সংবাদ মাধ্যমে খবর এলো সৈয়দ শামসুল হক আর নেই। এর অর্থ দেহ ও আত্মা পর জগতের হয়ে গেল, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীলতা রয়ে গেল দুই জগতেরই। তাঁকে গতদিন দেখতে যাই ইউনাইটেড হাসপাতালে; তাঁর বর্তমান অবস্থা ও সৃষ্টিকর্মের আলোচনায় ভরা ‘পাতাদের সংসার’ কাগজের নতুন সংখ্যাটি দেওয়া যাবে হাতে এই প্রত্যয়ও ছিল ভেতরে । গুলশানে নামতেই ছোট ছোট বৃষ্টি পড়তে থাকে, আরেকটু আগাতেই বড় বড় বৃষ্টির ফোটা। বৃষ্টির পর বৃষ্টি, থামার নাম নেই; কিন্তু আমার থামলে চলবে না, বাংলাদেশের সাহিত্যের রাজপুত্র সৈয়দ শামসুল হককে না দেখে কেমন করে ফিরি?
সাতচল্লিশের দেশভাগের পর বাংলাদেশের সাহিত্যের যাত্রাপথের একটু পর থেকেই রাজপুত্রের মতো শাসন করেই চলছিলেন সৈয়দ হক। বাংলাদেশের সাহিত্যের শুরুর চূড়া, বিস্তার, বিস্তারের পর বিস্তার—এই রাজপুত্রের হাতে। যুগের পর যুগ কলম দ্বারা শাসন করেছেন প্রাপ্ত-অপ্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের। ক্লান্তি নেই, লিখেছেন তো লিখেছেন-ই রক্ষণ, সংরক্ষণের দিনলিপি। এদেশের সাহিত্যের ইতিহাস ঋদ্ধ তাঁর লেখার ফসলে, কলমের শাসনে। কোনো যুগেই তিনি ব্যর্থ শাসক নন, পাঠক তৃপ্ত নন তাঁর লেখা পড়ে এমন কমই শোনা গেছে। মঞ্চ, চলচিত্র, মানুষের মুখে মুখে, কাগজের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় হক কীর্তন। কীর্তি ছিল বলেই এই কীর্তন সম্ভব হয়েছে।
বলা হয়েছিল পাঁচটার পর ভিজিটরদের দেখার অনুমতি আছে, আমি সেই সময়েই পৌঁছাই, কিন্তু দেখা হয় নাই আর রাজপুত্রের সঙ্গে। তখন তিনি সেন্সলেস, চিকিৎসক জানালেন যে কোনো মুহূর্তে চলে যেতে পারেন। ব্যথা পাই, দারুণ এক ব্যথা, যে ব্যথাটার চূড়ান্ত ধাক্কাটা পাই আজ সন্ধ্যায় তাঁর মৃত্যুসংবাদ জেনে। পাঠক সমাবেশে বই দেখছিলাম, রাজপুত্রের চলে যাওয়া অবশ করে দিলো শরীর-মন।
আসলেই কি তিনি চলে গেলেন তল্পি-তল্পাসহ, না, তা নয়; তাঁর দেহগত অনুপস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তিনি দুই হাতে যা লিখে গেলেন, তা কি যাওয়ার? যাওয়ার নয়। বাংলাদেশের সাহিত্য যতদিন থাকবে, আলোচিত হবে ততদিন সৈয়দ হকের নাম পাঠক স্মরণ করবেই, করতে হবে।
এই রাজপুত্র রেখে গেছেন অসংখ্য সন্তান, যারা হক প্রভাবিত নিজস্ব ধরন তৈরি করেছেন। শহীদুল জহিরকে বলা হয় কথাসাহিত্যের ম্যাকার, আপডেট ভার্সন, তিনিও হকের গদ্য স্টাইল দ্বারা প্রভাবিত, বাক্য গঠনে হকের ছায়া লক্ষণীয়, কিন্তু নিজস্বতায় বিশ্বাসী জহির। এমন অনেক সন্তান আছেন, যারা হকীয় স্পর্শে আছেন, তারাও রেখে যাবেন সন্তান, সেখান থেকে আরো সন্তানের জন্ম। তারা সিাহিত্যের সিংহাসনে আসবে, কিন্তু বংশ পরম্পরায় সৈয়দ হকের ঋণ স্বীকার করে শাসন করবে সাহিত্য। শেষ পর্যন্ত সেই সিংহাসন তো সৈয়দ হকের-ই। তিনি থাকবেন পরানের গহীন ভেতর। রাজসভায় অসময়ে উচ্চারিত হবে বলিষ্ঠ স্বরে পূর্ব পুরুষের সৃষ্ট বাণী ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই।’