আমার লেখালেখি হঠাৎ করে নয়, অন্যের দেখাদেখি নয়। বরং বলা যায়, লেখালেখি আমার স্বভাবেই ছিল। ছিল সেই ছোটকাল থেকেই। তখন আমি তৃতীয় কী চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি, গ্রামের একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে, একই ক্যাম্পাসে ছিল একটি হাইস্কুলও।
যুদ্ধের বছর আমার আব্বা ঢাকা থেকে গ্রামে আসা এক লোক থেকে একটি রেডিও সেট কেনেন, যতদূর মনে পড়ে দাম সম্ভবত একশ টাকা। সেই থেকে আমি রেডিওতে গান, খবর, অন্য অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত শুনি। স্বাধীনতার পরে সকাল ৯ টা-১০ টার দিকে প্রতি শুক্রবার ঢাকা বেতার কেন্দ্রে ও চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে ছোটদের জন্য অনুষ্ঠান হতো, সে সব অনুষ্ঠান আমি নিয়মিত শুনতাম। সে সব অনুষ্ঠানের একটা পর্ব ছিল দূর-দূরান্ত থেকে ছোটদের পাঠানো ছড়া-কবিতা পড়ে শোনানো। তাতে আমি উদ্বুদ্ধ হই, দু-একটা লিখে পাঠাতে থাকি।
একদিন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালকের কাছ থেকে অফিসিয়াল পত্র আসে ডাকে আমার নামে, তাতে আমার লেখার প্রাপ্তিস্বীকার ও ধন্যবাদ জানানো হয়। পরের সপ্তাহে রেডিও সেটের সামনে বসে অনুষ্ঠান শুনছি, হঠাৎ করে আমার নাম-ঠিকানাসহ পাঠানো কবিতাটি পাঠ করা হলো। নিজ কানে নিজের নাম-ঠিকানাসহ কবিতাটি শুনে সে কী আবেগ-আনন্দে ভাসলাম, বলে বোঝানো যাবে না। মনে আছে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন মুশতারী শফী। মূলত সেই থেকেই আমার লেখালেখি শুরু। তবে সে সব লেখা তো শিখেছি স্বভাবে, আবেগ, খেয়ালে। তখনো জানা ছিল না ছন্দ, মাত্রা, পর্ব, কবিতার নিয়ম-কানুন; তবু লিখে যাচ্ছি। সময়ে-অসময়ে, বিষয় ছিল সীমিত-দেশ, দেশের প্রকৃতি, বাংলা ভাষাপ্রীতি।
অনুকরণের আদর্শ ছিল রবীন্দ্র, নজরুল, জসীম, সত্যেন্দ্রনাথের শিশুতোষ ছড়া-কবিতা। অন্ত্যমিল ছিল সম্বল। সে সময়ের লেখাগুলো লেখা হয়ে না উঠলেও লেখালেখির প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে এক ধরনের মূল্য ছিল বৈ কি। পরে স্কুল জীবনে দেয়াল পত্রিকা বের হতো, তাতেও লিখেছি। আবার নিজেও দেয়াল পত্রিকা বের করেছি। এ সময়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বিকেল ৫ টার দিকে আ. ন. ম. বজলুর রশীদের পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠান হতো। তাতে সপ্তাহে একদিন দূর-দূরান্তের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘চম্পাবকুল’ নামে একটি ছড়া-কবিতা পাঠের পর্ব থাকতো। সেখানেও আমার কটি ছড়া-কবিতা নাম-ঠিকানাসহ প্রচারিত হয়। এ শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠানে আ. ন. ম. বজলুর রহমান রশীদ নিজে কবিতার ছন্দ, পর্ব ও মাত্রা সম্পর্কে আলোচনা করেন, যা শুনে আমি ছন্দ, পর্ব ও মাত্রা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করি। এ ধারণা থেকে লিখতে থাকি।
প্রায় একই সময়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে আসাদ চৌধুরীর পরিচালনায় উদীয়মান লিখিয়ে এদের জন্য ‘কথাকলি’ নামে একটি অনুষ্ঠান হতো। তাতেও আমি ছড়া-কবিতা প্রেরণ করি, এবং কয়েকটি ছড়া-কবিতা আমার নাম-ঠিকানাসহ প্রচারিত হয়। এভাবে লেখা প্রচারে আমার আবেগ-আনন্দ বাড়তে থাকে, লিখতে থাকি লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে কলেজে এসে তিন-চার জন ক্লাসমেট পেয়ে যাই, যারা লেখালেখি করে। এখানেও দেয়াল পত্রিকা বের করি, লেখা ছাপি।
অন্যদিকে লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছি কয়েকটি পুরস্কারও। উল্ল্যেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পুরস্কার, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় নজরুল পুরস্কার, নজরুর ইন্সটিটিউট নজরুল পুরস্কার, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর একুশে সাহিত্য পুরস্কার।
এবার লেখার বিষয়ে যুক্ত হয় রাজনীতি। কলেজে আনিসুল হক নামে একজন বাংলার স্যার ছিলেন, তিনিও লেখালেখি করতেন; তার বাসায় মাঝেমধ্যে কবিতা ও গল্প পাঠের আসোর বসতো। সেখানে যোগ দিয়ে নিজের লেখা কবিতা পড়তাম। কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও কবিতা পড়তাম, আবৃত্তি করতাম, বিতর্কসভায় অংশ নিতাম। কলেজের ছাত্র সংসদের বার্ষিকীতে কবিতা বের হলে আনন্দ কে দেখে! আনিসুল হক স্যারের নির্দেশনায় ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ পরিষদে (বর্তমানে সরকারি গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর) উদীয়মান লেখকদের জন্য আয়োজিত একুশে রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করি। এই সময়ে দৈনিক বাংলা বাণীর স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় আমার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়, এটি কোনো জাতীয় দৈনিকে আমার কবিতার প্রথম প্রকাশ। এর ফলে লেখালেখিতে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে ‘ছান্দসিকী’ নামক ছন্দের বইটি পড়ে স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও প্রবহমান অক্ষরবৃত্ত সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়ে যাই। তাতে আমার লেখার গতি ও মান বাড়তে থাকে। এ সময়ে জেলা সদর থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকীতে নিয়মিত লিখতে থাকি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়তে এসে সাহিত্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করে বুঝতে পারি, এত দিনের লেখাগুলো কত অগভীর ও একান্তই প্রাথমিক প্রস্তুতি মাত্র। নতুন জ্ঞানে নতুন বোধে নতুন করে ভাবতে থাকি, লিখতে থাকি। স্বভাবনির্ভরতা বাদ দিয়ে এবার হয়ে উঠি মনননির্ভর, কমে যায় লেখার গতি, মাথায় ঢোকে লেখার মান, সৃষ্টিশীলতা ও মননধর্মিতার প্রসঙ্গ। এ পর্যায়ে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান স্যার ও রাজীব হুমায়ুন স্যারকে আমার কবিতার গুরু মানি। তাদের কবিতা ও কবিতা-বিষয়ক আলোচনায় আমি যেন নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। এ সময় থেকে আমি কবিতার পাশাপাশি কিছু কিছু সাহিত্যসমালোচনা লিখতে থাকি। ফলে আমি হয়ে উঠি কবি ও কাব্যসমালোচক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে আমি লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পদক ও পুরস্কার ১৯৮৭ ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর একুশে সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮৮ অর্জন করি। এসব পুরস্কার ও লেখালেখিতে আমাকে বেশ উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এফরহমান হল সংলগ্ন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস প্রেসে সপ্তাহে একদিন ‘কবিতাসন্ধ্যা’ নামে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর বসতো। সেখানে অন্যদের সঙ্গে আমিও অংশ নিতাম। এর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন আবুল আজাদ। পৃষ্ঠপোষক ছিলেন প্রফেসর হারুন-উর রশিদ। এ আসরে আসাদ চৌধুরী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবু তাহের মজুমদার প্রমুখ কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করতেন। তাতে আমরা বেশ উপকৃত হয়েছি। তারা আমাদের কবিতার ভুলগুলো সুন্দরভাবে ধরিয়ে দিতেন ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন। সমকালীন দেশি-বিদেশি কবিতার ধারা-প্রকৃতি-প্রবণতা ক্লাসের বাইরে এখান থেকে এবং অন্য আরও দুই-এক জায়গা থেকে সম্যক জেনেছি।
এভাবে নানা জায়গা থেকে, নানা অনুষ্ঠান থেকে, নানা আসর থেকে, নানা কেন্দ্র থেকে, নানা আড্ডা থেকে, নানা বই-পুস্তক থেকে জেনে শুনে দেখে পড়ে উপলব্ধি করে লেখালেখি জগতে বিচরণ করছি। এর পরিণাম এখন পর্যন্ত সাতটি কাব্যগ্রন্থ, আটটি নজরুল বিষয়ক গ্রন্থ ও দুটি কবিতা ও শিল্প বিষয়ক গ্রন্থসহ মোট একুশটি গ্রন্থ এবং একটি লিটল ম্যাগ ও একটি সাময়িকী। অন্যদিকে লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছি কয়েকটি পুরস্কারও। উল্ল্যেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পুরস্কার, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় নজরুল পুরস্কার, নজরুর ইন্সটিটিউট নজরুল পুরস্কার, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর একুশে সাহিত্য পুরস্কার।