লেখক কি হতে পেরেছি? ঠিক কতটা পথ হেঁটে গেলে লেখক হওয়া যায়? কাউকে লেখক বলা যায়? ‘লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়’, লেখক হওয়া কি আত্ম-উপলব্ধি কিংবা এর ঊর্ধ্বে বাদবাকি সাহিত্যানুরাগী ভূগোলের স্বীকৃতি? সেই ভূগোলে বাস করে কত ভাগ মানুষ, কত ভাগ পাঠক তার। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, একজন লেখকের পাঠকের হার কত? তারা কারা?
কৈশোরে উত্তরাধিকার সূত্রে ঘরে পাওয়া যে বইগুলো লেখার স্বপ্ন বুনে দিয়েছে, এর বেশ কয়টি বাবা-মায়ের বিয়েতে উপহার পাওয়া। আর বাকিগুলো, কোনোদিন কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, কার কেনা! কী করে সেগুলো ঘরে যুক্ত হলো আসবাবের মতো! ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ থেকে ‘ম্যাক্সিম গোর্কি’। শরৎচন্দ্র থেকে আশুতোষ। কোন ফাঁকে যে অতীন বন্দোপাধ্যায় আর বিভূতিভূষণ, নীলকণ্ঠ পাখি খুঁজতে খুঁজতে কাশবন পেরিয়ে রেললাইন। এটুকুই কেবল এক বোধনের ভোর হয়ে জাগিয়েছে লেখক হওয়ার ইচ্ছে পাখিদের। আর সেই পাখির ডানা ঝাপটানো ছাড়া কিছু ছিল না, কোনো অনুষঙ্গ, যেমন একটুখানি আকাশ বুক পেতে দেয় উড়ার অবকাশে। না পরিবার, না পরিপ্রেক্ষিত।
লেখক কি আমি হতে পেরেছি-এই এক সমাধানহীন আজন্ম সমীকরণ, সঙ্গে নিয়ে ঘোরা আশ্চর্য কবচকুণ্ডল। চাইলেই উপড়ে ফেলা যায় না। লেখার প্রচণ্ড তাড়নায়, লিখতে না পেরে কতদিন নিজেকে দাঁড় করাই নিজের সামনে! এই ব্যক্তি আটপৌরে আমি এক লেখক আমির মুখোমুখি। কী এই দ্বৈত সত্তার আরাধ্য! মুক্তি নেই যে সামাজিক পারিবারিক পেশাগত দায়িত্ব থেকে, তার চতুর্মুখী চাপেও লেখার যে অপ্রতিরোধ্য তাড়া, নিজেকে বিবর্ণ করে বিদীর্ণ করে, এই এক সৈনিকের সম্মুখযুদ্ধ। অস্ত্র হাতে মৃত্যুর মুখোমুখি।
যুদ্ধ ঘিরে মৃত্যুভয় আছে, আছে জয়ের হাতছানি। এই লেখক হওয়ার বন্ধুর যাত্রায় জয়ের হাতছানিতে মৃত্যুভয়কে আলিঙ্গনের যুদ্ধে কত অপমান, অবহেলা, তাচ্ছিল্য, উপেক্ষা কাঁটার মতো রক্তাক্ত করে এই যাপন, তাও বুঝি এই লেখক হওয়ার যাত্রারও এক অনিবার্য সহযাত্রী। শেষ পর্যন্ত যদি কিছু সৃষ্টি করা যায়, সত্যি সৃষ্টি বলা যায় তাকে, তবে ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর মতো ঈর্ষণীয় আয়ুরেখা দেখবে লোকে, দেখবে না শরশয্যার ক্ষত।
লেখক, হতে চেয়েছি। হয়েছি কি? জন্মদাগের মতো যারে পারিনি এড়াতে, তার দায় মেটাতে লিখি বটে, কিন্তু মোহ নেই কোনো বস্তু কিংবা অবস্তুগত উপার্জনের। অর্জন যদি কিছু হয়, তবে তা ‘মা ফলেষু কদাচন’।
লিখতে লিখতে কতবার মুখোমুখি হই নিজের, কে পড়ে? কয় জন পড়ে? পড়ে না যদি, তবে কেন লিখি? লেখক জীবনের অনির্ণীত এক জটিল অঙ্ক। যে অঙ্কের শুরু আছে, ক্লান্তিহীন করে যাওয়া আছে, কিন্তু উত্তর নেই, সমাধান নেই, শেষ নেই। জনপ্রিয়তার এক নাছোড়বান্দা মোহ ডাকে এই লেখকের কাঙ্ক্ষা, লেখক তারে পারে না এড়াতে। কিন্তু জনপ্রিয়তার এই মোহ ছুঁয়ে যাওয়ার সামর্থ্য কতটাই থাকে কলম, মেধা আর সৃজনের। থাকে কারও কারও অসীম প্রতিভা। সঙ্গে ইচ্ছারও যোগ থাকে যাদের, সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারে উপভোগ করেন খ্যাতি, যশ, অর্থ। জীবদ্দশায়। কেউবা অর্থ নয় বিত্ত নয়, কী এক বোধ জন্ম লয়…এই বোধের জন্মদাগের দায়ে সে লিখে যায় কেবল। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো দুবেলা অন্ন জোটে না, তবু কুসুমের জীবন যন্ত্রণা কালোত্তীর্ণ হয়ে জ্বলজ্বল করে সময়ের পৃষ্ঠায়।
এই যে কালোত্তীর্ণ হওয়া, এরই বা কী ব্যাখ্যা! এরই বা কী সান্ত্বনা! যেমন হুমায়ুন আহমেদ জানান, মৃত্যুর পর তাকে কে পড়লো বা পড়লো না, এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই তার। মাথাব্যথা না দিয়েও কেউ কেবলই জন্মদাগের মতো সৃজনসত্তার দায়ে যা লেখে, তা কালোত্তীর্ণ হয়ে যায়, ব্যক্তি লেখকের ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে।
লেখক কি হয়েছি? কালোত্তীর্ণ কিংবা জনপ্রিয় কোনো পথেই কি হাঁটতে পেরেছি সাধে-আহ্লাদে? কত প্রকাশক বই ছাপেন না! কত সম্পাদক লেখা নিয়ে প্রকাশ করেন না, কত জন পড়েও দেখেন না, কত জন বই কেনেন না। কেউ রিভিউ করেন না।
বর্তমানে লেখক সত্তার স্বীকৃতির কত অনুষঙ্গ আবশ্যিক। কেবল কব্জির জোর যদি বলেন একে, পুরো মিথ্যে বলা হবে। পুরোই। স্বীকার করুন আর না করুন, আপনার পদমর্যাদা, অর্থ, বিত্ত, পারিবারিক কিংবা বংশ পরিচয় সব সবই বিবেচ্য এখানে। বরং এই কব্জির জোরটাই সবচেয়ে কম বিবেচ্য। তবু কেউ তো কব্জির জোরটাও খুঁজে নেন। নেন তো বটেই, নইলে আজ এই লেখক হওয়ার বৃত্তান্ত লিখছি কেন!
লেখক, হতে চেয়েছি। হয়েছি কি? জন্মদাগের মতো যারে পারিনি এড়াতে, তার দায় মেটাতে লিখি বটে, কিন্তু মোহ নেই কোনো বস্তু কিংবা অবস্তুগত উপার্জনের। অর্জন যদি কিছু হয়, তবে তা ‘মা ফলেষু কদাচন’।
আমার রয়েছে কর্ম, রয়েছে বিশ্বলোকের মতো যেকোনো মুহূর্তে এই জন্মদাগের দায় ছেড়ে যেতে পারে যা আমাকে, সামনে দাঁড়াতে পারে আরও কোনো দায়। আমি হয়তো তখন সেই দায় শোধ করবো।