লেখক রতনতনু ঘোষের মৃত্যুর পর লাশ শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মঙ্গলবার (০৪ অক্টোবর ) সকাল ১১টায় বাংলা একাডেমির সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাংলা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (বর্তমান সচিব) আনোয়ার হোসেন রতনতনু ঘোষের মরদেহ একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢোকাতে নিষেধ করেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলা একাডেমিতে তাদের মরদেহ ঢোকানো যায়, যারা বাংলা একাডেমির সদস্য ও ফেলো। এছাড়া কোনো সুযোগ নেই। ওই সময় উপস্থিত অনেকে বলেন, ‘রতনতনু ঘোষ তো বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য। তাহলে কেন তার মরদেহ ঢুকতে দেওয়া হবে না।’ এর জবাবে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিশিষ্ট লেখক ছাড়া বাংলা একাডেমিতে কারও মরদেহ ঢোকানোর সুযোগ নেই।’
তার এমন সিদ্ধান্তে উপস্থিত সবাই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে রতনতনু ঘোষের মরদেহ দাহ করার জন্য নিজ গ্রাম মুন্সীগঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। তিনি বিশিষ্ট লেখক নন কেন? বিশিষ্ট লেখক হতে কী কী গুণ থাকতে হবে- এমন হাজারও প্রশ্ন উঁকি দেয় কবি-সাহিত্যিকদের মনে। এ নিয়ে ফেসবুকেও নিন্দার ঝড় ওঠে। কারণ হিসেবে সবাই উল্লেখ করেন- লেখক রতনতনু ঘোষ বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের প্রথম ব্যাচের সদস্য ছিলেন। কোর্স শেষে হলে প্রতিষ্ঠানটি তার ‘মানুষের স্বরূপ’শীর্ষক একটি প্রবন্ধের বই প্রকাশ করে। এই নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় আশি। উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাগুলো হলো, ‘অগ্রসর বাংলাদেশ’, ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’, ‘নোবেলবিজয়ীদের কথা’, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’, ‘ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি’ ও ‘উত্তরাধুনিকতা’প্রভৃতি। এছাড়া ২০১৪ সালের বাংলা একাডেমি সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভার পুস্তিকা থেকে জানা যায়, রতনতনু ঘোষ প্রতিষ্ঠানের জীবনসদস্য। ওই বছরের সাধারণ সভায় উপস্থিতির তালিকায় তার নাম রয়েছে। জীবনসদস্য ক্যাটাগরিতে তার ক্রমিক নং ২৮০, জীবন সদস্য নম্বর: ১২৫৯।
একটি গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদের সদস্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেছেন, ‘বিষয়টি দুঃখজনক। আমি আগামী ০৬ অক্টোবর নির্বাহী পরিষদে বিষয়টি তুলব। ওই সচিবকে কারণ দর্শাতে হবে।’ বিশিষ্ট কবি জোতির্ময় নন্দী বলেন, ‘রতনতনু ঘোষ একজন বিশিষ্ট লেখক। একজন অধ্যাপক। তার মরদেহ বাংলা একামেডির নজরুল মঞ্চে নিতে দেওয়া হয়নি। এটা দুঃখজনক। যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে।’
কবি সেলিনা শেলী লিখেছেন, ‘খুব লজ্জা হচ্ছে। রতনতনু ঘোষের ‘মানুষের স্বরূপ’, ডাইনোসর নিয়ে লেখা বইসহ আরও দু’তিনটি বই পড়েছি আমি। মানুষের ধর্ম নিয়ে, মানবতা নিয়ে লিখেছেন তিনি। আহা বাংলা একাডেমি- করুণা করতেও লজ্জা হচ্ছে আমার।’
কবি ও শিক্ষক রনজু রাইম লিখেছেন, ‘রতনতনু ঘোষ বিশিষ্ট লেখক নন, এই বিবেচনায় তার লাশ বাংলা একাডেমিতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ২৫ বছর অধ্যাপনা করেছেন, ৮০টি বইয়ের লেখক, বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি থেকে প্রবন্ধে তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কারপ্রাপ্ত, বাংলা একাডেমি থেকে যার বই প্রকাশিত হয়েছে, সেই রতনতনু ঘোষ বাংলা একাডেমির বিবেচনায় বিশিষ্ট নন। কথা হচ্ছে, কোন লেজবিশিষ্টরা বাংলা একাডেমির বিবেচনায় বিশিষ্ট?’
কথাশিল্পী পিন্টু রহমান লিখেছেন, ‘‘বাংলা একাডেমির কাছে ‘বিশিষ্ট লেখক’দের নামের তালিকা দাবি করছি। না হলে তনুদার স্বজনদের মতো আরও অনেকেই বিভ্রান্ত হবেন। এছাড়া আমরা যারা মফস্বলে থাকি, তাদের লাশ ভুলক্রমে একাডেমির সামনে চলে গেলে পরিবার বিপদে পড়বে। লাশ ভাগাড়েও ফেলে দিতে পারে! অতএব, জলদি তালিকা চাই।’’
কথাসাহিত্যিক অজয় দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘রতনতনু ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়নি কখনো। জানলাম তিনি বিশিষ্ট লেখক নন বলে বাংলা একাডেমি তাঁর নিথর দেহটি ঢুকতে দেয়নি। কত কারণে বাংলা একাডেমির পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। সরকারি লোক নন, অবিশিষ্ট, দলের কেউ না, সংখ্যালঘু। খান সাহেবদের দখলে এই একাডেমিতে তাঁকে না নিলেও চলত।’
সাখাওয়াৎ টিপু লিখেছেন, ‘রতনতনু ঘোষের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তবে কথা বলতাম কম। প্রায় সময় দেখতাম আজকের কাগজ অফিসে আসত। নিয়মিত কলাম লিখত। তবে তাঁর লেখা বিশেষ পড়েছি বলে মনে হয় না। সালাম সালেহ উদ্দিন আর চঞ্চল আশরাফের সঙ্গে বেশ খাতির ছিল। মাঝে মাঝে চা-পানের ফাঁকে আড্ডা হয়েছে বেশ ক’বার। শুনলাম, তাঁর লাশ নাকি বাংলা একাডেমিতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বিষয়টি বেশ নির্মম! সাহিত্য মানুষকে মানবিক বোধ দেয়। কিন্তু লেখক রতনের লাশ নিয়ে বাংলা একাডেমি সংশ্লিষ্টদের অমানবিক আচরণ, এমন নির্মমতা, গোটা সমাজের জন্য ভয়ানক। কী এমন ক্ষতি হতো তাঁর লাশটা বাংলা একাডেমিতে রাখলে?’
তরুণ কবি জব্বার আল নাঈম লিখেছেন, ‘তাঁর মৃতদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বাংলা একাডেমিতে রাখার অনুমতি দেয়নি ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক। এ নিয়ে বেশ শোরগোল! আসলে এতে শোরগোলের বা অবাক হওয়ার কিছু নেই। জীবদ্দশায় সেখানে লেখকরা বসতে বা আড্ডা দিতে পারে না। এমনকি অনেকের কর্মজীবনও না। মৃত্যুর পর তাঁকে সেখানে নেওয়া কোন যুক্তিতে! আমার মতে কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবী কারও মৃতদেহ সেখানে নেওয়া উচিত নয়। সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত জাতীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধাস্থল করা হোক।’
এ প্রসঙ্গে কবি-ছড়াকার অদ্বৈত মারুত লিখেছেন, ‘‘আজ বেলা ১১ টায় রতনতনু ঘোষের লাশবাহী গাড়ি বাংলা একাডেমি গেটে এলেও ‘তিনি বিশিষ্ট লেখক নন’ এই তকমা এঁটে গাড়ি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢুকতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। হে লেখকরা, জীবিত অবস্থায়ই সিদ্ধান্ত নিন এবং বলে যান, মৃত্যুর পর আপনার লাশ কোথায় নেওয়া যাবে, কোথায় নেওয়া যাবে না।
রতনতনু ঘোষের বিদেহী আত্মা শান্তি পাক, সৃষ্টিকর্তার কাছে এ প্রার্থনা করি।’’
তাঁর মৃত্যু আমাদের যতটা না কষ্ট দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমরা বাংলা একাডেমির এমন আচরণে।
এ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। বাংলা একাডেমি সরকারি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় সম্পদ। ওখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। বাংলা একাডেমি লেখক তৈরি করে না। লেখক তৈরি করে এদেশের মাটি, পানি, বায়ু এবং প্রকৃতি। তৈরি লেখককেই বাংলা একাডেমি ‘পদক’ দেয়। তাও সবার কপালে জোটে না। যাদের কপালে কোনো দিন পদক বা বিশিষ্টতা জোটেনি, তারা কি পাঠকের মাঝে, মানুষের মাঝে অমর হয়ে নেই? আছেন এবং থাকবেন।
ক্ষণিকের জন্য দুঃখ পেয়ে জীবনকে তুচ্ছ ভাবার কোনো মানে নেই। নিজস্বতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে হবে সবাইকে। বুঝতে হবে-আজকের ঘটনায় হাতেগোনা কয়েকজন (অবিশিষ্ট) ছাড়া আর কাউকে কথা বলতে দেখা যায়নি। রতনতনুর পাশে তাঁরা (বিশিষ্ট) ছিলেন না। কারণ তাঁরা উচ্চমার্গীয়। সাহিত্যের জমিনে এমন বিভাজন আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাহিত্যে এখন চরম আকাল চলছে। চলছে হতাশা, গ্রহণের কাল। সুতরাং সাধু সাবধান! লিখতে ইচ্ছে হলে লিখে যাও। সাহিত্যের জন্য উৎসর্গ করে দাও জীবন-যৌবন। বিনিময়ে কী পেলে, কী পেলে না তার জন্য আফসোস করো না।
সবশেষে রতনতনু ঘোষের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে সাময়িক বেদনা ভুলে কবির প্রাণে, সাহিত্যিকের মনে চির জাগ্রত করে রাখুন তাঁকে। একজন লেখকের মৃত্যুকে ঘিরে বাংলা একাডেমির এমন নির্মমতা আমাদের চোখ খুলে দিক। আপন আলোয় পথ চলতে উৎসাহিত করুক।
মন্তব্য