মানুষ কি তবে ততক্ষণই বেঁচে থাকে, যতক্ষণ সে শ্বাস নেয়? কিছু মানুষ মৃত্যুর ওপার থেকে বারবার ফিরে আসেন স্মরণে-ক্ষরণে। কিছু মানুষ মরে গিয়েও আরও বেশি বেঁচে থাকেন অনেক মানুষের চেতনায়, প্রেরণায়, কর্মে। ২০ নভেম্বর রফিক ভাইয়ের প্রয়াণদিবস। আমাদের রফিক ভাই। জ্বলজ্বলে চোখে স্বপ্ন জ্বেলে রাখা খুব সাধারণ এক অসাধারণ মানুষ রফিক ভাই। ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রয়াত রফিকুল ইসলাম। একাত্তরে সম্মুখ সমরে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা রফিক ভাই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বপ্নদ্রষ্টা রফিকুল ইসলাম।
অবশ্য তাকে খুব বেশি মানুষের চেনার কথাও নয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেই পিঠ নিজে চাপড়ে দেওয়ার উদলা সংস্কৃতি থেকে বরাবর দূরে থাকা মানুষ তিনি। তাই বাংলাভাষী অনেকেই জানেন না যে বাংলাভাষাকে, একুশে ফেব্রুয়ারিকে, মাতৃভাষা দিবসকে পৃথিবীব্যাপী তুলে ধরতে রফিকুল ইসলামের অবদানের কথা। একুশে ফেব্রুয়ারিই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস না হয়ে তিন শত পঁয়ষট্টি দিনের যেকোনো একটি দিনকে ইউনেস্কো ঘোষণা করতে পারতো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
রফিকুল ইসলাম ছিলেন দেশপ্রেমিক ও ভাষাপ্রেমিক। তার ‘ব্রেন চাইল্ড’মাতৃভাষা দিবসকে তাই তিনি যুক্ত করতে চেয়েছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে। কেন না একুশে ফেব্রুয়ারি মানে মাতৃভাষার জন্য জীবন দান, একুশ মানে বাংলাদেশ, একুশ মানে আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে তুমুলভাবে জাগিয়ে দেওয়া।
এখানে MLLWS’র আয়োজনে প্রতি বছর জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে পালিত হচ্ছে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ ফেস্টিভ্যাল’। ‘সিটি অব স্যারি’ এই ফেস্টিভ্যালকে নিয়মিত বাৎসরিক উৎসব হিসেবে ঘোষণা করেছে।
মাতৃভাষা যেমন সবার, রফিকুল ইসলামেরও সর্বজনীন হয়ে ওঠার কথা ছিল। তিনি তো কেবল কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের ভ্যাংকুভারে বসবাসকারী বাঙালিদের রফিকুল ইসলাম নন, তিনি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে থাকা বাংলাভাষীর জন্য উচ্চারিত নাম হতে পারতেন।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষিত হয়েছে, এরপর পেরিয়ে গেছে বিশটি বছর: পৃথিবীর সব অফিসিয়াল, নন অফিসিয়াল, ফার্স্ট নেশন, এবোরিজিনাল, বহুভাষী ইমিগ্রান্টস, এমনকি লিংগুস্টিক মাইনোরিটিসরাও (ব্রেইল ও সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহারকারী) এই দিনটি উদযাপন করে আসছেন সেই থেকে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকও জানেন না আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাবককে। কিভাবে জানবেন! এটা তো তাদের পাঠ্যসূচিতে নেই এবং পাঠ করা বাধ্যতামূলক নয়। জানার জন্য নয়; পাস করার জন্য যেটুকু পড়া দরকার, সেটুকুই যথেষ্ট। আমাদের ফাঁপা ও রোবট প্রজন্ম মার্ক জুকারবার্গকে চেনেন, এখন সর্বাধিক গুগল সার্চ হয় সানি লিওনদের জন্য, ডিজে পার্টির উত্তাল বিটে হারিয়ে যায় দেশগানের সুর; এই পরিস্থিতিতে কিভাবেই বা আশা করি একজন রফিকুল ইসলাম কিংবা কমলা ভট্টাচার্য (বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র নারী ভাষা শহীদ) দৃষ্টিগোচর হবে মানুষের?
এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, এই কুড়ি বছরে ভ্যাংকুভারে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি কী করেছে? রফিক ভাইয়ের হাতে গড়া ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি’ একটি মাল্টিন্যাশনাল, মাল্টিকালচারাল ও মাল্টিলিংগুয়াল অর্গানাইজেশন। এটাইবাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ প্রাপ্তএকমাত্র বিদেশি অর্গানাইজেশন। গ্রেটার ভ্যাংকুভারে অবস্থিত এই অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকেই রফিক ভাই ইউনেস্কোর মাধ্যমে একুশকে প্রতিস্থাপন করেছিলেন বিশ্বদরবারে। এখানকার বিভিন্ন মিউনিসিপ্যালিটিতে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে হিসেবে স্বীকৃত। এখানের স্যারি সিটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘লিঙ্গুয়া আকুয়া’, যাকে বলা যায় কানাডার প্রথম মাদার ল্যাংগুয়েজ মনুমেন্ট।এখানে MLLWS’র আয়োজনে প্রতি বছর জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে পালিত হচ্ছে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ ফেস্টিভ্যাল’। ‘সিটি অব স্যারি’ এই ফেস্টিভ্যালকে নিয়মিত বাৎসরিক উৎসব হিসেবে ঘোষণা করেছে।
কেন জানি মনে হয়, যদি রফিক ভাই দেশে থাকতেন, যদি নিজের শহর কুমিল্লাতেই হতো তার কবর, অন্তত স্বজনেরা, শহরের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো, সচেতন মানুষেরা তাকে পেতো, তার কাজ আর ভাবনাগুলোকে মূল্যায়ন করতো, তাকে নিয়ে চর্চা হতো। রফিকুল ইসলাম মূর্ত হয়ে উঠতেন অনেকের চেতনায়।
২০১৫ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিতেই কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পেয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে। এ মর্যাদার ক্ষেত্রে এক যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন প্রদেশটির ২৯তম লেফটেনেন্ট গভর্নর জুডিথ গুইচন, যিনি কমনওয়েলথ প্রতিনিধি এবং একইসঙ্গে বিসির অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী সুজান এন্টন।
এ বছরই কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের সারে স্কুল বোর্ডে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে হিসেবে স্কুল ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্তির জন্য নীতিগতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি স্কুল ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত হলে শুধু স্যারি স্কুল বোর্ডেই গড়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার ছাত্রছাত্রী তাদের মাতৃভাষা সম্পর্কে এবং মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য স্কুল বোর্ডের ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্তির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি নীরবেই কাজ করে। কারণ এই কাজগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা দীর্ঘসূত্রিতায় বাঁধা।
রফিক ভাই ঘুমিয়ে আছেন Chilliwack Graveyard-এ। মাঝে মাঝে তাকে আমার বড্ড একাকী মনে হয় অথচ তার পারসোনালিটিই এমন ছিল যিনি অনেক মানুষের সঙ্গে, অনেক মানুষকে নিয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। রফিক ভাইয়ের শেষ ইচ্ছে ছিল দেশের মাটিতে যেন তাকে কবরস্থ করা হয়। কিভাবে যেন সেটা আর ঘটে ওঠেনি। একজন মানুষ যখন জাতীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন তখন তিনি শুধু তাঁর পরিবারের থাকেন না। তার ওপর দেশ, মাটি ও মানুষেরও অধিকার থাকে। আমরা অনেক সময় ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ইচ্ছের বেড়াজালে নিজেদের পরিধিটাকে সংকীর্ণ করে ফেলি যেটা রফিক ভাইয়ের ক্ষেত্রে ঘটেছে। কেন জানি মনে হয়, যদি রফিক ভাই দেশে থাকতেন, যদি নিজের শহর কুমিল্লাতেই হতো তার কবর, অন্তত স্বজনেরা, শহরের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো, সচেতন মানুষেরা তাকে পেতো, তার কাজ আর ভাবনাগুলোকে মূল্যায়ন করতো, তাকে নিয়ে চর্চা হতো। রফিকুল ইসলাম মূর্ত হয়ে উঠতেন অনেকের চেতনায়।
রফিক ভাই নেই, আসলে তার শরীরটা নেই কিন্তু স্পষ্টভাবে টের পাই তার উপস্থিতি; ছায়া-মায়া-সদিচ্ছার মতোই সাথে থাকবেন আমৃত্যু।