বগা, ছিদাম, সুদর্শন আর যুধিষ্ঠির রাজীব নূর রচিত ‘দ্রৌপদী ও তার প্রেমিকেরা’ গল্পের চরিত্র। গল্পের নায়িকা দ্রৌপদীর চার নায়ক। পেশায় তারা চোর! জাতে তারা মুচি। সাত পৃষ্ঠার গল্প পড়তেই দুঘণ্টা সময় শেষ! গল্পটি দাবি করে গভীর মনোযোগ ও নিবিড় পাঠ। আগে কথাশিল্পী রাজীব নূরের দু-একটি ছড়ানো ছিটানো গল্প পড়েছি এখানে-ওখানে। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দ্রৌপদী ও তার প্রেমিকেরা’ পেয়ে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু পরের লাইন পড়তে পড়তে প্রথম লাইন যেন ভুলে গেছি। আবার প্রথম লাইন পড়ি। এভাবে খানিকটা পড়ার পর আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হলো। আবিষ্কার করার চেষ্টা করলাম, কেন এমন হচ্ছে?
পরখ করে দেখলাম, প্রতিটি বাক্যে তার কত ধরনের কাজ। বাক্যের শেষে ক্রিয়া পদের ব্যবহার, প্রতিটি বাক্যে অসাধারণ সব অলংকারী শব্দের আসন, একই শব্দের একাধিক বিশেষণ। বাক্যের পরতে পরতে কাব্যের সুর সংযোজনে এক অপার মুন্সিয়ানা। অবাক হয়ে গল্প পড়া বাদ দিয়ে তার জন্মসাল এবং বই প্রকাশের তথ্য জানতে আগ্রহী হলাম। জানলাম, তার জন্ম ১৯৬৯ সালে। আর বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে। অর্থাৎ ত্রিশের আগে গল্পটি প্রকাশিত হয়। সে বছরের বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের প্রকাশনা এটি। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ূম চৌধুরী। বইটিতে দশটি গল্প রয়েছে। আমি পড়েছি দু-চারটি।
এখন ঘুরে আসি গল্পের জগতে। মূলত ‘দ্রৌপদী’ বলতে আমাদের সামনে পঞ্চপা-বের সেই নায়িকার কথা মনে পড়ে। কিন্তু গল্পের নায়িকা কি আসলেই সেই দেবী? সেটা জানার জন্যই আমাদের মূল গল্পের ভেতরে ভ্রমণ করে আসতে হবে। প্রশ্ন হতে পারে, তার নায়ক কতজন? এখানে দ্রৌপদীর নায়ক চার জন। বগা, যুধিষ্ঠির, সুদর্শন আর ছিদাম। এরা চার জনই নিম্নবর্ণের। এখানে কথাশিল্পী নায়কদের এবং নায়িকার সংলাপ আঞ্চলিক ভাষায় রচনা করেছেন দক্ষ হাতে।
প্রথমে পাঠক নাটকের দৃশ্যের মতো দেখতে পাবেন, নায়করা একটা খোলা মাঠের মধ্যে শীতের রাতে নাড়ার আগুনে হাত-পা ছেঁকছে। আগুনের ছায়ায় তাদের মুখ ও পাশের গ্রামের ঘর-বাড়িগুলো ছবির মতো দেখাচ্ছে। সেখানে তাদের আলাপ হচ্ছে গ্রামীণ ভাষায়। কতো চমৎকার আর দরদ দিয়ে কথাকার তাদের অগোছালো আর নোংরা কথাগুলো ধৈর্যের সুঁই দিয়ে গেঁথে দিয়েছেন। গল্পের নায়করা গল্প করছে চাঁদের আলোয় তাদের ছায়া নিয়ে। ছায়ার মতো মানুষও লম্বা হলো না কেন? এটা শুনে আরেকজন ভাবে, দুপুরের রোদে ছায়া তো খাটো বা বেঁটেও হয়! এসব দার্শনিক কথা-বার্তা তাদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমার বর্ণনা দেখলে বোঝা যায়, কথাশিল্পী তার গল্পের বুননে কতটা আন্তরিক!
তারপর তাদের গাঁজা, তাড়ি নিয়ে কথা-বার্তা ও খাওয়ার পর নানা ধরনের মাতলামি কতোটা মসৃণভাবে বর্ণনা করেছেন, তা পাঠ না করলে বোঝানো অত্যন্ত কষ্টকর। বগা এখানে জুতা পালিশের কাজ করে। যুধিষ্ঠিরের মধ্যে ঈশ্বর ভাবনা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ¦ কাজ করে। এখানে মুচি সম্প্রদায়ের জীবনের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। বলেছেন, ‘তাদের জীবন-যাপনও স্বতন্ত্র। এখানে ভালোবাসাবাসি সহজ পথ ধরে যায় না।’ মরা মানুষ নিয়ে ছিদামের বয়স বাড়ার হিসেবে ওরা হেসে ওঠে। কেউ একজন বলে ওঠে, ‘বগা মানু মরলে শেষ। হ্যার আর বয়েস বাড়ে না’। মানুষ মরলে ‘তারা’ হয়ে যায়, এ কথা শুনে সুদর্শন আর স্থির থাকতে পারে না। কারণ ‘তারা’ নামের একটা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়। কিন্তু দুদিন আগেই সে ফেঁসে যায়। ছয় মাসের জেল হয় সুদর্শনের। ব্যাস কেল্লা ফতে। আর বিয়ে করা হয়নি। লগ্ন আর আসেনি তার জীবনে। তাদের বাবারাও মারা যায় ছোটবেলায়। যুধিষ্ঠির শহরে থাকে। একটা জুতার কারখানা আছে তার। কিছুদিন হলো সে তাদের সাথে জুটেছে। পকেটে তার একশ’ টাকার কড়কড়ে নোট থাকে। ঘরে আছে বউ। কিন্তু বউ তাকে পাত্তা দেয় না। তার অভিযোগ, শহরে তার আরেকটা বউ আছে। তাতে তার মন খারাপ। বগা তাই প্রশ্ন করে, ‘যে মানুষটার পকেটে শ টাকার নোট থাকে তার কষ্টটা কোথায়?’ এসব জীবন বোধ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টির আয়নায় দেখান তিনি।
সুদর্শন আর ছিদামের চুরি করে তাড়াতাড়ি ফিরে আসা নিয়ে ঘটে আরেক কাণ্ড। মাদবরের ঘরে সিঁধ কাটার পর দুটি নগ্ন শরীরের ক্রিয়া দেখছে। তখন তারা গালি দেয়, ‘চুতমারানি হেডা দেওনের আর টাইম পাইল না।’ এমনকি মাদবরের বউয়ের দুধের আয়তন নিয়ে বগার সাথে বাধে তর্ক। ‘মাগীর দুধ দুইটা য্যান লাউ’। এরপর পাঠক কৃষ্ণার আগমন দেখতে পান। কৃষ্ণা তখন ভাতের গাজন দিয়ে মদ তৈরি করছিল। তার চেহারা ও শরীরের কাঠামো আঁটসাঁট। বুক থেকে শাড়ির আঁচল খসে পড়ে। তখন তারা নড়েচড়ে বসে। তাকে মিছেমিছি ‘জামাই-বউ’ খেলার প্রস্তাব করে। কৃষ্ণা বলে, ‘আমি তাড়ির ব্যবসা করি, গতরের না’। এখানে নারীর সততার একটা দৃষ্টান্ত গড়ে তোলেন লেখক। কৃষ্ণাকে ঘিরে তাদের গল্পের শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে। এমনকি দাউদাউ করে আগুন যখন জ্বলে; তখন তাদের ভেতরেও যৌনতার আগুন জ্বলে ওঠে। কৃষ্ণার স্বামী অর্জুন তাকে দুই সপ্তাহর স্মৃতি দিয়ে কোথায় চলে যায়, আর ফিরে আসেনি। এই স্মৃতি তাকে কাতর করে। সে গাঢ় কণ্ঠে কখন যেন যুধিষ্ঠিরকে বলে বসে, ‘তোমরা সবাই আমার জামাই। তুমি আমার বড় জামাই। আমারে এট্টু আদর কর না’। যুধিষ্ঠিরের ভেতরের বসতবাড়ির বাঘটা খাঁচা ভাঙে। কৃষ্ণার শাড়ি খুলে পড়ে হ্যাঁচকা টানে, ব্লাউজের বোতাম ছিঁড়ে যায়। কৃষ্ণা এখন দেবী-দ্রৌপদী। শরীরে তার যুধিষ্ঠির এবং অপেক্ষমান পাণ্ডবত্রয়।
গল্পে আমরা অভাবে স্বভাব নষ্টের বাস্তব চিত্র দেখি। দেখি চরিত্র হননের তাণ্ডব। নারী-পুরুষের শারীরিক অবদমন। কারো পকেটে অর্থ থাকলেও কষ্টে কাঁদে। আবার যার টাকা নেই, সে ভাবে সে-ই সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি। জীবন আর যাপনের মধ্যে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দর্শন লুকিয়ে আছে কথাশিল্পী তা দেখিয়েছেন অসাধারণ বাকভঙ্গিমায়।