টুকরো-টুকরো কিছু ঘটনার মধ্যে কবিতা অধ্যুষিত আমার জীবন ধরার চেষ্টা করছি, এ-ও কি আপাত এক বিরোধী ব্যাপার নয়? কেননা, আমরা তো প্রতিনিয়তই ভয়ঙ্কর দারিদ্র্যকে লুকোচ্ছি জীবনের পরাবাস্তবতায়। কারণ, কবিতা ব্যাপারটাই তো রহস্যের গালিচায় কল্পনার বিস্তার মাত্র। আবার, এর চেয়েও বেশি কিছু! বলতে অসুবিধা কী?
কেবল যে লেখার মধ্যে সেই দুর্বোধ্যতার সাধনা আছে, তাই কবিতা ! মানে কাব্যতান্ত্রিক ঋষ্যশৃঙ্গের মতো। কখনো সময়ের প্রতিভূ! কখনো শুধুই যৌনতা, ভাল্গার ভয়াবহতা—নতুন পরিপ্রেক্ষিত আবার সাংঘাতিক নিষ্ঠুরতা! গোপন এ সবের প্রভাবও বলা যেতে পারে।
বিষয়টি কবিতার জন্য কেবল পলিটিক্যালি—ইডিওলজিক্যালি নয়। কিছু একটা সাধারণ মানবিকতার ব্যাপার। মহান ব্যতিক্রমও হয়ে থাকে। তাই, কবির চ্যালেঞ্জ হবে, সে প্রকৃতির সমস্ত কাঠামো অস্বীকার করে, উঁচুনিচু পাহাড় পেরিয়ে—তবেই সে তার লেখাটি লিখবে। আবার কেউ-কেউ হয়তো কবিতার জন্য জীবনের নানা ঘটনার সঙ্গে মিশে যান। মিশে বেড়ান, নদী-অরণ্য উন্মুক্ত প্রান্তরে—খোলা আকাশের আলো-বাতাসে।
কখনো মানুষ-পাখি-পতঙ্গ-ফুল আর ফুলের মাতাল গন্ধ থেকেও কবিতা খুঁজে পায় কবিরা। ফলে প্রত্যেক কবির একেক রকম ক্যারেক্টার থেকেই। কবি তার নিজের কাঠামোটা তৈরি করে। অবশ্য ফর্মের নিজস্বতায় কেউ যদি নিয়ম ভেঙে নতুন কোনও সম্ভাবনার অধিকার দেখাতে পারে, তবেই তো সেই নিয়ম ভাঙার মায়া-বিভ্রম, আলো-ছায়ার পক্ষপাতিত্বেই ফুটে ওঠে সেই কবির— অমৃত অহঙ্কার! ফলে কারও-কারও কবিতায় প্রথা—প্রচলিত ধারণার বিপরীতে কোনো বাঁক! কোনো অনির্ণেয় পরিবর্তন! কোনোও উদ্ভাসের স্বপ্নও তৈরি হয়। তবু, অপ্রকৃতিস্থ হয়ে কবিতা লেখায় উন্মত্ত হন কেউ-কেউ। এতে হয়তো নেশাগ্রস্ত কবিতার অগভীরতা যতটা থাকে, ততটা গভীরতার বিস্তার—অভিজ্ঞতার সহায়ক কিছুই থাকে না।
আবার কেউ তো সরল-পরিপাটি-শৃঙ্খলিত সাধনায় তার নিজের লেখার সময়-সংযোগ ও পরিবেশের স্পেস খুঁজে নেন। তাই কে, কখন, কিভাবে নিজের লেখার অলৌকিকতা পেয়ে যান, সে সন্ধানই ব্যাপক দর্শনের বিষয়। এ ছাড়া, রয়েছে, কবিতায় ইমেজের প্রসঙ্গ। বিষয়টি এত গভীর ও অর্থবহ এই কারণে যে, পাউন্ডের যে সংজ্ঞাটিতে ‘ইমোশনাল কমপ্লেক্স’ বলে যে বিশ্লেষণ রয়েছে। বর্তমানের কবিতায় কিন্তু ‘ইনটেকচুয়াল’ বিষয়টিও সমান গুরুত্বে উপস্থিত। কেননা, কবিতা প্রায়ই আবেগ-সৃষ্ট হলেও এক্ষেত্রে মননের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়।অবশ্য এ প্রসঙ্গে কবি রনজিৎ দাশ যথার্থই বলেছেন, ‘‘প্রথমত, মানুষের মস্তিষ্কে, আবেগ এবং মনন দুটি মিউচুয়ালি এক্সক্লসিভ প্রক্রিয়া নয়। আবেগ ও মননের মিশ্র প্রবাহই মানুষের চেতনাস্রোতে। বিভিন্ন ‘ব্রেন সারকিট’-এর মধ্যে অবিশ্রাম ‘ক্রস টকিং’-এর মাধ্যমে আমাদের চেতনার উদ্ভব হয়। আসল প্রশ্ন হচ্ছে, একজন কবি নিজে তাঁর চেতনাপ্রক্রিয়ার এই মৌলিক সংগঠনটি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছেন কি না, দ্বিতীয়ত, তাঁর কবিসত্তার পক্ষপাত কোন দিকে—আবেগের দিকে, না মননের দিকে? সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে, এই পক্ষপাত কিংবা প্রবণতাই একটি নির্ণায়ক শক্তি; এই প্রবণতার তারতম্যেই একজন কবি সুইনবার্ন এবং আরেকজন কবি এলিয়ট হয়ে ওঠেন।
আসলে, বড় কবিরা প্রত্যেকেই এই আবেগ ও মননের শঙ্খলাগা শক্তিকে চূড়ান্ত মাত্রায় উজ্জীবিত করেন ও ব্যবহার করেন।” ফলে, একেক কবির মেটাফর একেক রকম এবং নানা কৌনিক ও নানা প্রসেসের মাধ্যমে বিস্তারিত হয়। যা কেবল বাস্তব-পরাবাস্তব প্রতিক্রিয়ার থেকেও মারাত্মক। কখনো যৌন-জটিল সম্প্রসারণের ইন্টারকোর্স থেকেও কোনো-কোনো কবির কবিতা কাব্য রহস্যের তন্তুজট খুলে বেরয় সেইসব অগ্রসর কবির আবচেন বোধ! এবং অনুভূতির অসম্ভব বিস্ময়বোধ! ‘এই বোধ—এই স্বাদ পায় সে কি অগাধ-অগাধ!’—অপূর্ব শব্দবন্ধ চিত্রকল্প উপমার সমন্বয় প্রথাবিরুদ্ধ সমস্ত কবিই একক হয়ে ওঠেন। তার প্রত্যেক কবিতার অন্তর্নিহিত আত্মায়—‘তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু/ মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।’