মূলত মানুষের মতো, মন আর শরীর দিয়ে গঠিত বপু একখানি। পরনে অন্তরঙ্গ লুঙ্গিও একখানি। বারেবারে—প্রতি শনিবারে হাটের সীমানায় সিল আর সহিতে নিযুক্ত তিনি। কত কত ধাম, কত ডিহির শ্রান্তে আজি নাম তার জানা হলো—ইমারত আলী।
নানান শ্রমে, ধ্যান আর জ্ঞানে প্রচলিত শিক্ষিত আমি। বাতিলের বাক্সে সমগ্র বন্দি করে, মনোলোভা কবিতা রচি। বাংলার বসন্তে ঘুরে ঘুরে, দূরে দূরে দূর্গের কাহিনী মেলে ধরি। আমি তো লাজুক নহি। লতার শীর্ষে শীর্ষে রত্নের কোলাহল ফুটিয়ে তুলি। সে আমি কবি বলে, মহাজন মোর দিবা-দিবা রাত্রি-রাত্রি দুচোখে আলতার প্রলোভন দেয়।
বলি সেই হেতু, বর্ষাক্রান্ত, জংলি, বানোয়াট, বেঢপ, গোজামিলের মানচিত্রে ঠাঁই করে নেওয়া এই বিচিত্র অঞ্চলে এসে পরিচয় ঘটে। উনি মামাতো ডাকের মতো ভাগ্নেস্বরূপ ইমারত আলী। উনি কালো, মনে হবে ফলস্ আঁকানো ভুরুর ভুক্তভোগী। দাঁতে খাওয়া পান, মুখে ধরা টান—বিড়িতে আসক্ত। এমন, মনে হবে অতি সাধারণ। যেন জংধরা এক দিগভ্রান্ত জাহাজের নাবিক। তবু হায়রে রসুল! তারও আছে পর, আছে কন্যা-পুত্র, বউ মোটে একখানি। বলেছি পূর্বেই সমান্তরাল গলায় প্যাঁচানো মাফলারও একখানি।
__________________________________________________________________________________________________
সে তো কেবলই বলবে তার গল্পই একখানি। আমি শুধু ঠিক আর ভুল, এইটুকু অনুবাদ করে যাব। মনে মনে ঠিকও করি ততখানি। আমরা বসেছি আজ মুখোমুখি। গ্রাম দিয়ে ঢাকা পড়া, গাছ দিয়ে ছায়া পড়া, মেঘ দিয়ে মেঘাচ্ছন্ন চোখ রাখি আঁখিতে তক্ষনি। সমস্ত দিক হতে যা কিছু উদ্ভাসিত সব আসে এঁকেবেঁকে এইগৃহে। ঘরমাত্র একখানি।
__________________________________________________________________________________________________
তার অস্থির আর এলোমেলো ভাষা, তার পারিবারিক বাঁকানো কণ্ঠের উপকথা। আজি এ ঘরোয়া সন্ধ্যায় সাহায্যসমেত ব্যক্ত করিতে চায় নিকটে আমার। আমারে সে বহিষ্কৃত বাতিল সন্দেশে বিড়বিড় করা উপভাষায় নিকটে তার আহ্বানিতে চায়। আমি তো পুরুষ কবি, মনোযোগ দিয়ে যথা—চোখের শুশ্রূষা গড়ে তুলি।
তিনি মানুষ বটে, উঁচু তবে আয়তনে ক্ষীণ। যেন এক তল্লাবাঁশের বাঁশি। ফুটো-ফাটা দিয়ে অজান্তেই হু-হু করে বাতাস হচ্ছে বাহিত। ফলে, সুর আর সারগামে তুমুল হট্টগোল। আমি তারে বলি, রহ তো মামু! কাহিনীর প্রশ্রয় তুলে ধরো। সে হাসে। ভয়ে ভয়ে ভাবনামিশ্রিত হাসি। আমি সাহসের পত্র দিয়ে বলি—ভয় কি! রাখো তো প্রবন্ধ—ইতিহাসের, ণত্ব-বিধানের, পদার্থ আর পরশ্রীকাতরতার। সহজ উপান্তে এসে দাঁড়াও দেখিনি। স্থানে স্থানে উদ্ধৃতি ডিলিট করে, বাহুল্য ভ্যানিশ করে তোমার ভাবনার গোয়ালঘরে ঢোকো তো দেখি!
সে আমার ইমারত আলী। ভাঁজে ভাঁজে সম্পাদিত অজস্র পত্রাবলি। নানান আলোকিত অ্যালবাম দেখি এবারে খুলতে থাকে। আমি আনন্দরে হাজির করে সটান তার বিছানায় শুয়ে পড়ি। আয়েশে, বাতাসে ঘুমের চিন্তা-চেতনা করি। সে তো কেবলই বলবে তার গল্পই একখানি। আমি শুধু ঠিক আর ভুল, এইটুকু অনুবাদ করে যাব। মনে মনে ঠিকও করি ততখানি। আমরা বসেছি আজ মুখোমুখি। গ্রাম দিয়ে ঢাকা পড়া, গাছ দিয়ে ছায়া পড়া, মেঘ দিয়ে মেঘাচ্ছন্ন চোখ রাখি আঁখিতে তক্ষনি। সমস্ত দিক হতে যা কিছু উদ্ভাসিত সব আসে এঁকেবেঁকে এইগৃহে। ঘরমাত্র একখানি।
সে বলে ইমারত আলী। কী করে রচেন গুরু, কী ব্যাখ্যায় সাজান কবিতাখানি! ও আমার শিল্পের মহাজন, ও আমার বিলম্বিত আইডল, ও আমার পশ্চাদ-সম্মুখী, গ্রামীণ বিস্তারে আমারে বোঝান দেখি, সুস্থ মেজাজে যতখানি।
আমি তার ওষ্ঠের আস্ফালনে বিশ্ববীক্ষার অপূর্ব আন্দোলন লক্ষ করি। বলি—ছাড়ো তো ইমারত। তুমি থাকবে হাটের হেঁয়ালি নিয়ে। সিল আর টিলে চুক্তির বন্ধনে আবদ্ধ করবে জনে জনে। রাখবে তাদের সদা জাগ্রত ঠাপে, ধমক আর ঠাসে। কবিতা—এ সঙ্গ তোমার নহে। এ এক জটিল, ধাঁধান্ত, রাত্রির পোট্রেট। বারবার আঁকা আর মুছে ফেলা ভাষার তরঙ্গতরী।
এহেন যুক্তিতে বুঝি তার বীরত্ব ব্যাহত হয়। সে চুপসে যাওয়া পানরত চামারের মতো কাচুমাচু কচুরিপানার নিচে ঠাস করে ডুবে যায়। আর সাথে সাথে সমস্ত আয়োজন ভুশ করে একটানে পাট থেকে জুটমিলে চলে যায়। মন খারাপ করা পরবর্তী বিন্যাসে চেয়ে দেখি সমস্ত গৃহে তার চুল্লিও একখানি।
আমি যত স্বভাবসিদ্ধ সে তত নিরুপায়। আশ্চর্য প্রদীপ হাতে দাঁড়ালো সম্মুখে। কী তার বিনয়, কী তার বিলাপী বাতায়ন, কী তার ভাবের ভজনা, কী তার শিল্পের সহবত— বলে কিনা; ও সাধু, আমারে সরল করে দিয়ে যান। মূল হতে কাণ্ডের সূত্রে রেখে যান। ভাবের বৈঠকে আমারে উপবিষ্ট করে দিয়ে যান। চরণে ঢালি আমি দুগ্ধ— ছাগলের, গাভীর, নয় তো চান যদি মনের মানুষের!
আমি তার সমস্ত কাণ্ড, সমস্ত জ্ঞান যা কিছু হজম করি, করতে করতে, উঠতে উঠতে, সমস্ত চিহ্ন যথা— যতি, জাতির বিতর্কিত ভেদাভেদ ভুলে, অজস্র অক্ষর, বাক্য-বন্ধনী ইরেজ করতে করতে, ফর্মা কমাতে কমাতে পাতার দায়িত্বভার নোয়াতে নোয়াতে একটানে সূচিপত্রে এসে থামি।
________________________________________________________________________________________________
তিনি লাঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে, পালকি বোয়াতে বোয়াতে, রিক্সার প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে, নৌকার দাঁড় বাইতে বাইতে কিভাবে হুট করে কোনো একদিন সকলের অজান্তে আস্ত এক উড়োজাহাজের খোলে করে বড়দের সত্য পৃথিবীর মৌলিক মহাদেশের—আফ্রিকার কোনো এক অচ্ছুৎ, নিম্নগামী, ভারাক্রান্ত, টালমাটাল গোছের কি এক বিদঘুটে দেশের ভ্যাগাবন্ড অঞ্চলে চলে গেছে। কী হেতু! কী হেতু!
________________________________________________________________________________________________
আইন আমার অঙ্গে অঙ্গে বাঁধা। অস্ত্র আমার সুরমা নদীতে ভেজা। বারুদ আমার বাসি আর বাকহারা। কী করি বন্ধু গুণের দয়াল। কাটতে কাটতে শুরু আর প্রচ্ছদে ইমারত আলী লিখে, ফ্রি-হ্যান্ডে লিখি—রৌদ্রবঞ্চিত লোকবটে একখানি! আমি শহর-ভাসানো লোক। হঠাৎ আর হতাশায় ঘুরি বটে গঞ্জে, ঘাটে—রেখে নদীতে নৌকাখানি। গানে গানে আমি দিলের দীক্ষা ছাড়ি। স্মৃতি আর শরবত শ্রদ্ধায় পান করি। চলি আমি শিল্পীর শুচিতায়। প্রকরণভেদে রাখি তব সহপাঠ্যে হাসির হায়েনাখানি।
এভাবেই বহু পরিবার, বহু পরিকল্পনা ভেঙে ভেঙে কখনো বা গড়তে গড়তে চক্রান্তের নেটে এক আজব কাহিনী শুনি, একদা একদিন। ছাপানো প্রচ্ছদেও নায়কান্ত নাম তথা; ইমারত আলী। তিনি লাঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে, পালকি বোয়াতে বোয়াতে, রিক্সার প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে, নৌকার দাঁড় বাইতে বাইতে কিভাবে হুট করে কোনো একদিন সকলের অজান্তে আস্ত এক উড়োজাহাজের খোলে করে বড়দের সত্য পৃথিবীর মৌলিক মহাদেশের—আফ্রিকার কোনো এক অচ্ছুৎ, নিম্নগামী, ভারাক্রান্ত, টালমাটাল গোছের কি এক বিদঘুটে দেশের ভ্যাগাবন্ড অঞ্চলে চলে গেছে। কী হেতু! কী হেতু! না জানে দেশের, বংশের, ভাগের কোনজনে। আজব মশকরা বটে একখানি!
তো যাক সে জনা। এই স্পেসের যে কোন অবস্থানে যেতে পারে যে কোন কণা। আলীর জন্যও তাহা প্রযোজ্য বটে। আলী যেতেই পারে। পারার চিন্তায়, পারার পরিচয়ে ইমারত ১০০ তে একশই পায় বটে। হে আমার গুরুচণ্ডাল, হে আমার শিশু আর সাবিত্রীগণ। দেখি স্বেচ্ছাসেবকের মতো সব কিছু ঠিকই আছে। ঠিক থাকা সকলের তরে অতি দরকারি। আলী টু সর্বসাধারণ্যে।
বলি বটে আমরা—সময়ই সব কিছু ঠিক করে দেয়, মূলত সময় ভুলও করে দেয় কিছু কিছু ঘটনার ঘন নিঃশ্বাসে। এ কি আজব কাণ্ড! লিখেছে আলী—ধুলোমাখা ধূসর এক চিঠিতে, সংখ্যার সন্তানে শত শত কবিতার করুণ কাহিনিচিত্রে। সাথে সে-দেশের, জাতির জনব্যথা। তাদের আহার, বাহার, বিকৃত বিধিসঙ্গে। উটে উটে ছয়লাভ, জিরাফে জাগ্রত সেইদেশ, ঐ ভূমি নারী ও নৃত্যবিহীন। রঙ ও রকমহীন। সেথা অখণ্ড অনুষদ আর অনুষঙ্গ। তারা স্কেচের পর স্কেচ হয়ে পড়ে আছে এলোমেলো। ভক্তি ভাবনাহীন।
নেই সেথা কোন গর্ব। নেই কোনো গুজবের আস্ফালন। পরিচয়হীন, প্রশ্নবিহীন এত এত ধূলির গভীরে দিবারাত্রী ফুটে থাকে কেবলই আলীর চিহ্ন-পদ একখানি।
ভুলেছে সে পূর্ব কাহিনীচিত্র। দেশ, নদী, মাঠ মন আর মৃত্তিকা। ভুলেছে ঘ্রাণ, পদ উপপদ, আঁচল ও অঞ্চল।
ভাবি—এতকিছু ভুল মেরে যায়, অথচ আমারে ভোলেনি কেন আলী? ওহে ইমারত! উচ্চাবচ আলী! আবশেষে ফের তার ধাওয়া করা বাসনার বুলি, শুচিবায়ুগ্রস্তের ন্যায় শুদ্ধবাদী; ও সাধু আমারে কবি করে দিন! দিক হতে দিগন্তে, সাল হতে শতাব্দীতে আমারে রটায়ে দিন। আমি বাঁচি সুধীর পরিচয়ে, শিল্পের অ্যালবামে আমারে বন্দি করে দিন।
বুঝি অনুতাপ জাগে মনে, গোধূলির ন্যায় কুণ্ঠিত হয়ে আসে মন, নন্দনের ক্ষুধায়, বাড়ে বড়ই বাতেলাময়। এ বড়ই চঞ্চল, ঝানু আর ঝঞ্ঝার ঝক্কি। কী করি, কী করি! উপায়ে স্পর্শে রাখি হাত। ভাবি কবিতার বই ছেড়ে কবিতার পোস্টারে ছেপে ছেপে ছেয়ে দেই ইঞ্চি-ইঞ্চি বারোমাস— সমগ্র দেশখানি।
ভাবি আর কাটি, কাটি আর মিশে দেই ভাবনার দূরাভাষ। আর ঠিক তখনি মগজে বুদ্ধির চাঁদ ভেসে ওঠে। চেপে বসে জোসনার কানাকানি। আরে আরে! এতসব অদলবদল, এত ইউরোপ আমেরিকা খুঁজছি কেন ভায়া! এতসব অদরকারি। দরকার—সামান্য তো একটি তার কবিতাখানি।
বাতাসে বেগ এলে যন্ত্রণাও বেড়ে ওঠে বহুগুণ। বহু বহু ক্ষুব্ধ ঝড় আছড়ে পড়ে, এপারে-ওপারে। মনে মনে অহেতুক নিজস্ব সংসারে।
অবশেষে একটি কবিতা বন্ধুত্বের পরশ দিয়ে একদা রাত্রিতে চুপি চুপি, ভয়ে আলগোছে সার আর সস্নেহে পুঁতে দেই আলীর দোআঁশি মাটিতে তক্ষুনি। সময় আর সাহস তাহা ধরে আমার ব্যক্তিগত পুটলিতে রাখি বেঁধে। এরপর কেবলি অপেক্ষা— বড়ই আলোচিত এক গুণ্ডাভাষ্য, অশ্লীল আর অধার্মিকও বটে কখনো-সখনো। তবু আমি আলীর রহমত কামনায় তারে এ ব্যক্তিগত প্রবন্ধে তত্ত্বকথার বন্যায় ভেসে রাখি। মৃদুমন্দ স্রোতও পাঠাই শীতালি কিংবা চৈতালি।
________________________________________________________________________________________________
আর এভাবেই লিখিত ইমারত আলীর শুদ্ধ কবিতা বীজের থেকে ফুলে-ফেঁপে ওঠা আজ এই যুবতী বৃক্ষখানি। কত কত জীবের প্রেরণায়, কত নিউজ আর ন্যাশনাল জটিলতায়, কত ভয় আর প্রতিবাদ—আলেখ্যবৃক্ষটিকে ঘিরে। নানান রঙ-রেখার অপূর্ব বিন্যাসে ঘুম ভাঙা নদীর কিনারে ব্যাক্তিগত বিচারে রূপ আর গুণের গানে গানে অবশেষে ধরা দেয় ফুলান্তে ফলের শব্দবিচারী-রূপে।
_________________________________________________________________________________________________
ফলে, একদা প্রফুল্ল প্রভাতে ঘুষের চোরাবালি ভেদ করে জেগে ওঠে কন্যা আমার প্রসঙ্গে ক্যারিশম্যাটিক রাজপ্রসাদের অবয়ব অনুসঙ্গে। আমার ধারণা, আমার সংবেদনকে ধাক্কা দিয়ে সামান্য দু’একদিনেই সেই কবিতা বৃক্ষখানি বেড়ে ওঠে তরতর করে, চমকপ্রদ গ্রাম্য ইতিহাসে। আশ্চর্যের আবিষ্কার বটে একখানি।
এমন আত্মঘাতী নিসর্গে, এমন এতিম গ্রাম্যকারাগারে জঙ্গলে জর্জরিত বেহুদা বামন সব অধিবাসী—দেখি কেমন নন্দনদৃষ্টিতে চেয়ে আছে অচেনা সাতভাই চম্পার মতো ফুটে থাকা আজব এক সংখ্যালঘুর পানে; ঠিক যেন গ্রহণ-বর্জনের দ্বান্দ্বিক ধারণাই একখানি।
জগতের সকল রহস্যেই থাকে অতীব রসিকতা, মানি। ফলে, আমার নিত্যদিন গাছের পাছে পাছে পন্থ বাহিত হয়। সে দীর্ঘময়, সে আঁকাবাঁকা, সে উদাসী ভীরু আর লাজুক বালিকার ন্যায় উর্বশী। আর এভাবেই কবিতা-বৃক্ষের সমগ্র সংসারে নিজেরে প্রোথিত করি।
ভাষ্যে-ভাষ্যে দিনে-দিনে—মাস, মাসের মৈত্রীতে বছর গেঁথে রাখি। আর এভাবেই লিখিত ইমারত আলীর শুদ্ধ কবিতা বীজের থেকে ফুলে-ফেঁপে ওঠা আজ এই যুবতী বৃক্ষখানি। কত কত জীবের প্রেরণায়, কত নিউজ আর ন্যাশনাল জটিলতায়, কত ভয় আর প্রতিবাদ—আলেখ্যবৃক্ষটিকে ঘিরে। নানান রঙ-রেখার অপূর্ব বিন্যাসে ঘুম ভাঙা নদীর কিনারে ব্যাক্তিগত বিচারে রূপ আর গুণের গানে গানে অবশেষে ধরা দেয় ফুলান্তে ফলের শব্দবিচারী-রূপে।
ফল—প্রকৃত ফলের আকারে আসে, এতে কিছুটা সময় বিনষ্ট হয় বটে। তারা বাড়ে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে, আর এভাবেই আচমকা এক অমবস্যায় পরিচিত অন্ধকারেও চেয়ে দেখি এ-ফোর সাইজের পাতলা পাতলা সাদা-কালো ফল-এ ছেয়ে গেছে সমস্ত বৃক্ষের হাজারো কাণ্ডখানি। কী সব রসান্ত, ভৈরবী দীপ্তিতে চেয়ে দেখি পাতার ন্যায় নানান বিভঙ্গে ঝুলে আছে ইমারত আলীর আলাদা আলাদা বিচিত্রসব কবিতার মহাধ্বনি। তারা কেমন টাটকা আর তরুণ। যেন এইমাত্র প্রকাশিত কালি ও কাগজের গন্ধে মাতোয়ারা একান্ত উক্ত এলাকাখানি।
ডালে ডালে কবিতা ঝুলে আছে। এ খবর রটে যায় গ্রামকে কেন্দ্র করে শহরে। শহরেই থাকে আগুনের আমদানি-রপ্তানি। সে পাঠায় বিভাগে, বন্দরে, সে চালায় দেশ আর প্রদেশে, নানান ভাষ্যে, সরল জটিল সব গোত্রে, গোষ্ঠীর উপ-অঞ্চলে খবর ছোটে বটে—স্রোতের শর্করাতে ভর করে। বাতাসের ব্যস্ত ইথারে, ঘ্রাণে, সুরে, সারিবদ্ধ সিরিয়ালে, কখনো কখনো গুপ্ত ইশারা-ইঙ্গিতে। আর এভাবেই ইমারত আলীও একসময় জেনে যায় আনন্দের বার্তাখানি।
যেমন সব গ্রামেই থেকে থাকে বখাটে বিচ্ছু-বালক কিছুখানি। তারা দলে দলে, বাটুল-হাতে বৃক্ষের নিকটে আসে প্রভূত ভয়ে। মৃদুমন্দ পায়ে, আর আমারে জিগায়—সাধু এ কাহাতক ফল? কেমন গভীর আর জ্ঞানী। কেমন রাগী আর পরিশ্রমী।
আমি নানান ব্যাখ্যায় তাদের বিস্তারিত খুলে বলি। তারা দর্শনে, শ্রবণে সবকিছু জেনে কেমন ভালসুন মেরে যায়। তারা হায় হায় করে ওঠে। বলে, একি কাণ্ড সাধু! এ তো আমাদের আলী জ্যাঠার কাব্যময় কবিতার খনি।
গল্পের এমত বর্ষাকালে সবকিছু ঠিকঠাক রেখে চলে আসি আমি। আমার নানান অংক, নানান সিদ্ধ করা। কোথাও পুড়িয়ে, কোথাও বা ভেজে কিংবা ঝলসে ঝলসে খাওয়া। স্থান হতে স্থানান্তরে, পর্দা হতে বাস্তবে তীব্র হতে তীক্ষ্মের প্রতি ছুটে চলা।
এভাবেই যুগ হতে যুগান্তে ভেসে যাব। পথে পথে ঘটবে নানান দুর্ঘটনা। বিচিত্র সংশয় আর সংকটে কেটে যাবে দিনগুলি মোর রাতগুলি সন্ধানী।
আমি প্রকাশ্যে দেখতে পাচ্ছি, ইমারত আলীর ফলন্ত ফুটফুটে কবিতা বৃক্ষখানি। কাঁচা কাঁচা কবিতা সকল একদা পেকে-পেকে পোক্ত হবে। রসে রসে রসাচ্ছিন্নও হবে কোনো একদিন। আর তখনি চৈত্রের চাহনি এসে লাগবে তার দেহে। তার সহজাত হুমকিতে মাতাল করা হামলাতে অসহায় নাবিকের ন্যায় হাল ছেড়ে ঝড়ের মর্জিতে ছেড়ে দেবে তার নিজস্ব প্রাণখানি।
আর এভাবেই আভাসিত পটভূমিকায় একে একে ঝুড়-ঝুড় করে ঝরে পড়বে সকল কবিতাগুলি। তারা নিজস্ব নিয়তিতে গোত্র-পরিবার বিচ্ছিন্ন ভাইবোনের ন্যায় যে যার ক্ষমতা আর দৃষ্টির অনুশাসনে দিগি¦দিক চলে যাবে। যারা খুবই সহজ সরল তারা হয় তো আলীর নিকটবর্তী অন্য কোনো গ্রামেই ঠাঁই করে নেবে। গড়ে তুলবে নতুন বীজ হতে নিত্য নতুন সফল কবিতা-কলোনিখানি।
আর এভাবেই অঞ্চল পেরিয়ে বৈচিত্র্যের হাতছানি পেয়ে কেউবা চলে যাবে পাহাড়ে, ভাসুবিহারে, নদী-নদ-সমুদ্রের যৌথ কিনারে। কেউ কেউ ধরাও পড়বে ভিনদেশি তদ্রূপ বিচ্ছুবাহিনীর হাতে। তারা শিশুর সারল্যে কাগজের প্লেনরূপে ঠেলে দেবে স্থান হতে স্থানান্তরে। কেউবা চলে যাবে বিস্কুট-বাদামের ঠোঙায় রূপান্তরিত হয়ে। দূর কোন অনাকাঙ্ক্ষিত দেশে।
মরবে না, অবহেলায় ফেলে দেবে যে জন সেও জানবে না, কেবল সামান্য জল আর মাটির স্পর্শেই সেখানেও জানান দেবে ইমারতের নতুন বৃক্ষখানি। হয় তো দেশের প্রয়োজনে, ভাষা আর ভৌগোলিকতার আচরণে কিছুটা ভিন্ন হবে সেইসব ফলন্ত কবিতাগুলি। এ তো হতেই পারে। সম্ভবকে সহনীয় করাই হলো শ্রেষ্ঠ গুণাবলী। আর এ-গুণে কেউ কেউ হারাবে অতলে, গহীন গহ্বরে। খুচরা-খাচরা টিস্যুতে ডাইভার্ট হয়ে।
________________________________________________________________________________________________
পাঠোদ্ধারে যতটা বুঝি ইমারতকে লিখতে হয় না আর। কাজেই সারাদিন ঘুম আর স্বপ্নের মনোটনি। এই তো ঘুমিয়ে আছে এখন। কেমন অন্ধকার ছায়ার সৃজনে। অনিবার্য সব কবিতার উপড়ে কাত হয়ে স্বপ্নেই হাসছে মিটিমিটি।
_______________________________________________________________________________________________
আর এভাবেই জীবিত সকল জাতির, সকল ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে—প্রান্তে, সমতলে, উচ্চে, অবতলে, বন্যা-বৃষ্টিতে, বাড়ির আনাচে কানাচে, হুটহাট গজিয়ে উঠবে কেবলি ইমারত আলী। নতুন বৃক্ষের নতুন পল্লবে ঝলসে উঠবে সমগ্র মহামানব জাতি। এমন কাণ্ডে রেগেও যাবে কেউ কেউ। এত এত ইমারত বৃক্ষের দায়ে সারা পৃথিবীটাই হয়তো ছেয়ে যাবে অদ্ভুত এক কবিতার আবরণে। হয়তো কোনো আলোই আর আসবে না আমাদের এই গ্রহে। ফলে, কাটাও পড়বে তারা কিছু কিছু সরকারি তদন্ত সাপেক্ষে।
কেবল একজন—সেই যে ভুল করে পাসপোর্ট হারিয়ে অবৈধ আফ্রিকাবাসী। কোথায় কোন জংলি-জানোয়ারের সঙ্গে করছে বসবাসখানি। সে আমাদের ইমারত আলী। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি—অমন অনুর্বর, ভসকা ভূমিতেও কেমন ঠাঁই করে নিয়েছে এইসব চালাক কবিতা-বৃক্ষপ্রাণী। আর তার কারিগরকে পেয়ে তারা যারপরনাই আপ্লুত। আবেগী অহঙ্কারে তারা ঘনঘন প্রজন্মের সন্তানে ছেয়ে ফেলছে তাকে। তবু নেই কোন উত্তাপ, নেই প্রেরণা কিংবা বকুনি। নেই হা-হুতাস, নেই গ্লানি।
আজকাল মাঝে মাঝে অবাঞ্ছিত মেইল আসে, অদ্ভুত অক্ষরে, স্বাক্ষরে। পাঠোদ্ধারে যতটা বুঝি ইমারতকে লিখতে হয় না আর। কাজেই সারাদিন ঘুম আর স্বপ্নের মনোটনি। এই তো ঘুমিয়ে আছে এখন। কেমন অন্ধকার ছায়ার সৃজনে। অনিবার্য সব কবিতার উপড়ে কাত হয়ে স্বপ্নেই হাসছে মিটিমিটি। মাত্র একটি কবিতা লিখেই— আজব কবিতাখানি। ওই তো দাড়িতে তার ঝলমল করছে নিত্য নতুন রবীন্দ্রনাথের বাণী। অপরূপ কেশে নজরুলের হুঙ্কার লেগে আছে। গাত্র-বর্ণে ফুটে আছে বনলতা সেন হয়ে জীবনানন্দের চরিত্রখানি!