রতনতনু ঘোষ—শিল্পের প্রতি শিল্পীর দায়বদ্ধতা বা মানুষের প্রতি শিল্পীর দায়বদ্ধতার কথা জেনেই পা বাড়িয়েছেন কবিতায়। কবিতার পথে হাঁটতে হাঁটতে সংগ্রহ করেছেন অভিজ্ঞতা বা ঘটমান বিশ্বের শব্দ। এই শব্দই তাকে কবিতা রচনায় সাহায্য করেছে। একজন মানুষ যখন কবিতার দিকে আসে, তখন তাকে অতিক্রম করতে হয় জীবনের নানা বাস্তবতার কর্দমাক্ত পথ। যে পথ কখনো সহজ ছিল না। একজন মানুষ যখন শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে সুন্দরতম একটি কবিতা নির্মাণ করে তখন সেই মানুষটিকে আমরা ‘কবি’ বলি। ‘কবি’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের মধ্যে একটা শিহরণ বা বিদ্যুতের দ্যুর্তি দোলা দিয়ে যায়। কিন্তু ‘কবি’ হওয়ার জন্য একজন মানুষকে সুদীর্ঘ চর্চার পথ পাড়ি দিতে হয়। এজন্যই বোধ হয় কবি আল মাহমুদ বলেছেন, ‘কোনো জাতির শত বছরের পুণ্যের ফসল একজন কবি। একজন কবিই পারেন তাঁর নিজের বিশ্বাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিজের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।’ কবিদের কোনো সঙ্গী নেই। কবিরা সব সময় একা, নিঃস্ব। বাস্তবতায় কবির কবিতার শব্দগুচ্ছ হয়ে জীবন্ত রূপে ধরা দেয়—কবির কোনো সঙ্গী নেই শব্দগুচ্ছ ছাড়া / বহু পথ খোলা আছে সব দিকে / তবু কবির পেরুনোর পথ নেই…। কবির অনুভবে, ধরা দেয় বাস্তবিক নানা অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতায় কবির মূলবীজ। যে বীজ বপনেই কবির কবিতা বৃক্ষের জন্ম হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, এজন্যই বোধ হয় শুদ্ধতার কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘আমাকে অনুভব করতে হয়েছে যে, খণ্ড-বিখণ্ডিত এই পৃথিবী, মানুষ ও চরাচরের আঘাতে উত্থিত মৃদুতম সচেতন অনুনয় ও এক এক সময় থেমে যায়, একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটি মোমের মতোন যেনো জ্বলে উঠে হৃদয় এবং কবিতা জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়।’ এই চমৎকার অভিজ্ঞতা যে সময় আমাদের হৃদয়কে ছেড়ে যায়, সে সব মুহূর্তে কবিতার জন্ম হয় না। কবি রতনতনু ঘোষও নানা অভিজ্ঞতার পুঁজি নিয়ে এসেছেন কবিতা রাজ্যে এবং আমাদের উপহার দিয়েছে একের পর এক সমসামরিক ও বাস্তবধর্মী কবিতা। যে কবিতা আমাদের নিজেকে নিজের, পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে নতুন নতুন ভাবে ভাবতে বসিয়ে দেয়। এ কবির শব্দজ্ঞান যেমন তীক্ষ্ম, তেমনই তাঁর কবিতাও পরিপাটি। মনে হয় এসব যোগ্য শব্দের জন্য কবি ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকেন দিনের পর দিন আর শব্দের আগমনে লেখে চলেন দ্বন্ধ-সংঘাতময় কবিতা—‘দুজনের দুটি আকাশ মিলেছে এক আকাশে / উজ্জ্বল বর্ণালি ঠিকরে পড়ে আকাশের সুদূর হতে / জীবনের যৌথ ভূমিতে।’ (দুটি আকাশ এক আকাশে)। এ কবি একজন হতাশা, দুঃখ, দারিদ্র্য, বিরহ ও দ্রোহের কবি। যার কবিতায় প্রতিফলন ঘটেছে মানবিক চিন্তার। তিনি মানবিক চিন্তায় নিজের অবুঝ মনকে বার বার আক্রান্ত করেছেন নানা চিন্তায়। এ রোগাক্রান্ত মন নিয়ে হতাশাবাদী দলনেতা সেজে কবি প্রতিনিধিত্ব করেছেন এক হতাশাবাদী কাব্য ধারার। যা কবিকে হতাশাবাদী হিসেবেই চিহ্নিত করে। এ হতাশা গ্রস্ত কবিই বিষণ্নতা হয়ে নিজে নিজেকে প্রশ্ন বিদ্ধ করে বলেছেন, তবু থামে না ধ্বংসের গতি ধারা। এ কবি একজন শব্দযোদ্ধা। যার কবিতায় উঠে এসেছে সমাজের ক্ষয়িষ্ণুবাস্তবতার চিত্র, সামাজিক, আর্থিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, জঙ্গিচেতনা শাসিত রাজনীতির কুফল, ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, রাজনৈতিকতার অনৈতিকতা, যাপিত জীবনের বহুস্তর, হতাশা, বিরহ, দ্রোহ। এ উপাদানগুলোকেই কবি অনুষঙ্গ করে একের পর এক রচনা করে চলেছে কবিতা—
ক. প্রবল রোষে অপশক্তি জ্বলে / আঘাতে ফালি ফালি হয়ে / বেদনায় রঙ যায় বয়ে। (ঘুড়ি)
খ. মানুষেরা সহিংস হয় জানি। (জাগো ধ্বংসের স্তুপ হতে) গ. জীবনের বিপরীতে তাড়িত জীবন। (জাগরণের শিহরণ)
ঘ. সৃজনহীনের গর্জনপ্রতিভা করে কোলাহল স্বাধীনতা বড়াই পরাধীনের। (কিছুলোক)
ঙ. মানুষেরা ধ্বংস করে নিজের পৃথিবী ভেঙ্গে ফেলে কষ্টের অর্জন। (আত্মঘাতী মানুষ)
চ. জীবন পেরিয়ে মৃত্যু আসে অনিবার্য হয়ে। (বিকল্প)
ছ. মানুষেরা আইন করে আইন ভঙ্গ করে উৎসাহে। (গাছ পাহাড় নদী পাখি মাছ)
জ. কাঁটাতারের বেড়া না হলে কি চলে না। (পাসপোর্ট ভিসা উঠে যাক)
ঝ. উত্তাল সমুদ্রে নিজেকে হারাবে ফের জীবন সংগ্রামে।
ঞ. লাশখেকোরা টাকা চেনে জীবন বোঝে না। (জীবনের মৃত্যু ফাঁদ)
ট. সৃজনহীনরা সফল অতি পুরস্কার ক্রয়ে / পুরস্কার তৃপ্ত প্রতিভা সৃজনের লাশ। (প্রতিভার লাশ)
ঠ. আর কত কাল শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরবে স্বদেশে- (গণ কবর) ড. বহুদিন অনুভূতিহীন থেকেছে বিবেক… (দোষী আমি)
ঢ. যুক্তিবাদের আঘাত হানে মৌলবাদ নৃশংসতাণ্ডবে / সশস্ত্রদের উদ্যত বাহু চাপাতি হয়ে / আক্রমণে শিকার করে সারা বিশ্বে / অভিজিত লুটিয়ে পড়ে জনারণ্যে অসহায়… (তান্ডব থামে না তবু) তার সমসাময়িক কবিদের কবিতায় আমাদের সামাজিক অনুষঙ্গগুলো ভিন্ন ভিন্ন কবির কবিতায় ভিন্ন ভিন্নভাবে ধরা দিয়েছে। কারও কবিতায় এসেছে নগরায়নের হা-হাকারময় জীবন, জীবনের যন্ত্রণাক্লিষ্টতা, কেউবা নিয়েছে সুফিবাদী দীক্ষা, এ দীক্ষায় প্রভাবিত হয়ে কবিতায় এসেছেন সুফিবাদের গুঢ়তত্ত্ব। যৌনতাও এসেছে কোনো কোনো কবির কবিতায়। আবার কেউ প্রকৃতিকে অবলম্বন করেও রচনা করেছেন কবিতা। রতনতনুর কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়। ‘যৌনতার শিল্প’ কবিতায় বললেন—‘মানুষের যৌনতা নিয়ে জীবন কাটে যৌনবিদের… / নারী মূর্তি ফেসবুকে যৌনছবি হয়ে / দর্শকের দৃষ্টি কাড়ে, লাইক পড়ে, অজস্র / প্রোফাইলের ভেতর তলিয়ে যায় যৌন মুখচ্ছবির গুচ্ছ। / জীবন গন্ধ যৌনতায় শিল্পখেলা চলবে চিরকাল।’
সাধারণত মানুষ যৌনতা বা নগ্নতাকে খারাপ বললেও আমরা শিল্পীরা খারাপ বলছি না। কেননা এর সঠিক জবাব দিয়েছেন- মকবুল ফিদা হুসেন। তিনি বলেছেন- ‘নগ্নতা বিশুদ্ধতারই রূপকালঙ্কার।’ কবিও যথার্থই বলেছেন—‘এই যৌনতা নিয়ে যে শিল্পের খেলা তা চিরকাল চলবেই।’ এ ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে কবি দেখাতে চান, কিভাবে যৌনতা বা নগ্নতার স্রোতধারা আমাদের মধ্যে প্রবহমান। কবির কবিতায় প্রেমও এসেছে নানাভাবে। তিনি সমসাময়িক ঘটনাকে আশ্রয় করে হতাশা বা বিষণ্নতার কবিতা রচনা করলেও রোমান্টিকতাকে বাদ দিয়ে নয়। এ রোমান্টিকতা তরল প্রেমময় মিথ্যা ছলনা নয়, এ প্রেম সামাজিক অনাচারের বিপক্ষে-সহজ, সরল প্রেম, যা কবিতার সহজ সারল্যের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করেছেন। কবির জীবনের এসেছে হা-হাকার, না পাওয়ার বিষাদযন্ত্রণা। তবুও কবি এ না পাওয়ার বেদনায় নিজেকে নতজানু করে ফেলেননি। স্বপ্ন দেখেছেন এবং দেখিয়েছে তাঁর পাঠকদের। এ কল্পনা বা অভিজ্ঞতাকে অনেকে মিথ্যা বলেন। তারা বলেন কবিরা মিথ্যা বলে, তারা বানোয়াট কথার মালা সাজায়। কিন্তু স্যার ফিলিপ মিডনি বলেছেন- ‘কবিরা কখনো মিথ্যা বলে না, কেন না তারা কখনো সত্য বলে না।’ আবার বোদলেয়ার বলেন- “কবিতাকে যদি কখনো নৈতিকতা বা বিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বিত করা হয় তবে তার শাস্তি হবে মৃত্যু অথবা নির্বাস”; কবিতায় অন্বিষ্ট সত্য নয়, কবিতার অন্বিষ্ট কবিতা নিজেই। কবিতার জীবনের নিমজ্জিত সত্য বা রহস্যময়তাকে কবি খুঁজে ফেরেন নানা ভাবে বা নানা কায়দা কানুনে। রতনতনুও সে ভাবেই খুঁজে ফিরেছেন স্বপ্না, সুলতানের প্রেম, ভালোবাসা। হৃদয়ের হা-হাকার নিয়ে রচনা করেছেন ‘বিরহনামা’।
১. সুলতা তুমি হারাবে নির্মম আঁধারে তা ভাবিনি / কখনো ভাবিনি তুমি তলাবে আঁধার পাতালে। (অন্ধকার আবর্তে হারানো)
২. শরীরে তার জোছনা নামে উজ্জ্বল আনন্দ হয়ে। (মোহময় স্বদেশ)
৩. আসার পথে নদী বলেছিল তুমি ভুলনা আমায়। (নদীরা ভোলেনি আমাকে)
৪. যে চোখ দেখেও না দেখার ভান করে / সে চোখ প্রতারক বড়ো। (ভণ্ড হতে সাবধান)
কবিদের জীবনে বুঝি জীবন নেই। তারা স্বপ্নের মধ্যেই বসবাস করে। তাদের জীবনে জীবন আছে এবং বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে তারা স্বপ্নের মধ্যে বসবাস করে না। তাদের যাপন করতে হয় জীবনহীন জীবনের। এ কবিতা রচনার জন্যই একজন কবিকে পোহাতে হয় অবহেলা, অনাদর, যন্ত্রণা, বিদ্রূপ আর হারাতে হয় পারিবারিক, সাংসারিক নানা সময়, প্রেমিকার ভালোবাসা। এলিয়েট এ জন্য যথার্থই বলেছেন—‘কবিতা রচনা করা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করা’। রতনতনু ঘোষ একজন উত্তরাধুনিকতাবাদী কবি। তিনি এ উত্তরাধুনিকতাকেই আশ্রয় করে রচনা করেছেন কবিতা। যেখানে এসে আবাস গড়েছে- হতাশা, বিষণ্নতা, বিষাদময়তা, সভ্যতার কদাচার, মানবিকতাহীনতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ ইত্যাদি। উত্তরাধুনিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য একরৈখিকতাবাদ দিয়ে কবিকে বহুরৈখিক হয়ে ওঠা। রতনতনুও সেই একরৈখিকতাকে বাদ দিয়ে বহু রৈখিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেই লক্ষ্যেই তিনি তাঁর গ্রন্থের নামকরণ করেছেন ‘বহুস্বরের কবিতা’। তিনি নির্মাণ করতে চান বহুস্বরবাদের রাষ্ট্র। যেখানে সবাই হবে সমান গুরুত্বের অধিকারি। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই কবি নির্মাণ করলেন বহুরৈখিকতাবাদের কবিতা। কবির এ বিষয়ভাবনা শুধু স্থানিক নয়, এটি আন্তর্জাতিক চিন্তা-চেতনারও ফসল। তিনি অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছেন এ কবিতায়। কবি তিনি তার কবিতায় সর্বকালকে সমান মূল্যায়িত করেই কবিতা জীবন্ত করে তুলেছেন এবং আন্তর্জাতিক ভাবনা চিন্তারও প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তাঁর কবিতায়। কবিতা শুধু সীমানাক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রতনতনু তার কবিতায় চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি, আঞ্চলিকতা বা আন্তর্জাতিকতাবাদকে আশ্রয় করে নির্মাণ করেছেন কবিতার শরীর কাঠামো। আর এগুলোই কবির নান্দনিক আর ব্যঞ্জনাময় শব্দ চিত্রকল্পের সত্যিকার কবিতা বিনির্মাণে কবিকে সর্বাত্রক সাহায্য করে।
কবিরা কবিতা না লিখলে হয়তো পৃথিবী এত সুন্দর হতো না, আকাশ জুড়ে বসতো না চাঁদ-তারাদের মেলা। রতনতনু ঘোষ নির্মাণ করে চলেছেন নতুন পৃথিবী। সাজিয়ে তুলছেন কবিতার কর্ষিত জমিন। তিনি কখনো এককভাবে কোন কিছু নিয়ে কবিতা রচনা করেননি। সে জন্যই তার কবিতায় আমরা দেখেছি বহুমাত্রিকতার ছোঁয়া এবং তার কবিতায় ডানা মেলেছে বহুমাত্রিক চিন্তা চেতনায়।