একটা সময় ছিল, তখন যা মনে আসতো; তা-ই লিখে ফেলতাম। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে লিখতাম। লিখতেই হবে—এমন একটা অবস্থা হয়েছিল। লেখাগুলো বেশ কয়েকটি পত্রিকায় পাঠিয়ে হতাশও হয়েছিলাম। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি, লেখাগুলো মানহীন ছিল। মানে সম্পাদনার আগেই পাঠিয়ে দিতাম। নিজের ভুলগুলো ধরতে পারতাম না।
এখন সেই আমার কথাই বলি, কখনো কখনো একটি শব্দকে কেন্দ্র করে লিখতে শুরু করি। হতে পারে সেটি কবিতা, গল্প, নাটক বা প্রবন্ধ। শুরুতে লেখাটি এলোমেলোও হতে পারে। কারণ মনের মধ্যে যে ভাবাবেগ, চিন্তা, কল্পনা বিরাজ করছে; তাকে দ্রুত প্রকাশ করার জন্য লিখে ফেলতে হয়। তা না হলে ওই ভাব, ওই আবেগ, ওই শব্দ, ওই কাহিনি আর মাথার মধ্যে থাকে না। যাকে আমি টুকে রাখা বলতে পারি।
এখানে কৃষকও একজন শিল্পী। ওই কৃষকের মতো লেখকও একজন শিল্পী। তাকেও বাছাই, ছাঁটাই, মাড়াই করতে হবে। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।
পরে যখন লেখাটি পড়তে শুরু করি; তখন তার ভেতরে অনেক অসঙ্গতি খুঁজে পাই। বানান ভুল পাই, বাক্য অশুদ্ধ পাই। এমনকী কাহিনি, চরিত্র, সময় বা নামের অনৈক্য চোখে পড়ে। লিখে শেষ করেই ফেলে রাখি না। দ্বিতীয়বার পড়তে গেলে অনেক কিছু চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই যে কাজটি করতে হচ্ছে, এটিই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে তৃতীয়বার পড়তে গেলে রচনাটি আরও মজবুত হয়। আরও কিছু ত্রুটি সংশোধনের সময় পাই। তবে কোনো কোনো লেখা আমি দ্বিতীয়বার পড়েই সম্পাদকের হাতে সপে দেই। বাকি কাজটা তাকেই করতে হয়।
তাই বলবো, যখন যা মনে আসে, তা অনেকেই লিখতে পারেন। লিখে ফেলার মধ্যে আমি দোষ দেখি না। লেখার স্বাধীনতা সবারই আছে। মন চাইলে কোনো কিছু লিখে রাখাই যায়। যাকে আমরা রাফ খাতা বলি। রাফ খাতায় যা খুশি তাই লেখা যায়। তবে তখনই সেটা প্রকাশযোগ্য কি না, তা ভাবতে হবে লেখককে। বাকি দায়ভার সম্পাদক-প্রকাশকের। তবে, প্রতিটি কাজের আগে যেমন পরিকল্পনা থাকা উচিত, তেমনি লেখার ক্ষেত্রেও পরিকল্পনা থাকা দরকার।
এমনকী হিবিজিবি লেখাটিও পূর্ণাঙ্গভাবে দাঁড় করানো যায়, অনেকটা পুরনো ভবনের সংস্কারের মতো। আবার পুরনো ভবন ডেভেলপারদের দেওয়ার মতো। অর্থাৎ লেখাটি যদি সুন্দরভাবে গুছিয়ে সুখপাঠ্য করা যায়, তাহলে সেটি সার্থক লেখায় পরিণত হবে। ওই হিবিজিবি লেখা থেকে যদি ভালো কিছু বের হয়ে আসে, তাহলে মন্দ কী? লিখে ফেলাটা তাই কোনো বিষয় নয়। তবে যা মনে এলো লিখে প্রকাশ করে ফেললাম, সেটা আবার অপরিণত মানসিকতার পরিচায়ক।
আমরা জানি, কৃষক মাঠ থেকে ফসল তুলে উঠোনে বা বাড়ির ফাঁকা জায়গায় স্তূপ করে রাখে। পরে সময় নিয়ে সেগুলো বাছাই, ছাঁটাই, মাড়াই করে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয়টুকু গ্রহণ করে বাকিটা বর্জন করে বা অন্য কাজে ব্যবহার করে। এই কৃষক যে কাজটুকু সময় নিয়ে করলো, এটাই মূলত শিল্পীর কাজ। এখানে কৃষকও একজন শিল্পী। ওই কৃষকের মতো লেখকও একজন শিল্পী। তাকেও বাছাই, ছাঁটাই, মাড়াই করতে হবে। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।
এককথায় বলতে গেলে রাফ খাতাটিই পাঠিয়ে দেন কুরিয়ারে, মেইলে বা ফেসবুকের ইনবেক্স। তিনি লেখাটিকে মহাভারত-বাইবেল ভাবতেও ভুল করেন না।
তাই তো বলতে হয়, আমি কী লিখবো, কেন লিখবো, কীভাবে লিখবো—তার একটি পূর্বপ্রস্তুতি জরুরি। উদ্দেশ্যহীনভাবে অর্থহীন কোনো লেখা যেমন ঠিক নয়, ঠিক তেমনই তা প্রকাশ করাও অনুচিত। তাতে পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। পাঠকও লেখকের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। আর পাঠক একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে সেই পাঠক আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এভাবেই কালের গর্ভে অনেক লেখক হারিয়ে গেছেন। তাই প্রতিটি লেখার পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্তত লেখাটি পড়ে পাঠক যেন কিছু শিক্ষা পায়। মজার কথা না হয় বাদই দিলাম।
কেননা সব শিল্পেরই একটি ছক আছে। ভবন, সেতু, বিমান, গাড়ি, পোশাক ইত্যাদি তৈরির নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। তাহলে লেখালেখির কেন নিয়ম থাকবে না? অবশ্যই আছে। লেখালেখির নির্দিষ্ট একটি ছক আছে। একটি সার্থক লেখা কখনোই সেই ছকের বাইরে হওয়া উচিত নয়। বিক্ষিপ্ত ভাবনা, বিচ্ছিন্ন চিন্তা নিয়ে লিখতে বসা লেখকের অপরিণত আচরণের নামান্তর।
তাই কোনো লেখা শেষ হলেই সেটি প্রকাশযোগ্য হয়ে ওঠে না। তার জন্য দরকার যথাযথ সম্পাদনা। সেই সম্পাদনার কাজটি খুবই সামান্য নয়। বরং বড় একটি দায়িত্ব পালন করতে হয় সম্পাদককে। তখন লেখকের চেয়েও গতিশীল হতে হয় সম্পাদককে। কারণ তাকে জানতে হবে,
১. শুদ্ধ বানান
২. সঠিক বাক্য গঠন
৩. কাহিনির স্থান-কাল-পাত্রের ঐক্য
৪. লেখার গ্রহণযোগ্যতা
৫. রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য কি না
এসব বিবেচনা করেই একটি লেখা সম্পাদনা করতে হয়। অর্থাৎ নিয়ম-নীতি মেনে সম্পাদকের মনোপুত হলেই লেখাটি প্রকাশযোগ্য হতে পারে।
আমাদের মধ্যে এমনও অনেকে আছেন—একটি গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখেই প্রকাশের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয়বার পড়ে দেখারও প্রয়োজনবোধ করেন না। এককথায় বলতে গেলে রাফ খাতাটিই পাঠিয়ে দেন কুরিয়ারে, মেইলে বা ফেসবুকের ইনবেক্স। তিনি লেখাটিকে মহাভারত-বাইবেল ভাবতেও ভুল করেন না।
কখনো কখনো লেখা পাঠিয়েই অনবরত খোঁজ নিতে থাকেন, প্রকাশ হলো কি না। কিংবা প্রকাশের জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। তখন সম্পাদককেও পড়তে হয় বিব্রতকর অবস্থায়। একটি লেখা প্রকাশের আগে যে বিষয়গুলো খেয়াল করতে হয়:
ক. লেখাটি প্রকাশযোগ্য কি না
খ. দিবস বা উপলক্ষ বিষয়ক কি না
গ. প্রকাশের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু
ঘ. রচনার শিল্পগুণ বিদ্যমান থাকা
ঙ. প্রকাশকের আদর্শবিরোধী লেখা না হওয়া
চ. লেখাটি কতটুকু পাঠযোগ্য
এছাড়া কিছু বিষয়ের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া গেলেই সম্পাদক লেখাটি প্রকাশে উদ্যোগী হবেন। তাই অন্তত লেখককে সংযমী হতে হবে। অধৈর্য হলে চলবে না। অনেক সময় লেখা শেষ হওয়ার পরও লেখককে সংযম পালন করতে হয়। লেখককে আগে ভাবতে হবে:
১. কোন মাধ্যমে তিনি লেখাটি প্রকাশ করবেন (কাগজ, অনলাইন, ভিজ্যুয়াল)
২. লেখাটি কার হাতে সম্পাদিত হবে (সেক্ষেত্রে মাধ্যম মুখ্য নয়)
৩. কোন সময়ে বা প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত হবে।
ফলে লেখক যদি প্রকাশমাধ্যম, সম্পাদক ও সময়ের কথা বিবেচনা করেন; তাহলে কখনোই তাড়াহুড়ো করবেন না।
আমার আজকের হিবিজিবি লেখাও যথাযথ সম্পাদনা ও সংযমের মাধ্যমে একদিন সাহিত্য ভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে। আমি মনে-প্রাণে চাইবো, এভাবেই বাংলা সাহিত্য ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।
তা না হলেও লেখাটি সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ না করে সংযম পালন করা জরুরি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে লিখেই প্রকাশ করার তাড়া থাকতে পারে। তার মানে এই নয় যে, লেখাটি অযথাই সপ্তাহখানেক ফেলে রাখতে হবে। লিখে যদি দু’তিন বার পড়া হয়, নিজেই যদি সম্পাদনা করেন, তাহলে সেটি প্রকাশের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে সংযমের ব্যাপারটি অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে।
তাই কোনো লেখা প্রকাশের পর নিজের আগের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হয়, প্রকাশিত লেখায় কোনো ধরনের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় কি না। আবার প্রকাশক বা সম্পাদককেও লেখকের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই সম্পাদনা বা প্রকাশ করতে হয়। কোনো শব্দ পরিবর্তন করতে গিয়ে লেখকের মূল বক্তব্যই যেন পাল্টে না যায়।
এ কথাও সত্য, যেকোনো লেখাই সম্পাদনা ছাড়া প্রকাশের পক্ষে আমি নই। সব কিছুরই সম্পাদনা জরুরি। পোশাক শিল্পের দিকে তাকালে দেখবেন, একটি পোশাক তৈরি হওয়ার পর সেটি কয়েকটি টেবিল ঘুরে বাজারে আসার সুযোগ পায়। অর্থাৎ ভোক্তার পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনায় রেখেই ‘কোয়ালিটি এনসিওর’ করতে হয়। বিশেষভাবে, যেকোনো পণ্যের জন্য যেমন বিএসটিআই’র অনুমোদন প্রয়োজন, তেমনি লেখা প্রকাশের আগে অবশ্যই সম্পাদনার প্রয়োজন রয়েছে।
আমার মনে হয়, বর্তমানে মানহীন লেখার ছড়াছড়ি। এর কতগুলো কারণ হতে পারে:
১. লেখা প্রকাশের অবাধ সুযোগ
২. সম্পাদনা ছাড়া প্রকাশ
৩. তৈলাক্ত প্রশংসা
৪. স্বার্থযুক্ত প্রকাশনা সংস্থা
৫. মানহীন ওয়েবপোর্টাল বা কাগজ।
ফলে আজ যে কেউ যখন-তখন লেখক হয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের লাইক, কমেন্ট, শেয়ার যাকে-তাকে লেখক তকমা দিয়ে দিচ্ছে। যা ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত। তাই আমাদের সংযমী হওয়া জরুরি। যথাযথ সম্পাদনার মাধ্যমে লেখা প্রকাশ করা উচিত। কেননা আমরা একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। চ্যালেঞ্জটি আমাদেরই মোকাবিলা করতে হবে। তা না হলে পাঠক আমাদের দিকে ঘৃণা ছুড়ে দেবে বা মুখ ফিরিয়ে নেবে।
মনে রাখতে হবে, আমার জন্য লেখার যেমন স্বাধীনতা আছে; ঠিক তেমনই চ্যালেঞ্জও আছে। দু’টোকেই সামলে রাখতে হবে সব সময়। তবেই একজন সার্থক লেখক বা কথাশিল্পী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে পারবো। আমার আজকের হিবিজিবি লেখাও যথাযথ সম্পাদনা ও সংযমের মাধ্যমে একদিন সাহিত্য ভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে। আমি মনে-প্রাণে চাইবো, এভাবেই বাংলা সাহিত্য ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।