছে তাও তো সংগ্রহ করা হচ্ছে না। এটা নিয়ে আমাদের ভাবনা চিন্তার ইয়ত্তা নেয়। এ ভাবেই সংগ্রহের অভাবে ধ্বংস হয় জাতীর সাহিত্য সংস্কৃতি। আমরা যদি আমাদের পূর্ব-পুরুষদের দোষারোপ করি তাতেও মনে হয় আমাদের কটূক্তি হবে না। আমাদের কাছে তাঁরা দায়বদ্ধ। তাঁরা তাদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই একাজগুলো করতে পারতেন। আসলে কে বয় কার বোঝা। আর এতো পুরা জাতির বোঝা। নিজের খেয়েতো বনের মোষ তাড়ানো উচিত নয়, যে সময় পঞ্চ কবির আগমন ঘটল সে সময় শিক্ষা-দীক্ষার অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। সংরক্ষণ করা হয়েছে এসব কবির গান। এখনো কানে বাজে অতুল প্রসাদের সেই হৃদয়কাড়া গান—
মোদের গরব মোদের আসা/আ-মরি বাংলা ভাষা/কী-জাদু বাংলা গানে/গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে।
কী সে আশা জাগানিয়া গান। কী মধুর দেশ প্রেমের কথা, আবার ডি.এল.রায় দেশ মাতৃকাকে ভালোবেসে গেয়ে উঠলেন—
ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা/আমাদের এই বসুন্ধরা/তাহার মাঝে আছে/দেশ এক সকল দেশের সেরা।
এ গানগুলো আজও জীবন্ত। এ গানগুলো আজও মানুষ বারবার শুনছে। আর বারবার বিমুগ্ধ হয়ে দেশমাতৃকা-মানুষের পানে বারংবার তাকাচ্ছে। কী দারুণ ছিল আমাদের সে সময়ের গান! এবার রজনী কান্ত গেয়ে উঠলেন—
তুমি নির্মল কর/মঙ্গল করে/মলিন মর্ম মুছায়ে
আবার গাইলেন—
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়/মাথায় তুলে নেরে ভাই/দীন দুঃখিনী মাযে তোদের/তার বেশি আর সাধ্য নায়।
কী হৃদয় জুড়ানো গান। যে গান গুলোতে উঠে এসেছে মা, মাটির গন্ধ। যে মায়ের আশ্রয়ে এসে নিশ্চিন্ত ঘুমায় তার সন্তান। কী তৃপ্তি যে মায়ে কোলে ঘুমানো তা আর বলে শেষ করা যাবে না। গানের জগতে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কথা তো বলায় লাগে না। আমাদের দেশে প্রত্যহিক জীবনে তো আমরা রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে চলেছি তার অমর সৃষ্টি যা আমাদের তথা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। কেমন মানুষ হলে তার এক গান দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে। তা আমরা খুব সহজেই কল্পনা করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের গান সর্ব জায়গায় গীত করে তিনি রচনা করেছেন। তার গানে এসেছে বাংলার জল বায়ু, মানুষ ইত্যাদি। তার উল্লেখ যোগ্য গান—
১. বাংলার জল, বাংলার ফল/পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক হে ভগবান।
২. আমার সোনার বাংলা।
৩. ও আমার দেশের মাটি/তোমার পরে ঠেকায় মাথা।
কী সব দেশ প্রেম। কী সব ভালোবাসার কথা বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। রবিঠাকুরের পরে বাংলা সাহিত্যে গানের ধারাকে যিনি নতুন রূপ দিয়েছেন নতুন প্রাণ দিয়ে তাকে রূপ রসে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন তিনি বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধের মানুষ মানবধর্ম যার কাছে বড় ধর্ম সেই মানুষ, সাম্যের দাবি প্রতিষ্ঠায় যিনি তার লেখনির প্রতিটা জায়গায় নিয়ে এসেছে অবহেলিত, দুঃখীকে, সেই তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তার গান দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদের বেড়াকে সরাতে চেয়েছেন। তাইতো তিনি গেয়ে উঠেছেন—
১. হিন্দু না ওরা মুসলিম/ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ/সন্তান মোর মার।
২. গাহি সাম্যের গান/যেখানে এসে এক হয়ে/গেছে সব ব্যবধান।
৩. জাতের চেয়ে মানুষ সত্য/অধিক সত্য প্রাণের টান/প্রাণ ঘরে সব এক সমান।
কাজী নজরুলের গানে উঠে এসেছে অবহেলিত মানুষের কথা, নিপীড়িত জনতার কথা। এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজার নজরুল সঙ্গীত সংরক্ষিত আছে। পঞ্চকবির কিছুকাল আগে বাংলায় আবির্ভাব হয় সূফিদর্শনের জনক লালন সাঁইয়ের। বিংশ শতাব্দীতে শাহ আব্দুল করিমের আবির্ভাব হয়। যিনি গেয়েছেন—
১. মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে/দেওয়ানা বানাইছে, কি যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে।
২. আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম/গ্রামের নওযোয়ান হিন্দু মুসলমান।
৩. সোনা দিয়া বানদিয়াছি ঘর/ও মনরে ঘূনে করল জরোজর।
৪. গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে…
আমরা মরমি কবি হিসেবে আরও পেয়েছি হাসন রাজাকে। ফকির লালন সাঁইয়ের জন্ম আনুমানিক ১৭৭৪ সালে। তার জন্ম নিয়ে এর বেশি তথ্য জানা যায়নি। কেউ বলেন তিনি ঝিনাইদহের ছেলে আবার কউ বলেন কুষ্টিয়ার। তবে এটা নিয়ে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক রয়েছে। তিনি কোন জাতের তাও জানা যায়নি, তবে তাঁর জাত না জানাতে ভালো হয়েছে। কারণ আমাদের দেশে ধর্মের বাড়াবাড়িটা বেশি। তাঁর ধর্ম না জানার কারণেই তিনি আজ সর্বজনীন হতে পেরেছেন। তাঁর সম্পর্কে জানা যায়, তিনি নাকি বসন্ত রোগ থেকে আরোগ্য হওয়ার পর নিজের সম্পর্কে বা নিজেকে জানার সাধনায় মগ্ন হন। তার আধ্যাত্মিকতার শুরু সিরাজ সাঁই। ফকির লালন সারাজীবন জাতকে অবহেলা করেছেন। কারণ তিনি জানতেন মানুষের বড় পরিচয় জাত দিয়ে নয়। তিনি সারাজীবন তাঁর গানের মাধ্যমে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।তিনি বলেছেন জাতকে যদি ধরতে পারতাম আগুন দিয়ে পুড়াতাম। তিনি তার গানে বলেছেন—
১. জাতের কী রূপ /দেখলাম না এক নজরে।
২. মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/সে কী অন্য তত্ত্ব মানে।
৩. আত্মতত্ত্ব জানরে আগে।
লালনের তত্ত্ব বা গান বাংলাদেশের বাউল গান নামে পরিচিত। এ গানের ধারাও বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা এনেছে। এ গানগুলো কোনো মঞ্চে বা আকড়াই গাওয়া হতো। গানগুলো সর্বকালে সর্বাবস্থায় মানুষের হৃদয়কে জয় করেছে। আগের দিনে বটের তলে বা কোনো মুক্তজায়গায় সামিয়ানা টানিয়ে এ গানের আসর করা হতো। আবার অনেক বাড়িতে কাচারি ঘর বা খানকা ছিল সে সব জায়গা এসব গান করা হতো। এক সময় মানুষের ভাবনায় এলো মানুষের গাওয়া এই গান গুলো শুধু শিল্পীর মুখেই নয় তাঁর এ গান যন্ত্রের মাধ্যমে বারবার শুনতে হবে। সে ভাবনা থেকেই আসল গ্রামোফোন। এ গ্রামোফোনের মাধ্যমে শিল্পীর গান যন্ত্রের মাধ্যমে শোনার ধারা প্রচালিত হলো।
৩. গানের জগতে গ্রামোফোন এর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ধারণা করা হয়, এ যন্ত্র আবিস্কার না হলে গানের জোরালো ধারা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। গ্রামোফোনের প্রথম ধারণা আবিষ্কৃত হয় ১৮৭৭ সালে। টমাস এডিসন এ ধারণার উদ্ভাবক। কিন্তু তিনি এর পরিপূর্ণতা দিতে পারেননি। পরবর্তীকালে ১৮৮৭ সালে এমিল বালাইনার একটি পরিপূর্ণ গ্রামোফেন তৈরি করতে সক্ষম হন। গ্রামোফোনের মাধ্যমে তিনি গান রেকর্ড করতে সক্ষম হন। এরই ফলে গান রেকর্ড করার কলাকৌশল রপ্ত করেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালে তিনি এইচএমভি প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার স্বত্ব তিনি পরবর্তী সময়ে ভিক্টোর টকিং মেশিন কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছেন। সেই সময়ে ভারতে এইচ এমভির আগমণ এবং তৎকালীন সময়ের একমাত্র গ্রামোফোন রেকর্ডিং কোম্পানি ছিল এইচএমভি। [সূত্র: গানগুলি মোর ইউটিউবে: তৌফিক অপূ]
এ গ্রামোফোনগুলো শোভা পেত ধনিক-শ্রেণীর ঘরে। বিশেষ করে গানপ্রিয় মানুষদের ঘরে। এ গ্রামোফোনে যে রেকর্ড বাজানো হতো তার এ পিঠে একটি এবং ও পিঠে মোট দু’টি গান থাকতো। চাবি ঘুরিয়ে মাউস পিসের মতো একটি অংক রেকর্ডারের ওপর স্থাপন করা মাত্রই গান হতো। কিন্তু বারবার রেকর্ডার পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে গান শোনার মধ্যে বিরক্ত আসতে থাকে। এক সময় এ গ্রামোফোন বিরক্তির একটা বিষয় হয়ে উঠতে লাগল, ঠিক সেই সময় আবিষ্কৃত হলো ক্যাসেট। সেটা ছিল ফিতাসমৃদ্ধ। এ ফিতায় ১০-১২টা করে গান থাকতো। বাংলাদেশে ষাট দশকের দিকে এটির প্রচলন হয়। এ সময় আবিষ্কৃত হয় রেডিও। যখন গ্রামোফোন আবিষ্কার হয় তখনতো এটা ছিল ধনীদের বিলাসিতার বস্তু। কিন্তু যখন রেডিও আবিষ্কার হয় তখন এটি গরিব, নিম্ন জাতের মানুষ লুপে নেয়। সমস্ত মানুষের নিত্যসঙ্গী হিসেবে তাদের মনে স্থান করে নেয় রেডিও। গ্রামের বউ ঝিরাও রেডিওকে অবলম্বন করে তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী-কাঁথা সেলাই করতো। মনের আদলে গড়ে তুলতো কাঁথাকে। এ ভাবেই চলে আসছে আমাদের শিল্প সংস্কৃতির ধারা। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে অডিও শিল্পের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ সময় বাংলাদেশে গড়ে ওঠে অনেকগুলো মিউজিক স্টেশন। এ সময় আমাদের দেশে পপ গানের আদলে গড়ে ওঠে বাংলা গান। নতুন প্রজন্মের কাছে এ ধারা দিনে দিনে অতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময় ব্যাপক বিক্রি হতে থাকে অডিও ক্যাসেট। মানুষের চিন্তা-ভাবনারও পরিবর্তন হতে থাকে। তাদের পছন্দও বাকনেয় চারিদিকে। তাদের কেউ পছন্দ করে পপ গান, কেউ নজরুল সঙ্গীত, কেউ রবীন্দ্র সঙ্গীত, কেউ লালনগীতি, কেউ ব্যান্ড সঙ্গীত। পপ সঙ্গীতই আমাদের দেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের সূচনা করে। কিন্তু সেকালের লোকগানগুলোর মতো জীবন্ত হয়ে থাকেনি, এক সময় মানুষ গানকে জ্ঞান মনে করত কিন্তু বর্তমানে আর গানকে জ্ঞান মনে করা হয় না। গানকে বর্তমানে মনে হয় সাময়িক মনের খোরাক। বর্তমানে এক ধরনের গান করা হয় যেগুলোতে গানের প্রাধান্যের চেয়ে মিউজিকের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। গান শুনলে মনে হয় আমরা গান শুনছি না মিউজিক শুনছি। মিউজিকের সামঞ্জস্যের জন্য গানকে আনা হয়েছে। আবার আজ বিখ্যাত গানগুলোকে মিউজিক দিয়ে এমন বিশ্রীভাবে তৈরি করা হচ্ছে সেটাকে বলা যায় শুধু বিদেশি আদল।।