‘একটি পরিপূর্ণ জীবন তিনি উদযাপন করে গেছেন আনন্দে, উল্লাসে, বেদনায়, কবিতায় ও স্বপ্নে’—রফিক আজাদ সম্পর্কে এভাবে বলেছিলেন,সৈয়দ শামসুল হক।নক্ষত্র এক জীবনের পাঠ শেষ করেছেন।অন্য আর এক আজানা পাঠের উদ্দেশ্যে তার যাত্রা শুরু। জানি না সেখানে কী হবে,তার দিক কী হবে তার নির্দেশনা।তবে আমি এক মাটির কণা, ধূলির পরে শুয়ে দেখেছি, বাংলা সাহিত্যের আকাশে তার বিচ্ছুরিত আলোর শিহরণ।দেখেছি তাঁর হৃদয়ের গভীরতা। মনে পড়ছে তাঁর সঙ্গে যাপিতজীবনের হিসেবে খুব অল্প কিন্তু ঋদ্ধ কিছু সময়ের উষ্ণতার কথা।আর শুনছি আর্তের ক্ষুধায় পীড়িত তাঁর পার্থিব যাতনার হুঙ্কার। যাতনাই নাকি শিল্পীর প্রথম ও শেষ আরাধ্য উপহার,সেলিম আল দীন যাকে বলেন ‘ঈশ্বরের কবি সৃষ্টির এ এক অসাধারণ কৌশল।’ ভালোবাসার জন্য আগল ভাঙাই তাঁর যাতনার শুরু।১৯৫২ সাল।পড়েন তৃতীয় শ্রেণীতে।কত হবে বয়স নয় কি দশ বড়োজোর।বাবা মায়ের নিষেধ ভেঙে মিছিলে চলে যান ২২ ফেব্রুয়ারি। ভাষার প্রতি অদম্য এই ভালোবাসা আর বোধ কী করে এই বয়সে ভেতরে প্রোথিত হলো, এই তো এক পরম বিস্ময়! সত্যিই বুঝি এখান থেকেই শুরু হলো ঈশ্বরের আরও একজন নতুন কবি সৃষ্টির সুচারু কৌশল। যার প্রথম প্রকাশ ১৯৭৩ সালে। স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জন্ম।লেখার শুরু শৈশব থেকে।কিন্তু সে হিসেবে বই প্রকাশ বেশ দেরিতে।প্রথম বই বলে কবির বেশ কিছু ত্রুটি থাকবে এটা তিনি একদমই চাননি আর তাই বেশ সময় নিয়ে তৈরি হয়েছেন প্রথম বইয়ের জন্য।তাঁর প্রথম কবিতার বই যখন বের হলো তখন অলরেডি সমসাময়িক অন্যান্য কবি-নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক,আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (তখন তিনিও কবিতা লিখতেন) তাঁদের কবিতার বই বের হয়ে গেছে।ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে লেখাগুলো বাদ দিয়ে অনার্স এ পড়ার সময়ের বেশ কিছু পরিপোক্ত কবিতা নিয়ে প্রথম বইটির প্রকাশ।রবীন্দ্রনাথের গানের একটি লাইন দিয়ে বইটির নামকরণ।প্রকাশিত হলো ‘অসম্ভবের পায়ে’। ‘রবীন্দ্রনাথকে অগ্রাহ্য করা কি সাহিত্যানুরাগী কি কবি কি লেখক, বোধ হয় এই বাংলায় দুষ্কর।তাই রফিক আজাদেরও আত্মচেতনায় অধিকৃত রবীন্দ্রনাথ। নিজেই বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে বয়স আবেগের কারণে খারিজ করতে চাইলেও এভাবে কবিতার ভেতর উনি ঢুকে পড়েছেন। সেটা আমরা রবীন্দ্রনাথ আত্মীকৃত করেছি বলেই।’ প্রথম কবিতার বইয়ের নাম রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন থেকে নিলেন কেন, এ প্রশ্নের উত্তরটা এভাবেই দিয়েছিলেন তিনি। আর তাই একই গ্রন্থে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের গানের পঙ্ক্তি থেকে তার কবিতার নাম, ‘মাধবী এসেই বলে:যাই’। অতচ কী অদ্ভুত এক বৈপরীত্য। গানটিতে মাধবীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দারুণ আক্ষেপ। প্রকৃতি তরুলতা শান্ত গাছের পাতা আকাশের তারারা যার সঙ্গকামনায় উৎসুক। প্রকৃতির বিশালতা নিয়ে এক পার্থিব নারীর নামে রূপক কথা আর সুরে সেখানে ছড়িয়ে আছে এক অধরা অনুভব, বিলাসী নারীর অবয়বে। আরাধ্য এক স্বাপ্নিক নারী বিরাজে সেখানে পুরো গানটিজুড়ে। রফিক আজাদ রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন নিয়ে নামকরণ করে লিখলেন নারীর একেবারে বিপরীত পার্থিব আর এক রূপ—
তুমি সেই লোকশ্রুত পুরাতন অবাস্তব পাখি
সোনালি নিবিড় ডানা ঝাপটালে ঝরে পড়ে যার
চতুর্দিকে আনন্দ, টাকার থলি, ভীষণ সৌরভ
রোমশ বালুকাবেলা খেলা করে রৌদ্রদগ্ধ তটে
অস্তিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে
কেবল তোমার জন্য বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে
সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে—যাই।
‘স্মৃতি, চাঁদের মতো ঘড়ি’ কবিতায় দেখা যায়, সেই অমোঘ জীবনদেবতার অবস্থান রবীন্দ্রনাথ যাকে বারবার স্বীকার করেছেন।বলে গেছেন, তার লেখক জীবনে জীবনদেবতার দৌরাত্ম্যের কথা।
ঘড়ির কাঁটায় স্থির, সমর্পিত, হে আমার অন্তরঙ্গ জীবনদেবতা,
তালের শাঁসের মতো রাতে আনো অপার বেদনা।
অস্থির এক অপূর্ণতা রফিক আজাদের শুরু থেকেই। মূলত যে কোনো মানুষের এই ব্যক্তিগত অস্থিরতা এই না পাওয়া অর্থাৎ এই রোমান্সই নিয়ে চলে ধাবমান শিল্প কিংবা সৃষ্টির সমগ্রতায়। প্রথম বইটিতে তাঁর এই ক্রমঅস্থির মনোসংকট, মনোবাসনা দেখা গেছে কিছু কবিতায়।‘নিজিনিস্ক’ কবিতাটিতে তার সরল স্বীকারোক্তি উঠে এসেছে এই লাইনগুলোর মধ্যে:
মৃত্যুর মতো বাজে রক্ত-মাংসে করুণ সানাই,
অন্তহীন বেদনায়: শিরা-উপশিরা ব্যেপে ওঠে
অস্থির রক্তের কণা
বইটিকে ভীষণ প্রশংসা করলেন শওকত ওসমান,শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সিকান্দার আবু জাফর প্রমুখ প্রথিতযশা সব কবি। তারপর পেছনে আর ফিরে তাকাতে হলো না। সৃষ্টির প্রেরণাই তাঁকে নিয়ে গেল অমর কাব্য রচনার দোরগোড়ায়। সমসাময়িক লেখা কবিতাগুলো নিয়ে বের হলো পরের কাব্যগ্রন্থ।
১৯৭৪ সাল। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়। বিক্ষুব্ধ তখনও মানুষ, ভঙ্গুর, সদ্য বিজয়ী বাংলাদেশ।অন্তরালে তখনও অনেক ঘুণ পোকা। কেউ-কেউ কেটে যাচ্ছে বাংলার মাটি।শেয়াল শকুনেরা বেশির ভাগই পালিয়েছে। কেউ-কেউ গা ঢাকা দিয়েছে ঠিক। আবার কেউ-কেউ রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধায় রং বদলানোর চেষ্টায় অক্লান্ত। অস্ত্র জমা পড়ছে মুক্তিবাহিনীর। ভেতরে সংগঠিত হচ্ছে নব্য লোভী আর বিবেকহীন কিছু দেশ নেতা। এল দূর্ভিক্ষ। খাবারের অভাব। সাধারণ মানুষের তীব্র ক্ষোভ। বাসন্তীর কাপড় নেই।গায়ে মাছ শিকারের জাল জড়িয়ে সম্ভ্রম রক্ষা করবার বালখিল্য চেষ্টা।পত্রিকার পাতায়-পাতায় দেশের এই মর্মান্তিক অবস্থার খবর।দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে লিখলেন সময়ের শ্রেষ্ঠ কথন, ব্যক্তিগত ক্রোধ থেকে যা ছড়িয়ে পড়লো সারাবাংলার আনাচেকানাচে সর্বজনীন গণমানুষের এক অসংবাদিত ক্ষোভ হয়ে। জন্ম হলো এক অসাধারণ কবিতার। ‘ভাত দে হারামজাদা’। কবির মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোদ্ধার চেয়েও সত্য। কবির উপলব্ধি যখন ব্যক্তিগত যাতনা থেকে উদ্ভুত হয়ে ছড়িয়ে পরে বহুতে। একার কষ্টগুলো হয়ে ওঠে অনেকের। স্পর্শ করে সাধারণ জনমানুষের যাতনা।তখনই বোধ করি তা হয়ে ওঠে সময়ের উজ্জ্বল সিলমোহর।অর্জন করে এক চিরায়ত মার্গ। সঙ্গে-সঙ্গে জুটলো বিড়ম্বনাও যথেষ্ট। কিছু মানুষ কিছু চাটুকার। স্বাধীনতার সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক কবিকে দেশদ্রোহী প্রমাণের চেষ্টায় অক্লান্ত। বঙ্গবন্ধু ডেকে নিলেন তাঁকে। তারপর সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে পরিত্রাণ পেলেন সে যাত্রায়।
তখন আমার বয়স কত হবে? সতের কি আঠারো। ১৯৯৩ সাল। কামরুল হাসান মঞ্জু (আবৃত্তিকার) পড়ছিলেন তাঁর ভরাট কণ্ঠে লাইনগুলো।
আমার সামান্য দাবী:পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর
ভাত চাই—এই চাওয়া সরাসরি—ঠাণ্ডা বা গরম
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চালে হলে
কোনো ক্ষতি নেই—মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই:
দু’বেলা দুমুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য-সব দাবি ।
শুনছিলাম অডিও ক্যাসেটে। পরবর্তী সময়ে মঞ্জু ভাইকে অনুরোধ করে সরাসরি শুনে নিয়েছি এই কবিতার আবৃত্তি আরও বহুবার। সঙ্গে-সঙ্গে আমি ‘ভাত দে হারামজাদা’র দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছি রফিক আজাদের অসংখ্য কবিতার ঘরবাড়ি আর অলিতে-গলিতে।
‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’তে তাঁর আরও একটি অসাধারণ ছন্দোবধ্য কবিতা।রবীন্দ্রনাথেরই এক কবিতার নামে নাম, ‘রাহুর প্রেম’
ভাবছ তোমায় ভুলে যাচ্ছি ২+২+২+২
ভুলতে পারা সহজ নাকি? ২+২+২+২
যদিও তোমার ইচ্ছেটা কি ৩+২+২+২
তাও তো জানি, নিষ্কৃতি চাও ২+২+২+২
স্বরবৃত্তের ৮ মাত্রায় বাঁধা প্রতিটি লাইন আর ২/২ ছন্দে অসাধারণ একটি চলনে চলছিল কবিতাটি। তৃতীয় লাইনে এসে শুরুতে একমাত্রা অধিক, অর্থাৎ মাত্রা সংখ্যা তিন হয়ে গেল। কিন্তু পড়তে গেলে তিনমাত্রার ‘যদিও’ শব্দটাই বেশি যায়।‘যদি’ লিখলে মাত্রার হিসাব ঠিক থাকে কিন্তু পড়ার সময় খানিকটা ছন্দবিভ্রাট মনে হয়। এমন হতেও পারে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ে এমন মাঝে মধ্যে দেখা গেছে। যা হোক। কিন্তু কবি রফিক আজাদের প্রিয় পছন্দ বরাবর ছিল মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।
তার অন্তর্গত বোধ শিক্ষিত সুধীজন চর্চিত নব্যশিক্ষিত জন শিল্পী-কবি-লেখক সুধীসমাজ ছেড়ে বরাবর বাস করেছে সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি।দেশ মাটি সবুজ আর সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি।‘অন্তরঙ্গে সবুজ সংসার’ কবিতায় লিখছেন—
অন্তরঙ্গে অতৃপ্ত কৃষক
স্থান কাল পরিপার্শ্বে নিজ হাতে চাষাবাদ করি
সামান্য আপন জমি,বর্গা চষি না কখনো
বিস্তীর্ণ প্রেইরী নয়-আপনার সীমিত সবুজে
পরম নিশ্চিন্তে চরে নীল-গাই,যুথবদ্ধ মেষ,
নিরীহ হরিণগুচ্ছ..
১৯৭৭ সাল। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া।আদিগন্ত গ্রাম প্রকৃতির ভালোবাসার এক অদ্ভুত প্রকাশ। যুদ্ধোত্তর রক্তস্নাত পৃথিবীর প্রান্তে দাঁড়িয়ে রক্তপ্রপাতহীন পৃথিবীর প্রত্যাশায় ‘চুনিয়া’ এক অসাধারণ সৃষ্টি হয়ে আজও জ্বলজ্বল করছে বিমুগ্ধ পাঠকের মনে—
রক্তপাত,সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে
চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ:
চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত
মারণাস্ত্রগুলো
ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে
চুনিয়া তো চায় মানুষের তিনভাগ জলে
রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক।
চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলো
সুগন্ধি ফুলের চাষে ভরে তোলা হোক।
‘ভাত দে হারামজাদা’র দরজা দিয়ে ঢুকে রফিক আজাদের অসংখ্য কবিতার অলিগলি পার হয়ে আমি বের হয়ে এলাম ফাগুনের দ্বিতীয় দিনে একটি ফুল তাঁকে দিতে না পারার যাতনায় দগ্ধ হতে-হতে।এই ফাগুনে যখন তিনি চেতনার সীমান্তের মাঝামাঝি কেবল,তখন আমি যেতে চেয়েছিলাম একটা গোলাপ নিয়ে তার কাছে। তিনি কি চিনতেন আমায় তখন, তিনি কি জানতেন তাঁর কবিতা কতটা বিমুগ্ধ করেছিল এক সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ নারীর কোমল মন? আমি চলে এলাম একেবারে কবি ও কবিতার ঘরবাড়ির কাছাকাছি। সাইন্স ফ্যাকাল্টিতে খাতা কেটে ‘ঘ’ ইউনিট দিয়ে সরাসরি ঢুকলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সঙ্গে যুক্ত হলাম ‘কবিতা পরিষদে’।লেখালেখি নিয়ে সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার কিছুটা সময় যাপন। তখন ভীষণ লিখতাম। কবিতা লেখা আর আবৃত্তির নেশায় পাগল বলা যায়। কিন্তু কোনোদিনই আবৃত্তি পরিষদের অনুষ্ঠানে আমি নিজের লেখা পড়তে পারতাম না। তিনি আমায় খুব বলতেন, ‘কেন পড়িস না নিজের লেখা’। আর সত্যি বলতে পুরোবছরের এই ফেব্রুয়ারি মাসটাতেই তাঁর সঙ্গে আমার একবার দেখা হতো।যখন বুঝলেন আমি কোনোভাবেই নিজের লেখা পাঠ করব না তখন আর জোর করতেন না। শুধু বলতেন, ‘পড়িস না পড়িস। লিখে যাস। ভালো লিখিস। লেখাটা বন্ধ করিস না।’ তিনি প্রাজ্ঞ ।তিনি বিজ্ঞ।তবু আমি তাঁর কথা রাখিনি।লিখে যাইনি বহুকাল। ছেড়ে দিয়েছিলাম লেখা।আসাদ চৌধুরী,সমুদ্র গুপ্ত, ড. মোহাম্মদ সামাদ আরও অনেকের কথা মনে পড়ছে এখন এই লেখাটি লিখতে বসে। কিন্ত তাঁর কথা তাঁদের মনে রাখিনি আমি। দূরত্ব বাড়ছে ধীরে-ধীরে। বন্ধু মরে গেল। স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে।সেটাও ফেব্রুয়ারি মাস। তাকে শেষবারের মতো আজিমপুর গোরস্থানে শুইয়ে দিয়ে এসে কবিতা পরিষদে উপস্থিত হয়েছি। সন্ধ্যা লাগো লাগো। সব জানলেন আমার কাছে। তার কথা। আমার প্রাণবন্ধু লুবনার কথা। তিনি জানতেন আমার তেমন বন্ধু বলতে একজনই ছিল। বললেন, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে? হবেই তো। মানুষ সারাজীবন ধরে একজন মনের মতো বন্ধু পায়না। আর তুই তাকে হারালি। কি ছিল রে ওর কষ্ট? কেন চলে গেল এমন করে?’ আমি কিছুই বলতে পারিনি। চিরকালের ভীষণ অশ্রুলুকানো মানুষ আমি সেদিন তাঁর প্রশ্নে অশ্রু লুকাতে পারিনি। আর তাই দেখে বললেন, ‘এই কষ্টটা কিন্তু ঈশ্বরের দান। ঈশ্বর তোকে ভালোবেসেছেন। মনে রাখিস। কবির রত্ন, প্রাপ্তি সে-কষ্ট যাতনা দহন আর একাকীত্ব। একে যত্নে রাখিস।’ সেই থেকে আমি একা। যত্নে রাখি যাতনা সকল। দূর হয়ে যাই সব থেকে। উড়ে যাই মানুষ থেকে দেবতায়। প্রেম থেকে কিউপিডে। মর্তের প্রেমিক থেকে প্রাণের ঠাকুরে। মানবী থেকে অমানবী—এক অধিকতর অধরা সত্তায়। বিষণ্ন এক নীল নির্জনে বাস করি এক যুগ। সোনার কৌটায় ভরে প্রাণ ভোমরা রেখে আসি সাত সমুদ্দূর তের নদীর অতলে।তারই প্রাপ্য সব তখন বাড়তে থাকে সুদে আসলে,বহুদিন পর আবার নতুন করে শুরু। বন্ধু নেই।যোগাযোগবিহীন।চারপাশে সবই নতুন।আমার নতুন জন্ম যেন। আবার শুরু করি লেখা। খুঁজি তাঁকেও। যোগাযোগ ঢিমা তেতালা সব। যুগের ব্যবধানে কেউ ভুলে গেছে প্রিয়মুখ।কেউ ভুলে গেছে জানাশোনা। সামাদ স্যারের সাথে দেখা হলো আবৃত্তির এক অনুষ্ঠানে।স্যার আমায় মনে করতে পারলেন।ভাবছি রফিক আজাদের সঙ্গেও একদিন যোগাযোগ করব। বন্ধু আমার।সে রফিক আজাদের খুব কাছের মানুষ। বলল,‘চলো একদিন সময় করে যাই রফিক ভাই এর কাছে।’ আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে যেতে চাইলাম। তখনো তিনি চেতনায় আছেন।চিনতে পারেন সবাইকে। জানতে চান কে কে এসেছে তাঁকে দেখতে।বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম, কোন এক ২ ফাগুন ভীষণ রিক্ত আর অধৈর্য হয়েই তাকে ফোন করে ডেকে আনলেন।সেদিন ছিল কবির জন্মদিন।কবি তখন রিক্ত,নিঃস্ব।বললেন, ‘বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেছি। কবিতা পরিষদ করেছি।কতইনা কবিতা লিখেছি বাংলার জন্য। আর আমার জন্মদিনে একটা ফুলের বুকে উপহার দেওয়ার মতো কেউ নেই এখানে?’ সেদিন তারপর আর যা যা ঘটেছিল, তা আর নাই বলি। লজ্জা পেতে পারে তাতে বাংলার মানুষ, লেখক, কবি, সুধীজন, রাষ্ট্র, সমাজ । তাঁর মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে লোক দেখানো মানুষের উন্মাদনা।
তুচ্ছ সাধারণ এক প্রত্যাশা। আজন্ম ভালোবাসার কাঙাল। একটুকু ভালোবাসার জন্য লালায়িত আজীবন।তাঁর দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ—
যদি ভালোবাসা পাই আবার শুধরে নেব
জীবনের ভুলগুলি
যদি ভালোবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘপথে
তুলে নেব ঝোলাঝুলি
যদি ভালোবাসা পাই শীতের রাতের শেষে
মখমল দিন পাবো।
অর্থ-বাণিজ্য সম্পদ নয়। এমনকী স্বীকৃতির জন্যও নয়। কবিতার জন্য জীবনপাত।এই ছিল তাঁর প্রাপ্তি। যখন দেরিতে একুশের পদক পেলেন তখনও কোনো ক্ষোভ ছিল না তাঁর। শুধু বললেন, ‘কর্তৃপক্ষের মনে হলে দেবে। না হলে না।এতদিন পর যে ওদের মনে হয়েছে আমাকে একুশের পদক দেওয়া যায়,এই জন্যই আমি আনন্দিত।’ কবিতার জন্য জীবন বিসর্জন। তাঁর ভাষায় ‘আমি বলি বিসর্জিত এই জীবন’।কিন্তু পাঠককে দিয়েছেন সবচেয়ে ভালোবাসার স্থান। পুরস্কারের জন্য তো কেউ লেখে না। পাঠকের স্বীকৃতি। এটাই বড় পুরস্কার।কেউ কবিতা পড়ে না কবিতার বই কেনে না বলে আমরা যখন হতাশ, তখন তিনি দৃঢ় চিত্তেই বলেন, ‘সাধারণ মানুষের মধ্যেই কবিতা পাঠক বেশি’।দারুণ এক খোলা মন ছিল তাঁর।নিজের প্রতি সমালোচনা মেনে নেওয়ার মতো হলে মেনে নিয়েছেন।স্বীকার করবার মতো হলে স্বীকার করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। যখন আশির দশকে ফরিদ কবির একটা সংখ্যা বের করেছিলেন, ‘আশির দশকের চৌর্যবৃত্তি’। তাতে শিকদার আমিনুল হক, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী প্রখ্যাত সব কবি কার-কার আইডিয়া চুরি করেছেন সেসব নিয়ে কথা আছে। সংকলনটা দেখে তিনি একদমই হতচকিত হননি। বরং চুরির পক্ষে মত দিয়ে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘বড় মাছ সবসময় ছোট মাছ খেয়ে ফেলে। আমি তো বড় মাছ।’
তাঁর সৃষ্টি অসাধারণ এক আলো নিয়ে জ্বলে থাকে মুগ্ধ পাঠকের চিত্তে। তিনি নিজেই বলে গেছেন,‘অনেকেই বলে প্রেমের কবিতাগুলোতে আমার সবসময়ই একটা স্পেশালিটি আছে। এগুলো দিয়েই আমি মনে করি,আমি না থাকলেও পঠিত হবে। অনেক সময় দ্বিধা হয় না যে, যা লিখছি তা হচ্ছে কি না! প্রেমের কবিতাগুলো নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিধা নেই। এগুলো দিয়েই আমার মনে হয়,যে, না, আমি বোধহয় কবি।’ অসাধারণ এক আত্মপ্রত্যয় তাঁর প্রেমের কবিতায়। ১৯৭৭ সালে যেমন লিখেছেন, ‘খুচরো অথবা খুব দরকারি ভারী শব্দাবলি/টেবিলে ঈষৎ ঝুঁকে নিষ্ঠাভাবে যে-রকমভাবে/ দেখে নিতে হয়, প্রয়োজনে তোমাকে তেমনি পড়ি/ তুমিই আমার হও বিশ্বাস-স্থাপনযোগ্য সেই বিশুদ্ধ মৌলিক গ্রন্থ: তোমাকে পড়েই শিখে নিই/শব্দের সঠিক অর্থ, মূল ধাতু, নির্ভুল বানান।’ ১৯৮১ সালে এসে লিখছেন তেমন করেই প্রেমের কবিতা, ‘আমার ছাদে বৃষ্টি/তোমার ছাদে ক্রোধ/বৃষ্টি তোমার খুব পছন্দ/আমার কিন্তু রোদ।’
এত এত প্রেমের কবিতার পরেও আমার সমস্ত সত্তাজুড়ে থাকে তাঁর সেই অমোঘ প্রেমের কবিতাটি ‘তুমি:বিশ বছর আগে ও পরে’। বলেছেন, ‘তুমি যে সকল ভুলগুলি করতে সেগুলো খুবই মারাত্মক/তোমার কথায় ছিল গেঁয়ো টান/অনেকগুলো শব্দের করতে ভুল উচ্চারণ:প্রমথ চৌধুরীকে তুমি বলতে প্রথম চৌধুরী:/ জনৈক উচ্চারণ করতে গিয়ে সর্বদাই জৈনিক বলে ফেলতে।/ এমনি বহুতর ভুলে ভরা ছিল তোমার ব্যক্তিগত অভিধান/ কিন্তু সে সময়, সেই সুদূর কৈশোরে ঐ মারাত্মক ভুলগুলো তোমার বড়-বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলুম।’
এ দিয়ে শেষ করব ভাবছিলাম।কিন্তু মন বলছে আরও কত কত কি যে লিখি। নিজের নামে নাম কবিতার, ‘রফিক আজাদ’। নিজেকে ঘোষণা করলেন মাইকেলের সমান দুখী। ‘দুঃখ তোমার ডুবিয়ে দেব/দুঃখ নদীর অগাধ জলে/অগাধ জলে/তোমার সাঁতার না জানা প্রাণ/ডুবতে ডুবতে ডুবে যাবে/ডুবে যাবে/শরীর তোমার ভাসবে শুধু অগাধ গভীর জীবন জলে/ভাসবে তুমি ডুববে তুমি উঠবে ভেসে/দুঃখে তোমায় ভাসতে হবে ভাসতে হবে/ভাসবে ডুববে/অন্তহীন এক লবন জলে/দুঃখী জীবন এ ছাড়া আর কি পেতে চায়/সুখের কুলুপ আঁটা দুখের ঘরে ঢুকতে মানা/এ তো তোমার ছিলই জানা/তবু মাইকেল কী দুরাশায়/বাঁধছ এ বুক গভীর গহন অমানিষায়!’
এরপর আর কী বলা যায়! তাঁর নিজের ধারণা এমন গভীর দুঃখ না থাকলে তিনি কবি হতেন না। তাঁর জন্মের আগে তার ভাই মারা না গেলে, প্রতিদিন খেতে বসে মৃত ভাই এর জন্য মায়ের কান্না না দেখলে তিনি কবি হতেন না। দুঃখই তাঁর একমাত্র সম্বল। আর তাই দুঃখের আগাধ সে স্রোতে ভেসে ভেসে চলেও গেলেন ভালোবাসার একটি ফুলের সুবাস না পাওয়ার যাতনা নিয়ে। শেষে তাঁর লেখা কবিতা দিয়ে এঁকে যাই তারই ছবি। কবিতার নাম, ‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’ যেখানে ‘মধু ও সেগুন কাঠে তৈরি হলে যা দাঁড়াতো চোখজুড়ে তেমন গায়ের রং’ বলে যে সময় কিংবা সময়যাপনের প্রশস্তি গেয়েছেন কবি, আমার মনে হয়েছে তেমনি মধু ছিল তার অন্তর্গত যন্ত্রণাগুলো, দগ্ধতার বোধগুলো। সেগুন কাঠ ছিল তাঁর অসাধারণ শব্দ, ছন্দ, বাক্য আর বিকৃতিকে আঘাত করার ভাষা। দরকার (প্রয়োজনমতো) হলে কুরুচিপূর্ণ ভাষাও। সেই কবিতাটি শেষবার বলে যাই:
দেখি:মধ্যরাতে
জ্যোৎস্নায় জ্বলছে কটি ঘোড়া
তাদের শরীর থেকে ঝরছে বিদ্যুৎ-
গর্বিত গ্রীবায় নয় সারাদেহে ঝরে স্নিগ্ধ নান্দনিক দ্যুতি!
মধু ও সেগুনকাঠে
তৈরি হলে দাঁড়াতো
চোখজুড়ে
তেমন গায়ের রঙ-পেলব,মসৃণ!
পা ঠুকছে ঘোড়াগুলি
চৈত্রের শস্যহীন মাঠে—
অনিন্দ্য সুন্দর।